বিচারক স্বল্পতা, তদন্তে ধীরগতি: চট্টগ্রাম আদালতে মামলার সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২.৯০ লাখ

চট্টগ্রামের ৮১টি আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ২ লাখ ৯০ হাজার ৫২৩। বিচারক স্বল্পতা, মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে বিলম্ব, সাক্ষ্যগ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা এবং বারবার মুলতবি দেওয়ার কারণে মামলার নিষ্পত্তি দীর্ঘ হচ্ছে। এসব আদালতে প্রতিদিন নতুন করে যুক্ত হচ্ছে প্রায় ৩০০ মামলা।
২০২৩ সালের ২৮ আগস্ট আইন কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে গড়ে প্রতি ৯৪ হাজার ৪৪৪ জন মানুষের জন্য মাত্র একজন বিচারক রয়েছেন। এই সংখ্যা ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় অনেক কম। ভারতে গড়ে প্রতি ৪৭ হাজার, পাকিস্তানে ৫০ হাজার, যুক্তরাষ্ট্রে ১০ হাজার এবং যুক্তরাজ্যে মাত্র ৩ হাজার মানুষের জন্য একজন বিচারক রয়েছেন। বাংলাদেশে বিচারক স্বল্পতার কারণে প্রতিনিয়ত মামলার জট বাড়ছে।
চট্টগ্রামের আদালতগুলোতে দেওয়ানি মামলার সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার ৮১২টি। জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রয়েছে আরও ২০ হাজার ৫৪৪টি মামলা। চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অধীনে থাকা ৮টি আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৬৪ হাজার ৪৭৮টি। অন্যদিকে, চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের মোট ১৩টি আদালতে ঝুলে আছে প্রায় ৩৭ হাজার মামলা। এছাড়া, ৭টি যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতে রয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার মামলা এবং ৭টি অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে রয়েছে প্রায় ১০ হাজার মামলা। গড়ে প্রতিটি আদালতে মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৫৮৬।
প্রতিদিন প্রতিটি আদালত ৫টি করে মামলা নিষ্পত্তি করলেও এইসব মামলার পুরো নিষ্পত্তি করতে সময় লাগবে প্রায় আড়াই বছর।
তবে সব আদালতে মামলার সংখ্যা সমান নয়। উদাহরণস্বরূপ, বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৬৭৭টি, দেউলিয়া বিষয়ক আদালতে প্রায় ১১০০টি, পরিবেশ আদালতে ১৩১১টি, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে ৫০৬টি এবং মানবপাচার ট্রাইব্যুনালে রয়েছে ১৯৫টি মামলা। সেই বিবেচনায়, অধিক মামলার চাপ রয়েছে এমন আদালতের সংখ্যা বাড়ানোর দাবি জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
আরও আদালতের দাবিতে আইনজীবীরা
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী মোহাম্মদ রিদুয়ান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বর্তমানে সীমিত সংখ্যক বিচারককে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক মামলা পরিচালনা করতে হচ্ছে। নতুন মামলা যে হারে দায়ের হচ্ছে, সে হারে নিষ্পত্তি না হওয়ায় মামলার সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।"
তিনি আরও বলেন, "ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে সমস্যা আরও প্রকট। মামলার তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অনেক সময় পুলিশ রিপোর্ট দাখিলে দীর্ঘসূত্রতা করেন। ফলে বিচারিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগেই মামলাটি বছরের পর বছর ঝুলে থাকে।"
"এছাড়া মামলার পক্ষগণের অনুপস্থিতি, সময় চাওয়া কিংবা সাক্ষীদের অনুপস্থিতি—সব মিলিয়ে মামলার অগ্রগতি থমকে যায়। এর ফলে সময়মতো বিচার সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না, যা মামলার জটকে আরও জটিল করে তোলে," যোগ করেন তিনি।
গত এক সপ্তাহের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে গড়ে প্রতিদিন ২৮টি মামলার বিচার কার্য অনুষ্ঠিত হয়, যার মধ্যে রায় হয় গড়ে দুটি মামলায়। অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রতিদিন গড়ে ২৬টি মামলার বিচার হয় এবং রায় হয় মাত্র একটি মামলায়।
সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ১ম আদালতে গড়ে প্রতিদিন ২০টি মামলার বিচার কার্য সম্পন্ন হয়, এর মধ্যে রায় হয় একটি মামলায়। যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ ১ম আদালতে গড়ে প্রতিদিন ২৮টি মামলার বিচার কার্য অনুষ্ঠিত হলেও কোনো মামলার রায় হয়নি। অন্যদিকে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রতিদিন গড়ে ৩৯টি মামলার বিচার হয়, যার মধ্যে রায় হয় গড়ে দুটি মামলায়।
আইনজীবী সমিতির মতে, মহানগর এলাকায় ১৫টি থানা থাকায় প্রতিটি থানার জন্য অন্তত একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠিও পাঠিয়েছে।
মামলার দীর্ঘসূত্রতায় ভোগান্তি বিচারপ্রার্থীদের
মামলার দীর্ঘসূত্রতা সাধারণ মানুষের জীবনে নানামুখী ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি মামলা নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর লেগে যাওয়ায় আর্থিক, সামাজিক ও পেশাগত জীবনে ক্ষতির মুখে পড়ছেন ভুক্তভোগীরা।
বিচারপ্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মামলা চলাকালীন সময়ে একাধিকবার আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে অনেককে চাকরি বা পেশাগত কাজ থেকে ছুটি নিতে হয়। এতে আর্থিক চাপের পাশাপাশি সময়ও নষ্ট হচ্ছে।
অনেক সময় চলমান মামলার কারণে বিদেশযাত্রায় জটিলতা তৈরি হয়। মামলার তথ্য পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্টে উঠে এলে ভিসা পেতে সমস্যায় পড়েন অনেকে। আবার মামলার বিষয়টি সামাজিকভাবে জানাজানি হলে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার আশঙ্কাও তৈরি হয়, যা পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি করে।
বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল। কোনো মামলায় নাম আসার কারণে কেউ চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়েন, আবার কেউ পদোন্নতির ক্ষেত্রে পিছিয়ে যান। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুত বিচার না হলে এই ভোগান্তি কমবে না।
২০১৬ সালে মাদক মামলার আসামি হওয়া মো. রমজান আলী বলেন, "২০১৬ সালে পুলিশের করা এক মামলায় আমাকে ১০ বছর ধরে কোর্টের ধারে ধারে ঘুরতে হয়েছে। বহু বছর জেল খেটেছি। সাক্ষীর অনুপস্থিতির কারণে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে ঝুলে ছিল মামলাটি। কিন্তু আমি এই ১০ বছরে একবারও কোর্টে হাজিরা বাদ দিইনি। অবশেষে গত ৫ জুন আদালত আমাকে মামলা থেকে খালাস দিয়েছেন। এই ১০ বছরে আমার এত অর্থ ও সময় ব্যয় হয়েছে—এর মাশুল কে দেবে?"
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট আবদুস সাত্তার টিবিএসকে বলেন, "মামলাজটের পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম হলো বিচারকের স্বল্পতা। যত মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি মামলা নতুন করে দায়ের হচ্ছে। এছাড়া, পুলিশের তদন্তে সময়ক্ষেপণ এবং সাক্ষীদের যথাসময়ে আদালতে হাজির না করাও মামলাজট বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। এই সমস্যাগুলো সমাধান করা গেলে মামলাজট কমে আসবে।"
জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. আশরাফ হোসেন চৌধুরী (রাজ্জাক) টিবিএসকে বলেন, "আদালতের অপ্রতুলতা দূর এবং এর পরিধি বৃদ্ধি করা গেলে মামলাজট নিরসন অনেকটাই সম্ভব। এজন্য নতুন করে আদালত ভবন নির্মাণের প্রয়োজন রয়েছে।"
"তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে জায়গার অভাব একটি বড় সমস্যা। যেহেতু জায়গাটি জেলা প্রশাসনের অধীনে, তাই সরকারিভাবে আলোচনা করে যদি নতুন জায়গা পাওয়া যায়, সেখানে নতুন ভবন নির্মাণের মাধ্যমে আদালতের পরিধি বাড়ানো সম্ভব হবে। তখন মামলার জট অনেকাংশে কমে আসবে," যোগ করেন তিনি।