যুদ্ধ থামানোর কৃতিত্ব নিলেন; তবে গাজার ভবিষ্যৎ ও পুনর্গঠন প্রশ্নে এখনও নিরুত্তর ট্রাম্প

দীর্ঘ দুই বছরের যুদ্ধবিরতির মাঝে হামাসের হাতে আটক ২০ জিম্মির প্রথম দলের মুক্তির কয়েক মিনিট পরেই সোমবার সকালে ইসরায়েলে অবতরণ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। জিম্মিদের আনন্দময় পারিবারিক পুনর্মিলন এবং চলমান যুদ্ধবিরতির পেছনে ইসরায়েল প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর চেয়ে ট্রাম্পকেই বেশি কৃতিত্ব দিচ্ছে। তার আগমনে দেশটি যেন করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে।
এই সুযোগটি লুফে নিয়ে ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নেসেটে ট্রাম্প ঘোষণা করেন, 'এটি কেবল একটি যুদ্ধের সমাপ্তি নয়, এটি সন্ত্রাসবাদ ও মৃত্যুর যুগের অবসান।' অতীতে অনেক প্রেসিডেন্ট এমন কথা বললেও তা হতাশায় পর্যবসিত হয়েছে। সেই প্রসঙ্গ এড়িয়ে ট্রাম্প আরও বলেন, 'এটি এক নতুন মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহাসিক ভোর।'
এরপর তিনি মিশরের উদ্দেশে রওনা দেন। লোহিত সাগর তীরবর্তী একটি রিসোর্টে তার জন্য অপেক্ষমাণ ছিলেন বিশ্বের ডজনখানেক নেতা। একটি 'শান্তি সম্মেলন' আয়োজনের জন্য সেখানে ট্রাম্প সেখানে যান। রিসোর্টের রাস্তাঘাট জুড়ে ট্রাম্পের ছবি সম্বলিত ব্যানার টাঙানো হয়েছিল।
মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি বলেন, 'শার্ম আল-শেখ শহর থেকে জনগণের ইচ্ছা এবং বিশ্ব নেতাদের সংকল্প গাজায় যুদ্ধ অবসানে একত্রিত হয়েছে।' মানবজাতির প্রতি তাদের সবার একটাই বার্তা: যথেষ্ট হয়েছে যুদ্ধ। শান্তিকে স্বাগত জানাই।
তবে, মিশরের এই শান্তি সম্মেলনে ইসরায়েল বা হামাস কোনো পক্ষই অংশগ্রহণ করেনি। হোয়াইট হাউস অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর স্বাক্ষরিত একটি নথি প্রকাশ করলেও, এতে স্বাক্ষরকারীরা কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল না। নথিটির একটি অংশে বলা হয়েছে, 'আমরা এতদ্বারা বলপ্রয়োগ বা দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের পরিবর্তে কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা ও আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যতের বিরোধ নিষ্পত্তির অঙ্গীকার করছি।'
ইসরায়েলে ট্রাম্পের প্রতি অভূতপূর্ব সংবর্ধনা
দেশের মাটিতে ট্রাম্প যতটাই বিভেদ সৃষ্টিকারী হিসেবে পরিচিত হন না কেন, বিদেশে এমন প্রশংসা ও সংবর্ধনা কোনো আমেরিকান প্রেসিডেন্ট সচরাচর পান না। তেল আবিবের জিম্মি চত্বরে হাজার হাজার মানুষ 'ট্রাম্প, ট্রাম্প' বলে স্লোগান দেয়, এমনকি নেসেটের কিছু সদস্যকে লাল রঙের 'মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন' স্টাইলের টুপি পরিহিত অবস্থায়ও দেখা যায়।
এর ঠিক আগের রাতে, অর্থাৎ শনিবার, যে নেতানিয়াহুর নাম ধরে একই চত্বরে ধিক্কার দেওয়া হয়েছিল, তিনিই এবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে 'হোয়াইট হাউসে ইসরায়েলের দেখা সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু' বলে ঘোষণা করেন। তাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার এবং ইসরায়েল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার বিষয়েও আলোচনা হয়।
ইরানের প্রতি অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব ও ইসরায়েলিদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া
যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তির আবহে ইসরায়েলে এসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের প্রতি এক অভাবনীয় প্রস্তাব দিয়েছেন। মাত্র চার মাস আগেই ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে ইরানের বেশ কয়েকটি লক্ষ্যবস্তুতে বোমা হামলা চালিয়েছিল। সেই ইরানের সঙ্গেই কয়েক দশকের শত্রুতা ও বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটাতে আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে ইসরায়েলি আইনপ্রণেতাদের রীতিমতো বিস্মিত করেছেন ট্রাম্প।
