গাজায় সহায়তা প্রবেশে ইসরায়েলের নতুন আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, খুলে দেওয়া হবে রাফাহ ক্রসিং

নিহত চার জিম্মির মরদেহ ফেরত পাওয়ার পর গাজা ও মিশরের মধ্যবর্তী রাফাহ ক্রসিং খুলে দেওয়া এবং গাজায় মানবিক সহায়তা স্থানন্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসরায়েল। এছাড়া ইসরায়েল হামাসের বিরুদ্ধে যে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ছিল—যার মধ্যে ছিল গাজায় ত্রানবাহী ট্রাকের সংখ্যা অর্ধেক করা—তা বাতিল করা হয়েছে।
এর আগে, গাজা উপত্যকায় মানবিক সহায়তা প্রবেশে নতুন করে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ইসরায়েল। দেশটি জানায়, পরিকল্পনা অনুযায়ী রাফাহ সীমান্তও খোলা হবে না।
মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানে অন্তত ৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এতে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি আবারও চাপে পড়েছে।
জাতিসংঘকে ইসরায়েল জানিয়েছিল, বুধবার থেকে প্রতিদিন মাত্র ৩০০টি ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় ঢুকতে দেওয়া হবে; যা যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে নির্ধারিত সংখ্যার অর্ধেক।
গাজায় 'ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর দ্য কোঅর্ডিনেশন অফ হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্স' (ওসিএইচএ)-এর মুখপাত্র ওলগা চেরেভকো জানান, গাজায় সহায়তা প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা ইসরায়েলি সংস্থা 'কোঅর্ডিনেশন অফ গভর্নমেন্ট অ্যাক্টিভিটিজ ইন টেরিটরিজ' (সিওজিএটি) থেকে প্রাপ্ত নোটটি জাতিসংঘ পেয়েছে।
নোটে বলা হয়, যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় জ্বালানি বা গ্যাস প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না; কেবল মানবিক অবকাঠামোর প্রয়োজনে সীমিত পরিমাণে সরবরাহ করা হতে পারে।
গাজা সিটি থেকে আল জাজিরার সাংবাদিক হানি মাহমুদ জানান, প্রতিদিন ৩০০টি ট্রাক প্রবেশের অনুমতি গাজায় দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি বদলানোর জন্য মোটেও যথেষ্ট নয়। তিনি বলেন, 'তিনশ ট্রাক যথেষ্ট নয়, এতে কোনো পরিবর্তন আসবে না।'
এই নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগে উত্তর ও দক্ষিণ গাজায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন বলে চিকিৎসা সূত্রে আল জাজিরাকে জানানো হয়েছে। গাজা সিটিতে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় অন্তত ৬ জন এবং খান ইউনিসে ৩ জন নিহত হন।
গাজার আল-আহলি আরব হাসপাতালের সূত্র জানিয়েছে, মঙ্গলবার শুজাইয়া এলাকায় ইসরায়েলি সেনারা আরও ৫ জন ফিলিস্তিনিকে গুলি করে হত্যা করেছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, উত্তর গাজায় সেনাদের দিকে ধেয়ে আসা কিছু ব্যক্তির 'হুমকি' মোকাবিলা করতেই তারা গুলি চালিয়েছে।
যুদ্ধবিরতি কার্যকরের চার দিনের মাথায় এই হামলা চালায় ইসরায়েল। যুদ্ধবিরতির লক্ষ্য ছিল বন্দি বিনিময় ও গাজা থেকে আংশিকভাবে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার।
এই যুদ্ধবিরতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত পরিকল্পনার প্রথম ধাপ, যার উদ্দেশ্য গাজার ওপর ইসরায়েলের যুদ্ধের অবসান ঘটানো।
