যুক্তরাষ্ট্র-ইইউ বাণিজ্য চুক্তিতে কারা লাভবান, কারা ক্ষতিগ্রস্ত?

গত মাসে স্কটল্যান্ডে আলোচনায় বসার পর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য চুক্তি করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। শুরুতে শুধু চুক্তির কাঠামো শুরুতে প্রকাশ করা হলেও, এখন বিস্তারিত প্রকাশ করা হচ্ছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইইউ প্রধান উরসুলা ভন ডার লেনের ঘোষণায় উঠে এসেছে—এই চুক্তিতে কোন খাতগুলো লাভবান হবে, আর কারা ক্ষতির মুখে পড়বে।
নতুন বাণিজ্য চুক্তির প্রতিশ্রুতির পর ট্রাম্প এটিকে সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে তুলে ধরেছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, এতে ইইউ তুলনামূলক বেশি ছাড় দিয়েছে।
কেপিটাল ইকোনমিকসের তাৎক্ষণিক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ইউরোপীয় অর্থনীতির মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ০.৫% হ্রাস ঘটতে পারে।
এছাড়াও, আমদানি শুল্কের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের কোষাগারে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢুকবে।
তবে এই সাফল্য বেশিদিন স্থায়ী না-ও হতে পারে। কারণ সমালোচকরা সাম্প্রতিক মুদ্রাস্ফীতি, কর্মসংস্থান ও ভোক্তা আস্থার তথ্যকে ট্রাম্পের অর্থনৈতিক নীতির ব্যর্থতা হিসেবে মনে করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ ইতোমধ্যেই জীবন-যাপনের ব্যয় বৃদ্ধিতে ক্ষুব্ধ। এই চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্রে ইউরোপীয় পণ্যের দাম আরও বাড়বে।
সাধারণত পণ্যের মূল্যের ওপর নির্ধারিত হার অনুসারে শুল্ক আরোপিত হয়। এতে আমদানিকারকের খরচ বাড়ে এবং সবশেষে সে খরচ ভোক্তাদের ওপর চাপানো হয়।
চুক্তির ঘোষণা প্রকাশের পর এশিয়া ও ইউরোপের শেয়ারবাজার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের কাছে এটি একটি স্থিতিশীল বার্তা দিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ান ব্রোকার ক্রিস ওয়েস্টন বলেছেন, 'এই চুক্তি বাজারবান্ধব এবং ইউরোর মূল্য আরও বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি করবে।'
তবে এই চুক্তি কার্যকর করতে ইইউ-র ২৭টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রত্যেকটির অনুমোদন লাগবে।
সদস্যদের নিজেদের বিভিন্ন স্বার্থ ও অবস্থানের ভিন্নতা থাকায় কিছু সদস্য দেশ এই চুক্তিকে সতর্কভাবে স্বাগত জানাচ্ছে, কিছু দেশ আবার এর সমালোচনা করেছে।
যেমন ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ফ্রঁসোয়া বাইরু মন্তব্য করেন, 'এটি এক অন্ধকারময় সময়, যখন অভিন্ন মূল্যবোধ ও স্বার্থ রক্ষায় একত্র হওয়া স্বাধীন মানুষের একটি জোট আত্মসমর্পণের পথে হাঁটে।'
তার সঙ্গে একমত হন ফ্রান্স সরকারের আরও দুই মন্ত্রী এবং হাঙ্গেরির নেতা ভিক্টর অরবান।
ভিক্টর অরবান বলেন, 'ট্রাম্প উরসুলাকে সকালের নাশতায়ই খেয়ে ফেলেছেন।'
জার্মান গাড়ি নির্মাতারা এই চুক্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ইইউ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে গাড়ি আমদানির শুল্ক ২৭.৫% থেকে কমিয়ে ১৫% করা হলেও, জার্মান গাড়ি শিল্পের সংগঠন ভিডিএ বলেছে, শুল্কের এই হারের ফলে প্রতিবছর শিল্পটিকে কয়েক বিলিয়ন ইউরো ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে।
