দেশে বাড়ছে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, চিকিৎসা সেবা অপ্রতুল

দ্রুত নগরায়ণ, জীবনযাত্রার পরিবর্তন ও সামাজিক চাপের কারণে দেশে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। অথচ চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ এখনও অত্যন্ত সীমিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক (স্বাস্থ্য অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা) ড. রুমানা হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস)-বলেন, 'জাতীয় জরিপ অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মানসিক রোগের হার ২০০১ সালে ছিল ১২ শতাংশ, ২০০৫ সালে ১৬ দশমিক ১ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ শতাংশে।'
তিনি বলেন, 'এই ধারাবাহিক বৃদ্ধি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে, সময়ের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা কতটা বেড়েছে।'
ড. রুমানা জানান, দ্রুত নগরায়ণ, অভিবাসন, জীবনযাত্রার পরিবর্তন, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, দীর্ঘস্থায়ী রোগ, দারিদ্র্য ও জলবায়ুজনিত চাপ—সব মিলিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়ছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, দেশে যে ১০টি মানসিক রোগ সবচেয়ে বেশি চিকিৎসা দেওয়া হয়, সেগুলো হলো—স্কিজোফ্রেনিয়া, ম্যানিয়া-ডিপ্রেসিভ সাইকোসিস, উদ্বেগজনিত সমস্যা, মাদকাসক্তি, বুদ্ধিবিকাশজনিত প্রতিবন্ধকতা, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (ওসিডি), মৃগী, ডিমেনশিয়া, পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার ও কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার। এর মধ্যে প্রায় ৭৪ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রেই স্কিজোফ্রেনিয়া ও ম্যানিয়া-ডিপ্রেসিভ সাইকোসিস পাওয়া যায়।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, সামগ্রিকভাবে মানসিক রোগের হার স্থিতিশীল থাকলেও বিষণ্নতা ও আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েছে।
তিনি বলেন, 'কারণগুলো জটিল। সমাজ যত অগ্রসর হচ্ছে, মানুষের জীবনে তত জটিলতা, উদ্বেগ ও মানসিক চাপ বাড়ছে।'
তিনি জানান, বৈশ্বিক সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চাপ ও দীর্ঘায়ুর কারণে বাড়তে থাকা দীর্ঘস্থায়ী রোগ—সবই মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে।
তিনি আরও বলেন,'রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো দূরের সংঘাতও আমাদের অর্থনীতি ও মানসিকতায় প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তন, তাপদাহ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগও বিষণ্নতার হার বাড়াচ্ছে।'
চিকিৎসা সেবায় বড় ঘাটতি
২০২৫ সালের ৮ আগস্ট বিএমসি সাইকিয়াট্রি জার্নালে প্রকাশিত 'বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ধরণ: নির্ধারক ও চিকিৎসা ঘাটতি'- শীর্ষক গবেষণায় দেখা যায়, দেশে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগা প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা নেন না বা পান না।
গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এখনও খুব কম ব্যবহৃত হয় এবং নীতিনির্ধারকদের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ প্রয়োজন।
গবেষণায় আরও জানা যায়, কোনো পরিবারে একজন মানসিক রোগী থাকলে অন্য সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৬ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ে। অর্থাৎ, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা পরিবারকে উদ্যোগী করে তোলে।
গবেষণার প্রধান লেখক ড. রুমানা বলেন, 'বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা বাড়লেও পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও প্রশিক্ষিত জনবল নেই। প্রায় ৯০ শতাংশ মানসিক রোগী চিকিৎসাবঞ্চিত। দেশে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, মনোবিজ্ঞানী ও কাউন্সেলরের সংখ্যা খুবই কম। পাশাপাশি জাতীয় বাজেটে মানসিক স্বাস্থ্যের বরাদ্দও অত্যন্ত কম।'
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য নীতিমালা অনুযায়ী, দেশের মোট স্বাস্থ্য বাজেটের মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় হয়।
অবকাঠামো ও জনবল সংকট
দেশে প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন মাত্র শূন্য দশমিক ১৩ জন, অন্যান্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক শূন্য দশমিক ০১ জন, মানসিক রোগ চিকিৎসায় প্রশিক্ষিত নার্স শূন্য দশমিক ৮৭ জন এবং মনোবিজ্ঞানী বা অনুরূপ পেশাজীবী মাত্র শূন্য দশমিক ১২ জন।
ঢাকার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ৪০০ বেডের ইনডোর ও আউটডোর সেবা রয়েছে। রাজধানীর বাইরে একমাত্র পূর্ণাঙ্গ মানসিক হাসপাতাল পাবনা মানসিক হাসপাতালে রয়েছে ৫০০ বেড। এছাড়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ কিছু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও মনোরোগ চিকিৎসা দেওয়া হয়।
বর্তমানে দেশে প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য মানসিক রোগীদের জন্য হাসপাতালের বেড সংখ্যা মাত্র শূন্য দশমিক ৪। ডে-কেয়ার বা আউটডোর থেরাপি সুবিধা প্রায় নেই বললেই চলে।
চিকিৎসা ঘাটতি কমাতে আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের আহ্বান জানিয়ে ড. রুমানা বলেন, 'স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি শিক্ষা, ক্রীড়া, নারী ও শিশু ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে সুস্থ জীবনযাপন ও মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে তরুণ ও নারীদের জন্য পার্ক, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ বাড়াতে হবে।'
ড. হেলাল বলেন, 'প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় মানসিক স্বাস্থ্যকে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। এজন্য মেডিকেল পাঠ্যক্রমে মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা যুক্ত করতে হবে এবং প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসকদের এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এটি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য নীতি ও কর্মপরিকল্পনার অংশ।'
তিনি আরও বলেন, 'শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পরিবারে সংগীত, খেলাধুলা ও সৃজনশীল কার্যক্রমের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন করতে হবে। চিকিৎসার পাশাপাশি এসব কার্যক্রম উৎসাহিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।'
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগ বাড়ানো ও জনসচেতনতা তৈরিতে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য—'সেবা পাওয়ার সুযোগ: দুর্যোগ ও জরুরি অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্য।'