স্বাস্থ্য খাতের ১০ ‘রোগ’ চিহ্নিত করেছে সরকার, কিন্তু প্রতিকার কী?

স্বাস্থ্য খাতে গত এক বছরে চিহ্নিত হয়েছে ১০টি বড় সংকট বা 'রোগ', এবং সমাধানে ইতোমধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান।
গতকাল বুধবার (৭ আগস্ট) শহীদ আবু সাঈদ আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে ডা. সায়েদুর বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারে বেশ কিছু অগ্রগতি অর্জন করেছে। সামনে যেসব সংস্কার পরিকল্পনা রয়েছে, সেগুলোর দিকনির্দেশনাও তুলে ধরেন তিনি।
তিনি বলেন, 'স্বাস্থ্য যদি কোনো সংস্কার পরিকল্পনার কেন্দ্রে না থাকে, তবে সব সংস্কারই অর্থহীন হয়ে পড়ে।'
চিহ্নিত দশটি প্রধান সংকটের মধ্যে রয়েছে—মেধা, জ্ঞান ও যোগ্যতা থেকে বঞ্চিত স্বাস্থ্যব্যবস্থা; অতিরিক্ত কেন্দ্রীভূত স্বাস্থ্যসেবা; বিশেষজ্ঞ নির্ভর চিকিৎসা; প্রাথমিক চিকিৎসা উপেক্ষা করে বিশেষজ্ঞের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা; স্বচ্ছতার অভাব ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি; স্বাস্থ্যকর্মীদের মনোবলহীনতা; চিকিৎসা সামগ্রী, ওষুধ ও চিন্তায় বিদেশ নির্ভরতা; রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিকল্পনায় দুর্বলতা; চিকিৎসাশিক্ষায় মানহীনতা; নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনায় অকার্যকারিতা এবং স্বাস্থ্য বাজেট বরাদ্দ ও ব্যবহারজনিত সমস্যা।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে মেধাভিত্তিক ভর্তি নিশ্চিত করতে কোটা প্রথা বাতিল করেছে সরকার। ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, 'আমরা ভর্তি প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় করেছি।'
তিনি জানান, সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের মেডিকেল কলেজ মূল্যায়নের আওতায় আনা হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান মানসম্পন্ন নয়, সেগুলো বন্ধ কিংবা একীভূত করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তিনি সতর্ক করে বলেন, 'নিম্নমানের কলেজ চালু রাখলে আগামী ৩০ থেকে ৪০ বছর দেশের স্বাস্থ্য খাত ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।' এছাড়া মেডিকেল পাঠ্যক্রম পর্যালোচনার কাজও চলমান রয়েছে।
স্বাস্থ্য অবকাঠামোর ঘাটতির কথা তুলে ধরে ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, দেশে বর্তমানে ১৫ হাজার হাসপাতালের শয্যার ঘাটতি রয়েছে। তিনি বলেন, 'এখন প্রতিদিন প্রায় ১২ থেকে ১৫ হাজার রোগীকে মেঝেতে থেকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।' এই সংকট মোকাবিলায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সহায়তায় শয্যাসংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, আগামী সরকার এ ধারা অব্যাহত রাখবে।
ঢাকাকেন্দ্রিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে সরে এসে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে একটি 'নারী স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট', উত্তরে একটি 'হেলথ সিটি' এবং চট্টগ্রামে প্রবীণদের জন্য একটি বিশেষায়িত চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি।
স্বাস্থ্য খাতে কর্মী সংকটের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমানে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে নিয়োগ সম্পন্ন করতে প্রায় তিন বছর সময় লেগে যায়। এই দীর্ঘসূত্রিতা কাটিয়ে সময়মতো জনবল নিয়োগ নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য খাতের জন্য আলাদা একটি পিএসসি গঠনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও জানান, আগামী এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে দেশের সব হাসপাতালের যন্ত্রপাতি একটি আইওটি ড্যাশবোর্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। এর ফলে কম ব্যবহৃত মূল্যবান যন্ত্রপাতিগুলো চিহ্নিত করে তাদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে। পাশাপাশি সরকারি ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার প্রক্রিয়া ডিজিটাল করা হয়েছে, যাতে স্বচ্ছতা বাড়ে এবং অনিয়ম কমে।
