যৌন অপরাধী এপস্টিনের সঙ্গে ট্রাম্প, বিল ক্লিনটনসহ আরও হাইপ্রোফাইল ব্যক্তি: প্রকাশ্যে আরও নতুন ছবি
জেফ্রি এপস্টিনের ব্যক্তিগত এস্টেট বা বাড়ি থেকে নতুন কিছু ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। শুক্রবার মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের হাউস ওভারসাইট কমিটির ডেমোক্র্যাট সদস্যরা এই ছবিগুলো সবার সামনে আনেন। ছবিগুলোতে প্রয়াত ও কুখ্যাত যৌন পাচারকারী এপস্টিনের সঙ্গে বিশ্বের অনেক প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে দেখা গেছে।
এই তালিকায় আছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। আরও আছেন স্টিভ ব্যানন, বিল গেটস এবং রিচার্ড ব্র্যানসনের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা।অনেকের সঙ্গেই এপস্টিনের পরিচয়ের কথা আগে শোনা গিয়েছিল।
কিন্তু এই ছবিগুলো তাদের সম্পর্কের গভীরতা নতুন করে সামনে এনেছে। ডেমোক্র্যাটরা বলছেন, ছবিগুলো এপস্টিনের সম্পদ থেকেই পাওয়া গেছে। সব ছবি একসঙ্গে দেখলে বোঝা যায়, এই ধনাঢ্য ব্যক্তির সঙ্গে অতীতে বহু ক্ষমতাধর ও হাই-প্রোফাইল মানুষের যোগাযোগ ছিল। তাদের এই সম্পর্ক এখন কড়া নজরদারিতে রয়েছে।
কী আছে এসব ছবিতে?
প্রকাশিত একটি ছবিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ছয়জন নারীর সঙ্গে দেখা যাচ্ছে। নারীদের গলায় ফুলের মালা বা 'লেই' ছিল। তবে কমিটির সদস্যরা ওই নারীদের মুখ ঢেকে বা ঝাপসা করে দিয়েছেন।
আরেকটি অদ্ভুত ছবি পাওয়া গেছে। সেখানে একটি পাত্রে রাখা কনডমের মোড়কে ট্রাম্পের ব্যঙ্গচিত্র আঁকা। নিচে লেখা, 'আমি বিশাল!'। 'ট্রাম্প কনডম ৪.৫০ ডলার' লেখা সাইনবোর্ডসহ এই বাটিটি দেখা গেছে। নিউ ইয়র্কের 'ফিশস এডি' নামের এক উপহারের দোকান এই বিশেষ ধরণের কনডম বানিয়েছিল। আমেরিকার জাতীয় ইতিহাস জাদুঘরের অনলাইন সংগ্রহে এটিকে 'রাজনৈতিক কৌতুকধর্মী কনডম' হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
অন্যান্য ছবিতে দেখা গেছে স্টিভ ব্যানন ও এপস্টিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন। বিল ক্লিনটনকে দেখা গেছে এপস্টিন, তার সহযোগী ঘিসলাইন ম্যাক্সওয়েল এবং অন্য এক দম্পতির সঙ্গে। টেকনোলজি জগতের বিশাল নাম বিল গেটসকেও দেখা গেছে ব্রিটিশ রাজপরিবারের সাবেক প্রিন্স অ্যান্ড্রুর সঙ্গে। হার্ভার্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট ল্যারি সামার্স এবং আইনজীবী অ্যালান ডারশোভিটজও এই এস্টেটের ছবিতে ধরা পড়েছেন
ডেমোক্র্যাটরা প্রথমে ১৯টি ছবি প্রকাশ করেন। পরে শুক্রবার আরও ৭০টি ছবি সামনে আনেন। এর মধ্যে অনেক ছবি এপস্টিনের ব্যক্তিগত দ্বীপের বিভিন্ন কোণ থেকে তোলা। সেখানে একটি ঘরে ডেন্টিস্ট বা দাঁতের ডাক্তারের চেয়ার এবং দেয়ালে মুখোশ ঝোলানো দেখা গেছে।
