আমনের বাম্পার ফলন: পাইকারিতে কমলেও খুচরা বাজারে কমেনি চালের দাম
বাজারে নতুন আমন ধান ওঠায় রাজধানীর পাইকারি বাজারে মোটা ও মাঝারি চালের দাম কিছুটা কমেছে। তবে রেকর্ড উৎপাদনের আশা সত্ত্বেও খুচরা বাজারে দাম অপরিবর্তিত রয়েছে এবং চিকন চাল আগের মতোই চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর পাইকারি বাজারগুলোতে মোটা স্বর্ণা চাল বর্তমানে ৪৯-৫০ টাকা এবং মাঝারি মানের পাইজাম ও বিআর-২৮ চাল ৫০-৫২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এর বিপরীতে সরু বা চিকন চালের দাম এখনো চড়া—মানভেদে মিনিকেট ৭৮-৮০ টাকা এবং নাজিরশাইল ৭৫-৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পোলাও চালের দাম। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে সুগন্ধি এই চালের দাম কেজিতে ৬ থেকে ১০ টাকা বেড়ে ১২০-১৩০ টাকায় ঠেকেছে। ব্যবসায়ীরা জানান, এ মৌসুমে সুগন্ধি ও চিকন ধানের উৎপাদন কম হওয়ার অজুহাতে গত দুই-তিন মাসে এর দাম কেজিতে ২০-২৫ টাকা বেড়েছে।
ঢাকার কারওয়ান বাজারের পাইকারি চাল বিক্রেতা মোহাম্মদ শাওন বলেন, 'আমন ধান ওঠায় মোটা চালের দাম কিছুটা কমেছে। তবে উৎপাদন কম হওয়ায় আতপ ও পোলাও চালের দাম কয়েকমাস ধরেই চড়া।'
পাইকারি বাজারে দাম কমলেও খুচরা বাজারে এখনো এর প্রভাব পড়েনি। ঢাকার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, স্বর্ণা চাল ৫৪-৬০ টাকা, বিআর-২৮ ও পাইজাম ৫৮-৬৮ টাকা এবং চিকন চাল ৭০-৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে—যা গত মাসের তুলনায় প্রায় অপরিবর্তিত। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, নতুন চাল এখনো পুরোপুরি দোকানে আসেনি; এক সপ্তাহের মধ্যে দাম সমন্বয় হবে।
রাজধানীর শাহজাদপুরের খুচরা ব্যবসায়ী মো. আলাউদ্দিন বলেন, 'দোকানগুলোতে এখনো নতুন চাল পুরোপুরি আসেনি। তাই আগের দামেই চাল বিক্রি করতে হচ্ছে। পাইকারিতে দাম কমলে খুচরা বাজারেও দাম কমবে।'
এদিকে মিল পর্যায়েও চালের দাম কিছুটা কমতে শুরু করেছে। দেশের অন্যতম বড় চালের মোকাম নওগাঁর আড়তদারপট্টীতে স্বর্ণা-৫ জাতের চালের দাম কেজিতে অন্তত ৩ টাকা কমেছে। তবে গত বোরো মৌসুমের জিরাশাইল ও শম্পা কাটারিভোগ চালের দাম তিন মাস ধরে যথাক্রমে ৬৬-৬৮ টাকা ও ৬৮-৭২ টাকায় স্থিতিশীল রয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বাজার কিছুটা পড়ার কারণ হিসেবে গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত চলা সরকারিভাবে অনুমোদিত চাল আমদানিকে চিহ্নিত করেছেন। এর ফলে সরবরাহ বাড়ায় স্থানীয় বাজারে দামে নিম্নমুখী চাপ তৈরি হয়েছিল। আমন চাষিরা শুরুতে ক্ষতির মুখে পড়লেও ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানি বন্ধ হওয়ার পর ধানের দাম কিছুটা বাড়তে শুরু করেছে।
কৃষি কর্মকর্তারা আশা করছেন, চলতি বছর আমন চালের উৎপাদন ১ কোটি ৮১ লাখ ৭৫ হাজার টনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্যমতে, এবার ৫৯ লাখ ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৫১ লাখ ৬৮ হাজার হেক্টর জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে, যেখানে হেক্টরপ্রতি গড়ে ৩.১১ টন হিসেবে প্রায় ১ কোটি ৬১ লাখ টন ফলন পাওয়া গেছে।
ডিএইর ফিল্ড উইংয়ের পরিচালক মো. ওবাদুর রহমান মন্ডল বলেন, 'এ বছর আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতি কম হওয়ায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।'
চালের দাম চড়া থাকলেও কৃষকরা ধানের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন। নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার কৃষক রেজাউল ইসলাম জানান, প্রতি মণ ধানে তার উৎপাদন খরচ ৮৫০ টাকা, অথচ তিনি সর্বোচ্চ ১,২৬০ টাকায় ধান বিক্রি করছেন।
তিনি বলেন, 'এত পরিশ্রমের পর মণপ্রতি মাত্র ৪১০ টাকা লাভ দিয়ে বর্তমান জীবনযাত্রার ব্যয় মেটানো কঠিন।' দাম না বাড়লে ভবিষ্যতে চাষাবাদ ছেড়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেন তিনি।
একই জেলার রানীনগরের আরেক কৃষক শামসের আলী জানান, ধান বিক্রির টাকা দিয়ে ঋণ শোধ করার পর তার হাতে আর কিছুই থাকে না।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, 'প্রায় দুই বছর ধরে চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেশি, অথচ কৃষকরা ধানের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।'
তিনি অভিযোগ করে বলেন, 'বড় মিল মালিকরা সস্তায় ধান কিনে চড়া দামে চাল বিক্রি করে ফায়দা লুটছেন, আর সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে।'
পোলাও চালের বর্তমান দাম বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতা নেই বলেও মন্তব্য করেন নাজের হোসাইন।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন টিবিএসের বগুড়া প্রতিনিধি খোরশেদ আলম]