তিনি বলেন, 'আপনারা জানেন, এটি দারুণ হবে, যদি আমরা তাদের সাথে একটি শান্তি চুক্তি করতে পারি।' এরপর প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, 'আপনারা কি এতে খুশি হবেন?' তিনি আরও বলেন, 'আমার মনে হয় তারা ক্লান্ত।' তবে এই প্রস্তাবে ইসরায়েলের দিক থেকে তেমন কোনো উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া মেলেনি।
পক্ষান্তরে, যখন ট্রাম্প ইসরায়েলের ১২ দিনের বোমা হামলায় ইরানি পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের হত্যার বর্ণনা দেন, কিংবা যখন তিনি ফোরদো, নাতাঞ্জ ও এসফাহান—ইরানের প্রধান পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ সাইটগুলিতে বি-২ বোমারু বিমান, রি-ফুয়েলার এবং সহায়তা বিমানের মাধ্যমে বাঙ্কার-বাস্টার ফেলার বিস্তারিত বিবরণ দেন, তখন উচ্ছ্বসিত করতালির শব্দে ফেটে পড়ে নেসেট।
গাজার ভবিষ্যৎ ও ট্রাম্প-নেতানিয়াহুর ভিন্নমত
তবে আলোচনার গভীরে গাজার ভবিষ্যৎ এবং এই যুদ্ধবিরতি, যা অবশেষে খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহের পথ খুলে দিয়েছে, তা স্থায়ী শান্তি আনবে কিনা—এসব নিয়ে স্পষ্ট মতপার্থক্য ছিল। ইসরায়েলে আসার পথে এয়ার ফোর্স ওয়ানে এবং নেসেটের করিডোরে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বারবার বলেছেন, 'যুদ্ধ শেষ।'
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ছিলেন অনেক বেশি সতর্ক। তিনি জিম্মি মুক্তিকে স্বাগত জানালেও, বছরের পর বছর পর এই প্রথম গাজায় কোনো জীবিত ইসরায়েলি জিম্মি না থাকার বিষয়টিকেও ইতিবাচক হিসেবে উল্লেখ করেন। তবে হামাস নিরস্ত্র না হলে বা এলাকা ছেড়ে না গেলে ইসরায়েল আবার যুদ্ধ শুরু করবে কিনা, সে বিষয়ে তিনি কোনো আলোচনা করতে রাজি হননি।
ট্রাম্পের ২০-দফা পরিকল্পনার এই অংশটিতে হামাস কখনোই রাজি হয়নি এবং ইসরায়েল সম্প্রতি যে এলাকাগুলো থেকে সরে এসেছে, সেখানে এরই মধ্যে হামাস ফিরে যেতে শুরু করেছে।
এমনকি ট্রাম্প যখন জেরুজালেমে ছিলেন, তখন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ ঘোষণা করেন যে হামাস বন্দিদশায় মারা যাওয়া ২৮ জন জিম্মির মধ্যে মাত্র চারজনের দেহাবশেষ মুক্তি দিয়েছে। তিনি এক্স-এ পোস্ট করেন, 'প্রতিটি বিলম্ব বা ইচ্ছাকৃত এড়ানো চুক্তিটির চরম লঙ্ঘন হিসাবে বিবেচিত হবে এবং সেই অনুযায়ী এর জবাব দেওয়া হবে।'
বাধা উপেক্ষা করে ট্রাম্পের বক্তব্য ও পররাষ্ট্রনীতি
আগের সম্ভাব্য বাধাগুলো উপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ট্রাম্প। নেসেটে দেওয়া তার বক্তৃতায় তিনি মূল বক্তব্য থেকে সরে এসে নেতানিয়াহুর ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন করেন: 'তার সাথে কাজ করা সহজ নয়, কিন্তু এটাই তাকে মহান করে তোলে।'
তিনি তার বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের এ বছরের শুরুতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির ভি. পুতিনের সাথে কয়েক ঘণ্টার কথোপকথন নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করেন। নিউইয়র্কের রিয়েল এস্টেট বিনিয়োগকারী উইটকফকে ট্রাম্প 'হেনরি কিসিঞ্জারের মতো, যিনি তথ্য ফাঁস করেন না' বলে বর্ণনা করেন।
উল্লেখ্য, নিক্সন ও ফোর্ডের অধীনে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং তারপর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী হেনরি কিসিঞ্জার ছিলেন ওয়াশিংটনের নিজের স্বার্থে তথ্য ফাঁসের ওস্তাদ।
