রাশিয়ার সঙ্গে সু-৩৫ যুদ্ধবিমান চুক্তি ইরানকে ডানা দিচ্ছে—কিন্তু সমর্থন নয়

পারমাণবিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল হামলা করে ইরানে, এই সংঘাত পরে বন্ধ হলেও— তেহরানের পরমাণু উচ্চকাঙ্খাকে ঘিরে উত্তেজনা চলমান রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটেই, রাশিয়া এখন ইরানকে উচ্চ সক্ষমতাসম্পন্ন যুদ্ধবিমান সরবরাহের পথে অগ্রসর হচ্ছে—যা মধ্যপ্রাচ্যের আকাশ শক্তির ভারসাম্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।
এই মাসে একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা কনগ্লোমারেট রোস্তেক এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান কনসার্ন রেডিও-ইলেকট্রনিক টেকনোলজিস (কেআরইটি) থেকে ফাঁস হওয়া নথি অনুযায়ী, ইরানের সঙ্গে প্রায় ৬.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এক বিশাল অস্ত্রচুক্তি চূড়ান্ত হয়েছে। এর আওতায় তেহরান রাশিয়া থেকে ৪৮টি সু-৩৫ মাল্টিরোল ফাইটার জেট কিনবে—যা ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর মস্কোর সবচেয়ে বড় রপ্তানি হতে পারে।
ইউক্রেনীয় হ্যাকারদের মাধ্যমে পাওয়া বলে দাবি করা ৩০০টিরও বেশি নথির মধ্যে দেখা গেছে, চালানের ক্রেতা কোড "৩৬৪" ইরানকে নির্দেশ করছে এবং ২০২৬ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে সরবরাহের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিটি বিমানে থাকবে খিবিনি-এম ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার পড ও ইরবিস-ই রাডার। ধারণা করা হচ্ছে, এসব বিমান যন্ত্রাংশ আকারে আমদানির পর ইসফাহানের শাহিদ বাবায়ী বিমান ঘাঁটিতে সংযোজন করা হবে।
এই চুক্তির মূল রয়েছে ২০২২ সাল থেকে রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে ড্রোন ও তেল বিনিময়ভিত্তিক বাণিজ্যে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) এক জেনারেলও এই সু-৩৫ চুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন।
এই ফাঁসের কয়েক সপ্তাহ আগেই রাশিয়া ইরানকে তুলনামূলক কম সক্ষমতার মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান সরবরাহ করেছে, যা স্বল্পমেয়াদে ইরানের আকাশ শক্তি বাড়িয়েছে। কিন্তু সু-৩৫ আসার পর তা ইরানেকে তার পুরনো এফ-১৪ ও এফ-৪ বিমানের পরিবর্তে দুইটি আধুনিক স্কোয়াড্রন গঠনের সামর্থ্য দেবে। একইসঙ্গে প্রথমবারের মতো দেশটির ভেতরে রুশ যুদ্ধবিমান সংযোজনের ব্যবস্থা তৈরি হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে—এই যুদ্ধবিমান চুক্তি কি ইরানের দুর্বল বিমান বাহিনীকে সত্যিকারের প্রতিরোধ গড়ার সক্ষমতা এনে দেবে, নাকি রাশিয়ার সক্ষমতা ও প্রতিশ্রুতির সীমাবদ্ধতার আরেকটি উদাহরণ হবে?
রাশিয়ার এই পদক্ষেপ এমন সময়ে এসেছে যখন তেহরানের বিমান প্রতিরক্ষা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সম্মিলিত আক্রমণের মুখে কার্যত ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। ফোর্বস-এর বিশ্লেষক পল ইডন এবছরের জুনে লেখেন, ইসরায়েলি বিমান হামলা ইরানের দুর্বল বিমান প্রতিরক্ষা কাঠামোকে নগ্ন করে দিয়েছে। ইসরায়েলের এফ-১৬ বিমান তেহরান থেকে মাত্র ৮০ কিলোমিটার দূরে পর্যন্ত প্রবেশ করলেও, ইরান কেবল একটি মিগ-২৯ উড়াতে পেরেছিল পাল্টা হামলার জন্য।
ইরানের পুরনো এফ-১৪ বিমানগুলোর অবস্থাও ভালো ছিল না; জুনের আক্রমণে ইসরায়েল বিমানঘাঁটিতে পার্ক করে রাখা দুটি এফ-১৪ ধ্বংস করে দেয়। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, ইরান মার্কিন বি-২ স্টেলথ বোমারু বিমানের আঘাত ঠেকাতে পারেনি, এসব বিমান থেকে ফর্দো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহান পারমাণবিক স্থাপনায় 'ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর' (এমওপি) বোমা ফেলা হয়।
ইনস্টিটিউট ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি-এর জুন ২০২৫ সালের বিশ্লেষণে ডেভিড অলব্রাইট লেখেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যৌথ হামলায় ইরানের ইউরেনিয়াম সেন্ট্রিফিউজ সমৃদ্ধকরণের ক্ষমতা প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে।
একইভাবে, সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (CSIS)-এর আগস্ট ২০২৫ সালের প্রতিবেদনে জোসেফ রজার্স উল্লেখ করেন, চীন, রাশিয়া বা উত্তর কোরিয়ার সহায়তা ছাড়া ইরান আগের পরিসরে তার পারমাণবিক কর্মসূচি পুনর্গঠন করতে পারবে না।
