ভবিষ্যতে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতে মানহীন মেডিকেল কলেজ বন্ধের পরিকল্পনা সরকারের

মেডিকেল শিক্ষার মান উন্নয়নে মানহীন মেডিকেল কলেজের আসন কমানো, ভর্তি বন্ধ অথবা একেবারে বন্ধ করে দেয়ার পরিকল্পনা করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সাম্প্রতিক কিছু পর্যালোচনায় মন্ত্রণালয় দেখতে পায়, বিগত বছরগুলোতে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার অনিয়মের ফলে সরকারি ও বেসরকারি কিছু কলেজে চিকিৎসা শিক্ষার মান কমে গেছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, 'স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি মেট্রিক্স-ভিত্তিক মূল্যায়ন চূড়ান্ত করছে, যাতে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় কোন কলেজের আসন কমানো প্রয়োজন এবং কোনগুলোর ভর্তি সম্পূর্ণ বন্ধ করা উচিত। অত্যন্ত নিম্নমানের কলেজের ক্ষেত্রে, কিছু কলেজ বন্ধ করা হতে পারে।'
এই পদক্ষেপগুলো আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে বাস্তবায়ন করা হবে।
মন্ত্রণালয়ের মতে, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, আটটি মূল বিষয়ের শিক্ষক ঘাটতি এবং সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত রোগীর অভাব চিকিৎসা শিক্ষার মান কমার প্রধান কারণ। কর্তৃপক্ষ অধিক শিক্ষক আকৃষ্ট করতে আর্থিক প্রণোদনা দিলেও, দৃশ্যমান উন্নতি হতে পাঁচ থেকে সাত বছর সময় লাগতে পারে।
ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, 'যদি আমরা আরও সাত থেকে আট বছর নিম্নমানের ডাক্তার তৈরি করা চালিয়ে যাই, এটি একটি জাতীয় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। বর্তমানে দেশের ডাক্তার তৈরির সংখ্যা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি। মান, চাহিদা, অবকাঠামো এবং শিক্ষক উন্নয়নের দিক বিবেচনা করে এই পদক্ষেপ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।'
বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৭টি সরকারি ও ৭২টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিজিএমই) তথ্য অনুযায়ী, পুরো ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে গুরুতর শিক্ষক ঘাটতি রয়েছে, এবং অনুমোদিত শিক্ষকের ৪২.৬ শতাংশ পদ খালি রয়েছে। ৬ হাজার ৪৪৬টি অনুমোদিত পদের মধ্যে ২ হাজার ৭০০টি খালি রয়েছে। ঘাটতি সবচেয়ে বেশি অধ্যাপক পর্যায়ে, যেখানে ৬৪.৬৫ শতাংশ পদ খালি।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের পর নির্মিত মাগুরা, নীলফামারী, হবিগঞ্জ, চাঁদপুর, নওগাঁ ও নেত্রকোণা—এই ছয়টি মেডিকেল কলেজের মান নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। এই কলেজগুলোর স্থায়ী ক্যাম্পাস নেই, হাসপাতালের সাথে সংযুক্ত নয় এবং শিক্ষক সংকটসহ নানা সংকটের সম্মুখীন।
চিকিৎসা শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অনেক জেলায় মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, প্রায়শই রাজনৈতিক কারণে। এই কলেজগুলো এখনও অবকাঠামো ও শিক্ষক ঘাটতির সম্মুখীন এবং বেশিরভাগই হাসপাতালের সঙ্গে সংযুক্ত নয়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন কমিটির চেয়ারম্যান ডা. রশিদ-এ-মাহবুব বলেছেন, 'মেডিকেল কলেজে শিক্ষক সংকট দীর্ঘদিনের সমস্যা। এটি সমাধান করা প্রয়োজন, কারণ দক্ষ ডাক্তার না তৈরির ফলে রোগীরা শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।'
ডা. সায়েদুর সতর্ক করে বলেছেন, মানহীন কলেজ খোলা রাখলে মানসম্মত ডাক্তার তৈরিতে বাধা সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, 'একটি মানহীন মেডিকেল কলেজ শুধু নিম্নমানের ডাক্তারই তৈরি করে না; এর মাধ্যমে চিকিৎসা নেওয়া রোগীরা পরবর্তী ৩০–৪০ বছরের জন্য ঝুঁকিতে থাকে। এই ধরনের কলেজ চালু থাকলে দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়।'
তিনি নাগরিকদের বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবার সুযোগের সাথে মেডিকেল কলেজের উপস্থিতিকে গুলিয়ে না ফেলার আহ্বান জানিয়ে বলেন, দেশের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে এই ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা প্রয়োজন।
এই পদক্ষেপের পাশাপাশি মন্ত্রণালয় মেডিকেল কারিকুলামের রিভিউ করছে এবং 'মেডিকেল হিউমেনিটিস' বই প্রকাশ করেছে, যেখানে আচরণ বিজ্ঞান, চিকিৎসা নৈতিকতা ও যোগাযোগ বিষয় অন্তর্ভুক্ত।
এবার থেকে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় প্রার্থীদের কেবল একাডেমিক যোগ্যতাই নয়; যোগাযোগ দক্ষতা, নৈতিক মূল্যবোধ, সহানুভূতি এবং সমস্যা সমাধানের সক্ষমতাও যাচাই করা হবে।
ইন্টার্নশিপের মেয়াদ ১২ মাস থেকে বাড়িয়ে ১৮ মাস করা হবে, যার অতিরিক্ত ছয় মাস গ্রামীণ এলাকায় বাস্তবধর্মী ক্লিনিকাল পর্যবেক্ষণ এবং কমিউনিটি-ভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রশিক্ষণে ব্যয় হবে।