অল্প কিছু সংক্ষিপ্ত উল্লেখ ছাড়া, ট্রাম্প গাজার পুনর্গঠন, ফিলিস্তিনি জনগণের ভবিষ্যৎ বা একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র তৈরি এবং এর বিকল্পগুলির মধ্যেকার সমঝোতা নিয়ে কথা বলেননি।
আসলে, তার ২০-দফা পরিকল্পনার বাস্তবায়ন নিয়ে প্রায় কোনো আলোচনা হয়নি, কেবল এইটুকু ছাড়া যে তিনি ধনী আরব রাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় সরকারগুলির সাথে একটি আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী গঠন বা বিধ্বস্ত অঞ্চলটির পুনর্গঠনে অর্থায়নের জন্য বৈঠক করছেন।
এই ক্ষেত্রে, ট্রাম্পের বক্তৃতার কিছু অংশ তার পররাষ্ট্রনীতির আরও একটি ঝলক দেখায়। তিনি বিভিন্ন দেশের সামরিক শক্তির প্রশংসা করেন, বিশেষ করে ইসরায়েলের, যার সম্পর্কে তিনি বলেন যে দেশটি 'আগের চেয়ে শক্তিশালী, আরও সম্মানিত' হয়ে উঠেছে। হামাস, হিজবুল্লাহ এবং ইরানের সাথে দুই বছরের সংঘাত নিঃসন্দেহে প্রমাণ করেছে যে ইসরায়েল এই অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী শক্তি।
তবে ট্রাম্প তার কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা নিয়ে আলোচনা করেননি, কারণ ইউরোপীয় শক্তিগুলি ইসরায়েলি হামলার ফলে সৃষ্ট বিশাল বেসামরিক হতাহতের কারণে একটি পৃথক ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ধারণাকে আলিঙ্গন করেছিল।
যথারীতি, ট্রাম্প যুক্তি দিয়েছিলেন যে দেশগুলি তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবে। যেমন আব্রাহাম চুক্তিগুলিতে যোগ দিলে বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য তো এমন জাতি, ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং সন্ত্রাসী সংগঠনে পূর্ণ যারা সমস্ত অর্থনৈতিক অগ্রগতি ঝুঁকির মধ্যে ফেলেও যুদ্ধে গেছে। রাশিয়াও ইউক্রেন আক্রমণ করে একই কাজ করেছে।
তবে কিছু ক্ষেত্রে প্রথার বাইরেও গেছেন ট্রাম্প। জোট গড়ে তোলার জন্য পরিচিত না হলেও, তিনি 'হামাসের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য একত্রিত হওয়া আরব ও মুসলিম বিশ্বের সকল জাতির' প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এই নতুন সহযোগিতার গতিকে কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়, সে বিষয়ে অবশ্য ট্রাম্প খুব কমই বলেছেন।

শান্তি সম্মেলন ও নেতানিয়াহুর অনুপস্থিতি
শার্ম আল-শেখে ট্রাম্প অবাক হয়ে দেখেন, এত তড়িঘড়ি করে আয়োজিত এই শীর্ষ সম্মেলন কত দ্রুত সম্পন্ন হয়েছে এবং কত মানুষ এতে অংশ নিয়েছেন। ২০টিরও বেশি দেশের নেতারা 'শান্তি ২০২৫' লেখা ব্যানারসজ্জিত মঞ্চে তার সাথে যোগ দিতে ছুটে এসেছিলেন।
ট্রাম্প বলেন, 'এই ব্যক্তিরা সবাই মাত্র ২০ মিনিটের নোটিশে এসেছেন।' শীর্ষ সম্মেলনের বেশিরভাগ জুড়েই ছিল ট্রাম্পের অন্য বিশ্বনেতাদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। মিশর, কাতার এবং তুরস্ক—এই তিন মধ্যস্থতাকারী দেশের নেতাদের সাথে একটি টেবিলে বসে ট্রাম্প একটি নথিতে স্বাক্ষর করেন। স্বাক্ষরের আগে ট্রাম্প বলেন যে এটি 'অনেক নিয়মকানুন এবং আরও অনেক কিছু বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করবে। এটি খুবই ব্যাপক।'
তবে আরব নেতারা নেতানিয়াহুর অঙ্গীকার নিয়ে বিশেষভাবে সতর্ক, যিনি এই সপ্তাহে ইসরায়েলিদের বলেছিলেন যে গাজায় সামরিক অভিযান 'শেষ হয়নি'। নেতানিয়াহু শান্তি সম্মেলনে যোগদানের জন্য শেষ মুহূর্তের পরিকল্পনা নিয়ে তাদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তোলেন। মিশরের প্রেসিডেন্সি দ্রুতই এই ইভেন্টের জন্য একটি বড় প্রতীকী মুহূর্তের ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এরপরই নেতানিয়াহু একটি ইহুদি ছুটির কথা উল্লেখ করে তার পরিকল্পনা বাতিল করায় তাদের ঘোষণাটি ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হতে হয়।