গাড়ি ইইউ-র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্যের একটি। ভক্সওয়াগেন, মার্সিডিজ ও বিএমডব্লিউ-এর জন্য জার্মানি ইইউ-র সবচেয়ে বড় গাড়ি উৎপাদনকারী দেশ। তাই দেশটি এই চুক্তির প্রতিটি দিক গভীর নজরে রেখেছে।
জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্জ নতুন চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, তিনি 'ট্রান্সআটলান্টিক বাণিজ্যে আরও শিথিলতা' প্রত্যাশা করেন।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি নির্মাতারা স্বস্তি পেয়েছে, কারণ ইইউ মার্কিন গাড়ির ওপর শুল্ক ১০% থেকে কমিয়ে ২.৫% করেছে। এতে ইউরোপে মার্কিন গাড়ির বিক্রি বাড়তে পারে।
তবে অভ্যন্তরীণ বাজারে বিষয়টি এতটা ইতিবাচক নাও হতে পারে। কারণ, মার্কিন গাড়িগুলোর অনেকটাই বিদেশে—কানাডা ও মেক্সিকোতে সংযোজিত হয়। ট্রাম্প এসব গাড়ির ওপর ২৫% শুল্ক আরোপ করেছেন, যেখানে ইইউ থেকে আমদানি করা গাড়ির শুল্ক ১৫%। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে তারা ইউরোপীয় নির্মাতাদের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন মার্কিন নির্মাতারা।
ইউরোপীয় ওষুধ শিল্পও চুক্তিতে প্রত্যাশিত সুবিধা পায়নি। ট্রাম্প আগে ২৫০% শুল্কের হুমকি দিলেও, চূড়ান্ত চুক্তিতে ওষুধ ও সেমিকন্ডাক্টরের ওপর সর্বোচ্চ ১৫% শুল্ক নির্ধারিত হয়েছে। ইউরোপ আশা করেছিল, এই খাতগুলো সম্পূর্ণ শুল্কমুক্ত থাকবে।
ডেনমার্কে তৈরি টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ওষুধ 'ওজেম্পিক'-সহ বহু পণ্য মার্কিন বাজারে জনপ্রিয় হলেও, এই শর্তে বিক্রি ও বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
আয়ারল্যান্ডে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এই শিল্পের গুরুত্ব তুলে ধরে চুক্তি ঘিরে অনিশ্চয়তাকে 'ক্ষতিকর' বলে উল্লেখ করেছে।
চুক্তিতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি খাত।
ট্রাম্প জানিয়েছেন, ইইউ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৭৫০ বিলিয়ন ডলারের জ্বালানি কিনবে এবং আরও ৬০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে।
ভন ডার লেন বলেন, 'আমরা রাশিয়ান গ্যাস ও তেলের পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), তেল ও পারমাণবিক জ্বালানি কিনব।'
ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের পর থেকে ইউরোপ রুশ জ্বালানি নির্ভরতা কমাতে চাচ্ছে। এই চুক্তি সেই প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী করবে।
এছাড়া, ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের বিমান শিল্পও চুক্তিতে সুবিধা পেয়েছে।
ভন ডার লেন জানিয়েছেন, কিছু 'কৌশলগত পণ্যের' ওপর কোনো শুল্ক আরোপ করা হবে না। এর মধ্যে রয়েছে বিমান ও বিমানের যন্ত্রাংশ, নির্দিষ্ট রাসায়নিক দ্রব্য ও কিছু কৃষিপণ্য।
এর ফলে বিমানের যন্ত্রাংশ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে নির্বিঘ্ন বাণিজ্য সম্ভব হবে।
তিনি আরও জানান, ইউরোপ ভবিষ্যতে আরও কিছু খাতে—বিশেষত মদ ও স্পিরিটস পণ্যে 'শূন্য-শূন্য' চুক্তি করার চেষ্টা চালানো হবে।