অন্য ছবিগুলোতে খোদ এপস্টিনকে দেখা গেছে। একটি ছবিতে মৃত এই যৌন অপরাধী বাথটাবের ফেনার মধ্যে বসে আছেন। আরেকটিতে তার মুখের খুব কাছের ছবি বা ক্লোজ-আপ শট। আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, এপস্টিনের মতো দেখতে এক ব্যক্তি জেমস প্যাটারসনের লেখা 'ফিলদি রিচ' বইটি মুখের সামনে ধরে আছেন।
শুক্রবারের প্রকাশিত ছবির দ্বিতীয় লটে দেখা গেছে একটি খোদাই করা কুমড়ো, যার মাথায় পরচুলা। পাশে একটি পোস্টারে লেখা 'ট্রাম্পকিন: মেক হ্যালোউইন গ্রেট এগেইন'। এছাড়াও একটি 'জিএক্স-৯৯' মেসেজ থেরাপি মেশিনের ক্লোজ-আপ ছবিও পাওয়া গেছে।
তবে প্রকাশিত কোনো ছবিতেই যৌন অসদাচরণ বা অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো মেয়েকে দেখা যায়নি। ছবিগুলো কখন, কোথায় বা কে তুলেছে, তা তাৎক্ষণিকভাবে পরিষ্কার হওয়া যায়নি।
রাজনৈতিক কাদা ছোঁড়াছুড়ি
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র অ্যাবিগেল জ্যাকসন এক বিবৃতিতে এর কড়া জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেন, ডেমোক্র্যাটরা বেছে বেছে কিছু ছবি প্রকাশ করছে এবং ইচ্ছেমতো কিছু জায়গা ঢেকে দিয়ে মিথ্যা গল্প ফাঁদতে চাইছে।
তিনি পাল্টা অভিযোগ করেন যে, অনেক ডেমোক্র্যাট নেতার নামও এপস্টিনের নথিতে এসেছে। এদের মধ্যে আছেন হাউস মাইনরিটি লিডার হাকিম জেফরিস এবং ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধি স্টেসি প্লাস্কেট। প্লাস্কেট ২০১৯ সালে একটি শুনানির সময় এপস্টিনের সঙ্গে মেসেজ আদান-প্রদান করেছিলেন। ২০১৩ সালে এক ডেমোক্র্যাটিক পরামর্শক গ্রুপ এপস্টিনকে জেফরিসের সঙ্গে ডিনারে দাওয়াত দিয়েছিল, যদিও জেফরিস বলেছেন তার এমন কিছু মনে নেই।
জ্যাকসন আরও বলেন, 'প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ডেমোক্র্যাটদের এই ধাপ্পাবাজি বারবার মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। ডেমোক্র্যাটদের চেয়ে ট্রাম্প প্রশাসনই এপস্টিনের শিকারদের জন্য বেশি কাজ করেছে। তারা বারবার স্বচ্ছতার ডাক দিয়েছে, হাজার হাজার পাতার নথি প্রকাশ করেছে এবং এপস্টিনের ডেমোক্র্যাট বন্ধুদের বিরুদ্ধে আরও তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।'
রিপাবলিকানদের নেতৃত্বাধীন কমিটি চলমান তদন্তের অংশ হিসেবে এপস্টিনের এস্টেট থেকে এই ছবিগুলো পেয়েছে। প্যানেলটি এখন পর্যন্ত হাজার হাজার নথি, ইমেইল ও যোগাযোগ প্রকাশ করেছে, যা তদন্তের নতুন নতুন পথ খুলছে।
বৃহস্পতিবার এস্টেটের আইনজীবীরা কমিটিকে একটি চিঠি লেখেন। তারা জানান, ১৯৯০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ১০ আগস্ট পর্যন্ত এপস্টিনের মালিকানাধীন বা ব্যবহৃত সম্পত্তিতে তোলা ভিডিও ও ছবি তারা পর্যালোচনা করতে পারেন।
আইনজীবীরা লিখেছেন, 'গতকালের মতো আজও এমন কিছু নথি দেওয়া হয়েছে যা হয়তো প্রাসঙ্গিক নয়। এস্টেট নিশ্চিত হতে পারেনি যে এগুলো এপস্টিনের সম্পত্তিতেই তোলা কি না। এস্টেট ছবিগুলোতে খুব সামান্যই সম্পাদনা করেছে, শুধু নগ্নতা ঢাকতে এইটুকু করা হয়েছে।'