স্বাস্থ্যকর্মীদের উপযুক্ত বেতন নিশ্চিত করা, পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি এবং মেডিকেল ইন্টার্নশিপের মেয়াদ ১২ মাস থেকে বাড়িয়ে ১৮ মাস করা হচ্ছে। এর মধ্যে ছয় মাস গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ হিসেবে পালন করতে হবে। চিকিৎসক ও ওষুধ কোম্পানির মধ্যে আর্থিক লেনদেন পুরোপুরি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যাতে স্বার্থের দ্বন্দ্ব এড়ানো যায়। তবে পেশাগত সম্মেলনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ওষুধ কোম্পানির সহায়তা গ্রহণ করা যাবে।
দেশব্যাপী একটি ফার্মেসি নেটওয়ার্ক ও সমবায়ভিত্তিক ওষুধ সরবরাহ ব্যবস্থা চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি হাসপাতালের মান নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির জন্য একটি 'মেডিকেল অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল' গঠনের কথাও জানানো হয়েছে।
ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রীর কাঁচামাল দেশেই উৎপাদনের জন্য সরকার প্রণোদনা দেবে।
সরকারি প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) ৭০০ জন কর্মী কমালেও প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে পেরেছে এবং মূল্য হ্রাস করেছে, ফলে ৩০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। বর্তমানে ওষুধের দাম স্থিতিশীল রয়েছে বা কিছু ক্ষেত্রে কমেছে। স্টেন্টের দাম কমানো হয়েছে এবং ক্যানসারের ওষুধের দাম ৫ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে।
বাংলাদেশ এখন প্রতিদিন প্রায় ৭০ লাখ ট্যাবলেট উৎপাদন করছে। শিগগিরই ইনট্রাভেনাস ফ্লুইড (স্যালাইন) উৎপাদনের প্রস্তুতিও সম্পন্ন হবে।
সেপ্টেম্বরে ৩ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ: উপদেষ্টা নূরজাহান
দেশে বর্তমানে প্রায় ৭ হাজার চিকিৎসকের ঘাটতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। গতকাল একই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থেকে তিনি বলেন, 'আমরা সেপ্টেম্বর মাসে ৩ হাজার চিকিৎসক নিয়োগের পরিকল্পনা নিয়েছি। আগে যেখানে এ ধরনের নিয়োগ সম্পন্ন করতে তিন বছর লেগে যেত, এবার আমরা পাঁচ থেকে ছয় মাসের মধ্যেই নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করার চ্যালেঞ্জ নিয়েছি।'
চিকিৎসা খাতে বৈষম্য কমাতে ৭ হাজার অতিরিক্ত (সুপারনিউমারারি) পদ সৃষ্টি করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি জানান, ৪৩ হাজার সিনিয়র নার্সের মধ্যে কয়েকজনকে ইতোমধ্যে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
উপদেষ্টা নূরজাহান জানান, বিভিন্ন পক্ষের দায়ের করা মামলার কারণে মন্ত্রণালয়ের অনেক কাজেই ধীরগতি দেখা দিয়েছে। তবে পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় বাণিজ্যিক প্রভাব বন্ধে ইতোমধ্যে ডিজিটালাইজেশনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
চিকিৎসা শিক্ষার্থীদের আবাসনসংক্রান্ত সমস্যা তুলে ধরে তিনি বলেন, 'মেডিকেল কলেজের অনেক হোস্টেলে থাকার মতো পরিবেশ নেই। তাই ১৯টি নতুন ছাত্রাবাস তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি, যাতে ১০ হাজার শিক্ষার্থী থাকতে পারবে।'
শিক্ষার মানোন্নয়নে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোকে এই নীতিমালার আওতায় আনা হবে। পাশাপাশি কয়েকটি মেডিকেল কলেজ একীভূত করার পরিকল্পনাও রয়েছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, 'এর ফলে শিক্ষার মান উন্নত হবে, শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের ক্ষতি হবে না।'