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবরে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজায় অন্তত ৬৭ হাজার ৯১৩ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ১ লাখ ৭০ হাজার ১৩৪ জন। আরও বহু মানুষের মরদেহ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে ইসরায়েলে চালানো হামলায় অন্তত ১ হাজার ১৩৯ জন নিহত হন এবং দুই শতাধিক মানুষকে জিম্মি করে নিয়ে যাওয়া হয়।
যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী, সোমবার হামাস ও ইসরায়েল বন্দি বিনিময় সম্পন্ন করে। এতে ইসরায়েলের কারাগারে থাকা প্রায় ২ হাজার ফিলিস্তিনি মুক্তি পান এবং গাজায় আটক থাকা ২০ জন ইসরায়েলিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এদের মধ্যে ১৫৪ জন ফিলিস্তিনিকে মিশরে নির্বাসিত করা হয়।
যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে হামাসের সোমবার ২৮ জন মৃত ইসরায়েলি বন্দির মরদেহ হস্তান্তরের কথা ছিল। তবে তারা প্রথমে কেবল ৪টি কফিন হস্তান্তর করে। পরে হামাস জানায়, মঙ্গলবার আরও ৪ জন মৃত ইসরায়েলির মরদেহ হস্তান্তর করা হবে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, রেড ক্রস সেই মরদেহগুলো গ্রহণ করেছে এবং পরে সেগুলো ইসরায়েলে পৌঁছেছে, যেখানে ফরেনসিক পরীক্ষা চালানো হবে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এর আগে হামাসকে অভিযুক্ত করে বলেছিল, বন্দিদের মরদেহ হস্তান্তরের ক্ষেত্রে যুদ্ধবিরতির শর্ত ভঙ্গ করেছে হামাস।
এই বিলম্ব নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে লেখেন, 'মৃতদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ফেরত দেওয়া হয়নি! দ্বিতীয় ধাপ এখনই শুরু হচ্ছে!'
হামাস জানিয়েছে, নিহত বন্দিদের মরদেহ উদ্ধার করতে সময় লাগছে, কারণ তাদের সবাই কোথায় আটক ছিলেন তা জানা নেই এবং গাজায় ব্যাপক ধ্বংসের কারণেও কাজটি কঠিন হয়ে পড়েছে।
জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে আল জাজিরার প্রতিবেদক বলেন, 'মূল বিষয় হলো, হামাস মরদেহ হস্তান্তরে ধীরগতির অজুহাতে ইসরায়েল ইতোমধ্যে গাজায় সহায়তা সীমিত করার হুমকি দিতে শুরু করেছে।'
গাজায় আরও সহায়তা পাঠানোর আহ্বান জাতিসংঘের
গাজায় আরও সহায়তা পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। গাজায় জরুরি সহায়তা পৌঁছাতে সব সীমান্ত ক্রসিং খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক রেড ক্রস।
ওসিএইচএ-এর মুখপাত্র জেন্স লারকে বলেন, গাজায় পাঠানোর জন্য ১ লাখ ৯০ হাজার মেট্রিক টন ত্রাণ প্রস্তুত আছে। ইউনিসেফের মুখপাত্র রিকার্ডো পাইরেস জানান, ইউনিসেফের ১ হাজার ৩৭০টি ট্রাক গাজায় প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে।
তিনি বলেন, 'ধ্বংসযজ্ঞ এত ভয়াবহ যে অন্তত ৬০০টি ট্রাক প্রতিদিন গাজায় ঢোকা দরকার—এটাই আমাদের লক্ষ্য। কিন্তু আমরা এখনো তার কাছাকাছিও পৌঁছাতে পারিনি।'
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)ও গাজায় আরও সহায়তা পাঠানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে। সংস্থাটির মুখপাত্র তারিক জাসারেভিচ বলেন, 'হাসপাতালগুলোর ওপর চাপ হঠাৎ কমবে না, তাই চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ দ্রুত বাড়াতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'যত বেশি সম্ভব চিকিৎসা সামগ্রী এখনই গাজায় পাঠাতে হবে, যাতে যারা এখনো চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন, তাদের কাছে প্রয়োজনীয় উপকরণ থাকে।'