নির্বাচনি দায়িত্ব পাওয়া কর্মকর্তা ও আগামী সরকারের মন্ত্রীদের জন্য ২৮০টি গাড়ি কিনবে সরকার

চলতি অর্থবছরে যানবাহন কেনার ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধন নীতি অব্যাহত থাকলেও নির্বাচনি দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা এবং আগামী নির্বাচিত সরকারের মন্ত্রীদের জন্য ২৮০টি নতুন গাড়ি কেনার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
এসব গাড়ি কিনতে মোট ৪৪৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে মঙ্গলবার অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
এর মধ্যে আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে জয়ী সরকারের মন্ত্রী, মন্ত্রী পদমর্যাদার উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের জন্য ৬০টি গাড়ি কেনা হবে। গাড়িগুলো হবে মিতসুবিশি পাজেরো কিউএক্স-২৪২৭সিসি মডেলের, যার প্রতিটির দাম ধরা হয়েছে ১.৬৯ কোটি টাকা।
এছাড়া নির্বাচনে সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) জন্য ১৯৫টি নতুন এসইউভি এবং জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়গুলোর জন্য ২৫টি মাইক্রোবাস কেনা হবে। ইউএনওদের এসইউভিগুলোও মিতসুবিশির হবে, তবে মডেল মন্ত্রীদের গাড়ির চেয়ে ভিন্ন হতে পারে।
চিঠিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলেছে, নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা এবং মাঠ পর্যায়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনি দায়িত্ব পালনে এই কর্মকর্তারা মুখ্য ভূমিকা পালন করবেন।
গাড়ি কেনা প্রসঙ্গে চিঠিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় লিখেছে, 'পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের উপদেষ্টা, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী বা সমপদমর্যাদার ব্যক্তিদের ব্যবহারের জন্য সরকারি পরিবহন পুলে যথাযথ মানের গাড়ি বর্তমানে নেই।
'বর্তমানে উপদেষ্টারা যেসব গাড়ি ব্যবহার করছেন, সেগুলো ২০১৫-১৬ অর্থবছরে কেনা। গাড়িগুলোর আয়ুষ্কাল ইতোমধ্যে ৯ বছরের বেশি অতিক্রান্ত হয়েছে। গাড়িগুলো প্রায়শই মেরামত করতে হয়, যা ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ।'
বিদ্যমান গাড়িগুলো দিয়ে ভবিষ্যতে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীদের পক্ষে নির্বাচিত এলাকা সফর, উন্নয়ন প্রকল্প পরিদর্শনসহ অন্যান্য জরুরি কাজ কষ্টসাধ্য হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে চিঠিতে।
গত ৬ আগস্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেসুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় আগামী মন্ত্রীসভার সদস্যদের জন্য গাড়ি কেনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওই সভায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে টিবিএসকে বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ফলে ওই মাসেই নতুন সরকার গঠিত হবে। প্রশাসনিক প্রক্রিয়া শেষে সরকারের অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি ও পরে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির অনুমোদন শেষে এসব গাড়ি কিনতে বেশ সময় লাগবে। তাই এখন থেকেই প্রস্তুতির কাজ শুরু হয়েছে।
তিনি জানান, প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড হতে সরাসরি ক্রয় প্রক্রিয়ায় এসব গাড়ি কিনবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর।
কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য গত ৮ জুলাই জারি করা এক পরিপত্রে সরকারি ব্যয়ে চলতি অর্থবছরে উন্নয়ন ও পরিচালন বাজেটের আওতায় সব ধরনের যানবাহন কেনা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এর আগে গত মে মাসে উপদেষ্টা বা মন্ত্রী ও সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ব্যবহারের জন্য ২৫টি গাড়ি কেনার প্রস্তাব প্রস্তুত করে অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির অনুমোদনের জন্য উপত্থাপন করেছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তবে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে গঠিত কমিটি তা অনুমোদন না করে ফেরত দেয়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চাহিদা অনুযায়ী মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের জন্য গাড়ি সরবরাহ করে থাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর এসব গাড়ি কেনা ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে।
সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা একটি নতুন গাড়ি কত দিন ব্যবহার করবেন, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন ও বিধান নেই। ১৯৮০-র দশকে সরকারের জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে ১০ বছর পরপর সরকারি গাড়ি প্রতিস্থাপনের কথা বলা আছে।
তিনি বলেন, ২০১৬ সালের পর মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের জন্য নতুন কোনো গাড়ি কেনা হয়নি। ফলে সর্বশেষ কেনা গাড়িগুলোর বয়সও প্রায় ৯ বছর হয়ে গেছে। বর্তমানে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সমমর্যাদার ব্যক্তিরাও ওইসব গাড়ি ব্যবহার করছেন।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতিসহ ভিভিআইপি ও বিদেশি ডেলিগেটদের জন্য ২০টি মার্সিডিস বেঞ্জ কার কেনার প্রস্তাব করেছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এসব অত্যাধুনিক গাড়ির প্রতিটির দাম ধরা হয়েছিল প্রায় ৩.৫ কোটি টাকা। এছাড়া মন্ত্রিসভার সদস্যদের জন্য ৫০টি টয়োটা ক্যামরি হাইব্রিড সেডান কার কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যার প্রতিটির দাম ধরা হয় প্রায় ১.০৫ কোটি টাকা।
এসব গাড়ি কেনার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে বরাদ্দ চেয়েছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট ও সরকারের কৃচ্ছ্রসাধন নীতির কারণে এ প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়।
এর আগে, ২০১৮ সালের মে মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশনের (ওআইসি) সদস্য দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ৪৫তম সম্মেলন উপলক্ষে আগত বিভিন্ন দেশের অতিথিদের যাতায়াতের জন্য ৩০টি মার্সিডিজ ও বিএমডব্লিউ কেনে সরকার।
সম্মেলনে ব্যবহারের পর এর মধ্যে কয়েকটি বিএমডব্লিউ তৎকালীন মন্ত্রিসভার সিনিয়র সদস্যদের ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। এছাড়া পাঁচটি গাড়ি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ দিয়ে বাকিগুলো রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ও সরকারি প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য সরকারি পরিবহন পুলে হস্তান্তর করা হয়।