হাউস ওভারসাইট কমিটির শীর্ষ ডেমোক্র্যাট রবার্ট গার্সিয়া সাংবাদিকদের বলেন, প্রকাশিত ছবিগুলো 'গুরুত্বপূর্ণ'। তিনি জানান, প্যানেলের ডেমোক্র্যাট সদস্যরা তাদের হাতে আসা ৯৫,০০০ ছবির মাত্র চার ভাগের এক ভাগ এখন পর্যন্ত দেখতে পেরেছেন।
গার্সিয়া বলেন, 'আমার মনে হয় আমরা যা প্রকাশ করছি তা তাৎপর্যপূর্ণ। আমি মনে করি, মানুষ এই ছবিগুলো দেখে নিজেরাই বিচার করুক। আমাদের কাছে এটি স্বচ্ছতার বিষয়।'
এর আগে এক বিবৃতিতে গার্সিয়া বলেছিলেন, 'হোয়াইট হাউসের এই লুকোছাপা বন্ধ করার এবং জেফ্রি এপস্টিন ও তার ক্ষমতাধর বন্ধুদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া ভুক্তভোগীদের বিচার পাওয়ার সময় এসেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'এই বিরক্তিকর ছবিগুলো এপস্টিন ও বিশ্বের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সম্পর্ক নিয়ে আরও প্রশ্ন তুলছে। আমেরিকার মানুষ সত্য না জানা পর্যন্ত আমরা থামব না। বিচার বিভাগকে এখনই সব ফাইল প্রকাশ করতে হবে।'
কমিটির এক মুখপাত্র ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, তারা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মিথ্যা গল্প বানাতে বেছে বেছে ছবি প্রকাশ করছে। তিনি বলেন, 'আমরা ৯৫,০০০-এর বেশি ছবি পেয়েছি, আর ডেমোক্র্যাটরা মাত্র কয়েকটা প্রকাশ করল। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ডেমোক্র্যাটদের ধাপ্পাবাজি পুরোপুরি ফাঁস হয়ে গেছে। আমাদের পাওয়া নথিপত্রে কোনো অপরাধের প্রমাণ মেলেনি। ভুক্তভোগীদের বিচারের চেয়ে রাজনীতিকে বড় করে দেখাটা গার্সিয়া ও ডেমোক্র্যাটদের জন্য লজ্জাজনক।'
সিএনএন এ বিষয়ে ব্যানন, ক্লিনটন, গেটস, অ্যালেন, ব্র্যানসন, সামার্স, ডারশোভিটজ এবং মাউন্টব্যাটেন-উইন্ডসরের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ক্লিনটনের বিরুদ্ধে এপস্টিন সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ কখনো আনেনি। তার মুখপাত্র বারবার বলেছেন, ২০১৯ সালে ফেডারেল অভিযোগে এপস্টিন গ্রেপ্তারের আগেই ক্লিনটন সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন এবং তার অপরাধ সম্পর্কে জানতেন না।
বিল গেটসের এক মুখপাত্রও বারবার অস্বীকার করেছেন যে এপস্টিন কখনো গেটসের হয়ে কাজ করেছেন। গেটস নিজেও ২০২১ সালে সিএনএন-এর অ্যান্ডারসন কুপারকে বলেছিলেন, এপস্টিনের সঙ্গে দেখা করাটা তার জন্য 'বিশাল ভুল' ছিল এবং এতে এপস্টিন বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছিলেন।
এপস্টিনের সঙ্গে ট্রাম্পের পরিচয়ের কথা সবাই জানে। ম্যানহাটান এবং পাম বিচে তারা একই সামাজিক বৃত্তে চলাফেরা করতেন। তবে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধের অভিযোগ নেই। ট্রাম্প ও তার দল এর আগে এপস্টিনকে 'বাজে লোক' বলে অভিহিত করেছেন এবং দাবি করেছেন ট্রাম্প তাকে নিজের ক্লাব থেকে বের করে দিয়েছিলেন।
