টানা বৃষ্টিতে পিছিয়ে যাচ্ছে আগাম শীতকালীন সবজির আবাদ, আমন ধান চাষে সুবিধা

দেশজুড়ে টানা বৃষ্টিপাতের কারণে আগাম শীতকালীন সবজির চাষাবাদে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। কৃষি বিশেষজ্ঞ ও কৃষকদের মতে, অনেকেই এখন বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় আছেন, যাতে চাষ শুরু করতে পারেন।
অন্যদিকে, এ বৃষ্টি আশীর্বাদ হয়ে এসেছে আমন চাষীদের জন্য। এতে সার ও সেচের প্রয়োজন অনেকটা কমে গেছে।
অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের প্রবণতা
সাধারণত বর্ষা মৌসুমের শেষ দিকে, অর্থাৎ ১৫ অক্টোবরের মধ্যেই বৃষ্টিপাত কমে আসে এবং মৌসুম শেষ হয়। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বর্ষার শেষভাগে বৃষ্টিপাত বরং বেড়ে যাচ্ছে—যা জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হিসেবে দেখছেন। এবারে অক্টোবরের প্রথম ৯ দিনেই পুরো মাসের স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ও জলবায়ু পরিবর্তন গবেষক মো. বজলুর রশিদ বলেন, 'কয়েক বছর আগেও দেশে বর্ষা শুরু হওয়ার পর জুন মাসে স্বাভাবিক বা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হতো, আর মৌসুমের শেষ দিকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যেত।'
তিনি বলেন, 'কিন্তু গত ৮–১০ বছরে দেশের বৃষ্টিপাতের ধরণ পাল্টে গেছে। বর্ষার শেষভাগে এখন বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। এবারে আবার ব্যতিক্রম ঘটেছে—পুরো মৌসুম জুড়ে নিয়মিত বৃষ্টিপাত হয়েছে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি।'
তিনি আরও বলেন, 'অক্টোবরের মাঝামাঝিতে মুনসুন বিদায় নেবে। তবে ৯ তারিখ পর্যন্ত যতটা বৃষ্টি হয়েছে, তা প্রায় পুরো মাসের স্বাভাবিক বৃষ্টির সমান। যদিও এবারে স্বল্প সময়ে ভারি বৃষ্টির ঘটনা কম, কিন্তু থেমে থেমে বৃষ্টি পুরো মৌসুমজুড়ে চলেছে। এতে মৌসুমের শেষ দিকে আগাম শীতকালীন ফসল বপনকারীরা ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কায় আছেন।'
বজলুর রশিদ জানান, এবারের বর্ষায় ঢাকাসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে। তবে উত্তরাঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় এবার কোনো বন্যার পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবারের বর্ষায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দিন বৃষ্টি হয়েছে। ফলে রাস্তাঘাট ও আগাম শীতকালীন ফসলের ক্ষতি হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে বৃষ্টি স্বাভাবিকের চেয়ে কম হলেও জুলাই ও আগস্টে বৃষ্টিপাত ছিল বেশি। জুলাই মাসে প্রায় ২৪ শতাংশ বেশি এবং ঢাকায় ৪৫ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
আগামী ২–৩ দিনের মধ্যে বৃষ্টিপাত কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে মাসের শেষের দিকে সাগরে একটি নিম্নচাপ তৈরি হতে পারে, যা নভেম্বর পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের সময় বাড়াতে পারে।
শীতকালীন সবজির ওপর প্রভাব
কৃষি মৌসুমগুলোর মধ্যে ১৬ জুলাই থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত খরিপ–২ মৌসুম হিসেবে ধরা হয়, আর রবি মৌসুম শুরু হয় ১৬ অক্টোবর থেকে। কৃষকরা সাধারণত ভালো দাম পাওয়ার আশায় আগাম শীতকালীন সবজির আবাদ শুরু করেন। কিন্তু টানা বৃষ্টিপাতের কারণে এবার সেই বপন বিলম্বিত হয়েছে।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বেনীপুর এলাকার কৃষক মাজহারুল ইসলাম বলেন, 'টানা বৃষ্টির কারণে এবার আগাম ফুলকপি লাগাতে পারিনি। বীজতলা তৈরি না করতে পারায় গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজও রোপণ করা যায়নি। এছাড়া বৃষ্টির কারণে ফসলের রোগবালাইও বেড়ে যাচ্ছে।'
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, 'বৃষ্টির কারণে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ রোপণে সমস্যা হচ্ছে। আরও বৃষ্টি হলে রবি মৌসুমের ফসল চাষেও প্রভাব পড়বে।'
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার মোকামতলা এলাকার ২০ শতক জমিতে এবার আগাম সবজির চাষ করেছেন শাকিল আহমেদ। তিনি বলেন, 'বৃষ্টিতে বড় কোনো ক্ষতি হয়নি, তবে নিড়ানি দিতে পারছি না, তাই চারা ভালোভাবে বাড়ছে না। এখন যদি রোদ ওঠে, গাছগুলো সেরে উঠবে। তবে আরও কয়েক দিন বৃষ্টি চললে চারা নষ্ট হতে পারে।'
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক মো. ওবায়দুর রহমান মণ্ডল বলেন, 'ফসলের ক্ষতি তেমন হয়নি। কারণ বৃষ্টি থামার পর পানি নেমে যাচ্ছে। তবে শীতকালীন সবজি চাষ বিলম্বিত হচ্ছে। এ জন্য কৃষকদের নানা দিকনির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।'
শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহমেদ বলেন, দীর্ঘস্থায়ী বৃষ্টিপাতের কারণে কৃষকরা এখনো পুরোপুরি আগাম শীতকালীন সবজির আবাদ করতে পারছেন না।
তিনি আরও বলেন, 'কিছু জায়গায় ফসল লাগানো হয়েছে, আবার কোথাও কোথাও নষ্টও হয়েছে। বৃষ্টি থেমে গেলে কৃষকরা আবার পুরোদমে চাষাবাদ শুরু করবেন। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আধুনিক কৃষিপদ্ধতি গ্রহণ করতেই হবে।'
বৃষ্টিপাতের ফলে লাভবান হচ্ছে আমন ধান
অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহেও টানা বৃষ্টিপাত আমন চাষীদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।
নওগাঁর মান্দা উপজেলার কৃষক ইয়াসিন আলী টিবিএসকে বলেন, 'এবার বৃষ্টি বেশি হওয়ায় ধানে সার কম লেগেছে, আর ফলনও ভালো হবে বলে আশা করছি।'
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ বছর ৫৯ লাখ ৫৭৪ হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৯ লাখ ২৮০ হেক্টরে ইতোমধ্যে আবাদ সম্পন্ন হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ কোটি ৮১ লাখ টন চালের।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন টিবিএসের বগুড়া, খুলনা, রাজশাহী ও বরিশাল প্রতিনিধি।