প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা
ইরানের যে পরিমাণ বিমানশক্তি দরকার, সে তুলনায় অর্ডার করা এসব বিমানের সংখ্যা কম। তবে সু-৩৫ তাত্ত্বিকভাবে ইরানকে আকাশে কিছুটা সুবিধা দিতে পারে। মিলিটারি ওয়াচ গত জুন মাসে এক প্রতিবেদনে জানায়, এই জেট ইসরায়েলের পুরনো এফ-১৫ ও এফ-১৬ বিমানের তুলনায় উন্নত, কারণ এগুলো এখনো "৪+ প্রজন্ম" মানে উন্নীত করা হয়নি।
ডিফেন্স সিকিউরিটি এশিয়া-এর মার্চ ২০২৫ রিপোর্ট অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় বিমানবাহিনীর মুখপাত্র ইউরি ইহনাত স্বীকার করেছেন যে, সু-৩৫ পুরনো মডেলের এফ-১৬-এর চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক, এর উন্নত অ্যাভিওনিক্স, রাডার এবং ১২টি আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র বহনক্ষমতার কারণে।
মিলিটারি ওয়াচ আরও উল্লেখ করে, ইসরায়েলের এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান যদিও স্টেলথ ক্ষমতাসম্পন্ন, তবুও সীমিত অস্ত্র বহনের কারণে সু-৩৫-এর তুলনায় "আন্ডার-আর্মড।" অন্যদিকে, সু-৩৫ এর রয়েছে তিনটি পরিপূরক সিস্টেম—ইরবিস-ই মুল রাডার, উইং-মাউন্টেড এসা রাডার এবং ওএলএস-৩৫ ইনফ্রারেড ট্র্যাকিং সিস্টেম—যা স্টেলথ বিমান শনাক্ত করার ক্ষমতা বাড়ায়।
এছাড়া, যদি ইরান এই বিমানগুলোতে আর-৩৭এম দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সংযোজন করতে পারে, তবে এটি ইসরায়েলি রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কার বিমানের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে, মূলত ট্যাঙ্কার বিমানই ইসরায়েলের মধ্যপ্রাচ্যের দূরতম লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
রাশিয়ার বাস্তবিক সীমাবদ্ধতা
তবে সুখই-৩৫ বা সু-৩৫ কোনো "অজেয়" যুদ্ধবিমান নয়। ন্যাশনাল সিকিউরিটি জার্নাল-এর আগস্ট ২০২৫ প্রতিবেদনে স্টিভ বেলেস্ট্রিয়ারি জানান, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া ৮টি সু-৩৫ হারিয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে; যদিও ইউক্রেনের দাবি অনুযায়ী এই সংখ্যা ২৫টি পর্যন্ত হতে পারে। রাশিয়ার হাতে ১১৪টি সু-৩৫ রয়েছে, ফলে সীমিত বহরের হিসাবে এটি মারাত্মক ক্ষতি।
ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার (আইএসডব্লিউ) -এর গত জুন মাসের প্রতিবেদনে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ক্রিস্টিনা হারওয়ার্ড বলেন, রাশিয়া তার সুখই উৎপাদন ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ বাড়াতে চাইলেও, বর্তমানে এক থেকে দুই মাসে সময়ে মাত্র একটি বিমানই তৈরি করতে পারছে।
একইসঙ্গে, রাশিয়ার ইউনাইটেড এয়ারক্রাফট কর্পোরেশনের ১,৫০০ ব্যবস্থাপক কর্মী ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা দেশটির উৎপাদন অগ্রাধিকারে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়—যেখানে যুদ্ধবিমান নয়, বরং ড্রোনের মতো সস্তা ও দ্রুত তৈরি করা যায় এমন যুদ্ধ সরঞ্জাম উৎপাদনে বেশি জোর দিচ্ছে মস্কো।
হাওয়ার্ড আরও বলেন, রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও প্রতিরক্ষা শিল্পে দক্ষ শ্রমিক সংকট রাশিয়ার যুদ্ধবিমান উৎপাদন প্রক্রিয়াকে আরও ধীর করবে।
এমতাবস্থায় মিডল ইস্ট কাউন্সিল ফর গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স-এর জুন ২০২৫ প্রতিবেদনে হামিদরেজা আজিজি লিখেছেন, রাশিয়া ইরানের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতায় নির্বাচনমূলক ও সতর্ক অবস্থান নিয়েছে—যাতে ইসরায়েল বা উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে মস্কোর সম্পর্ক নষ্ট না হয়।
তিনি বলেন, রাশিয়া স্পষ্টতই ইরানের আঞ্চলিক সংঘাতে, বিশেষ করে ইসরায়েলবিরোধী লড়াইয়ে, সরাসরি জড়াতে অনিচ্ছুক। এর পরিবর্তে মস্কো গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি) দেশগুলোর সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়।
সুতরাং, রাশিয়ার এই সু-৩৫ যুদ্ধবিমান চুক্তি ইরানের বিমানবাহিনীকে পুনরুজ্জীবিত করবে, নাকি শুধু শক্তির এক মরীচিকা তৈরি করবে—তা নির্ভর করবে মস্কো কতদূর পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারে তার ওপর। বলা যায়, রাশিয়া ইরানকে ডানা দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেই ডানা উড়বে কিনা—তা এখনো প্রশ্নসাপেক্ষ।