শুক্রবার ডেমোক্র্যাটদের প্রকাশিত ছবির তালিকায় যৌন খেলনার ছবিও ছিল। কমিটির প্রকাশিত সাম্প্রতিক কিছু ইমেইলে দেখা গেছে, এপস্টিন দাবি করেছিলেন যে ট্রাম্প তার অন্যতম প্রধান অভিযোগকারী ভার্জিনিয়া জুফারের সঙ্গে 'ঘণ্টার পর ঘণ্টা' কাটিয়েছেন। এপস্টিন একটি ইমেইলে লিখেছিলেন, ট্রাম্প 'মেয়েদের ব্যাপারে জানতেন'। এটি সম্ভবত ট্রাম্পের সেই দাবির প্রসঙ্গ, যেখানে তিনি বলেছিলেন যে তার ক্লাবে কর্মরত তরুণীদের উত্ত্যক্ত করার কারণে তিনি এপস্টিনকে মার-আ-লাগো থেকে বের করে দিয়েছিলেন।
ওই ইমেইলগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম্প ও হোয়াইট হাউস বিষয়টিকে 'ধাপ্পাবাজি' বলে উড়িয়ে দিয়েছে। প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট বলেছেন, এই ইমেইলগুলো প্রমাণ করে যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কোনো ভুল করেননি।
সিএনএন হাজার হাজার পাতার ইমেইল পর্যালোচনা করে দেখেছে, বছরের পর বছর ধরে এপস্টিন বারবার ট্রাম্পের নাম ব্যবহার করেছেন। কখনো তার আচরণের বিশ্লেষণ করতে, কখনো পরচর্চা করতে, আবার কখনো ট্রাম্পের সঙ্গে তার গভীর জানাশোনা আছে—এটা বোঝাতে।
এপস্টিনের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে অন্যদের পেশাগত মাশুল দিতে হয়েছে, যদিও তাদের বিরুদ্ধেও অপরাধের অভিযোগ ছিল না।
ল্যারি সামার্স হার্ভার্ডের শিক্ষকতা থেকে ছুটি নেন এবং ওপেনএআই-এর বোর্ড থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি বলেছেন, সম্পর্ক রাখার জন্য তিনি 'গভীরভাবে লজ্জিত' এবং এখন থেকে মানুষের বিশ্বাস অর্জনে কাজ করবেন। প্রিন্স অ্যান্ড্রু (অ্যান্ড্রু মাউন্টব্যাটেন-উইন্ডসর) তার রাজকীয় উপাধি ত্যাগ করেছেন, যদিও তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
এদিকে, গত মাসে কংগ্রেসের পাস করা এক আইন অনুযায়ী, আগামী ১৯ ডিসেম্বরের মধ্যে বিচার বিভাগকে তাদের কাছে থাকা এপস্টিন সংক্রান্ত সব ফাইল প্রকাশ করতে হবে।
রিপাবলিকান প্রতিনিধি থমাস ম্যাসি, যিনি রিপাবলিকান নেতৃত্বের বাধা এড়িয়ে এই আইনের জন্য চাপ দিয়েছিলেন, সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, আগামী সপ্তাহের সময়সীমা না মানলে বিচার বিভাগ অপরাধ করবে।
কেন্টাকির এই রিপাবলিকান নেতা বলেন, 'তারা যদি এটা না করে তবে তা অপরাধ হবে। এটা এমন নয় যে তারা শুধু কংগ্রেসের সমন উপেক্ষা করছে। এটি একটি নতুন আইন এবং এটি না মানলে শাস্তির বিধান আছে।'
তবে ম্যাসি জানিয়েছেন, আরও গ্র্যান্ড জুরি নথি বিচার বিভাগের কাছে যাওয়ায় তিনি আশাবাদী।
গার্সিয়া শুক্রবার আহ্বান জানিয়েছেন, সময়সীমার জন্য অপেক্ষা না করে প্রশাসনের উচিত এখনই সব প্রকাশ করা। তিনি উল্লেখ করেন, আরও অনেক ছবি আছে যা 'অত্যন্ত পীড়াদায়ক'।
তিনি বলেন, 'এই মুহূর্তে আমাদের পরিকল্পনা হলো প্রেসিডেন্টের কাছে ফাইল প্রকাশের দাবি জানানো। আমরা দেখব ১৯ তারিখে তিনি কী করেন। তবে আমি আবারও বলছি, কিছু ছবি সত্যিই খুব ভয়াবহ। আজ আমরা কিছু ছবি প্রকাশ করেছি, কিন্তু আরও অনেক ছবি আছে। যেগুলো আজ প্রকাশ করিনি, সেগুলো অত্যন্ত পীড়াদায়ক।'
