উত্তরাঞ্চলের চিকিৎসা সেবায় নতুন দিগন্ত: নীলফামারীতে নির্মিত হবে ১,০০০ শয্যার হাসপাতাল
উত্তরাঞ্চলের মানুষের জন্য সুখবর! নীলফামারীতে স্থাপিত হতে যাচ্ছে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী জেনারেল হাসপাতাল।
১,০০০ শয্যার এই হাসপাতাল স্থানীয় বাসিন্দা ও আশপাশের জেলার মানুষকে উন্নত চিকিৎসা সেবা দেবে। ফলে এসব এলাকার মানুষদের বিশেষায়িত চিকিৎসার জন্য ঢাকা বা রংপুরে যাওয়ার প্রয়োজন কমে যাবে অনেকটাই।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রকল্পটির জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান ও ব্যয় প্রাক্কলন প্রস্তুত করার নির্দেশ দিয়েছে। গত ৩০ অক্টোবর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে জরুরি চিঠি পাঠিয়ে বিষয়টি দ্রুত বাস্তবায়নের ওপর জোর দেয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (ডিজিএইচএস), পরিকল্পনা কমিশন এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)–এর কর্মকর্তাদের বরাতে জানা গেছে, প্রকল্পটির সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১,৪৮০ কোটি টাকা, যা সম্পূর্ণ অনুদানভিত্তিক হবে। হাসপাতালটির নির্মাণ ২০২৮ সালের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে।
সৈয়দপুর-নীলফামারী সড়কের পাশের চারাইখোলা ইউনিয়নের দারওয়ানি টেক্সটাইল মিল–সংলগ্ন ২৫ একর জমিতে এই হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে।
নীলফামারী গণপূর্ত বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আমানুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, প্রায় ২৫ থেকে ২৮ একর জমি ইতোমধ্যেই অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে।
এর আগে গত ২৩ আগস্ট স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম দারওয়ানি টেক্সটাইল মিল–সংলগ্ন ওই স্থান পরিদর্শন করেন।
বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা
স্থান পরিদর্শনের সময় স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম জানান, হাসপাতালটিতে অনকোলজি, নিউরোলজি, কার্ডিওলজি, নেফ্রোলজি, শিশু ও নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা (পেডিয়াট্রিক ও নিওনেটাল আইসিইউ) বিভাগে বিশেষায়িত চিকিৎসা দেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে ২০০ মেশিনসমৃদ্ধ একটি ডায়ালাইসিস সেন্টার, আধুনিক মডুলার অপারেশন থিয়েটার, ইমার্জেন্সি সার্জারি ইউনিট এবং পিইটি-সিটি, এমআরআই ও মলিকুলার ল্যাবসহ অত্যাধুনিক ডায়াগনস্টিক ব্লক থাকবে।
পরিকল্পনা নথিতে বলা হয়েছে, এই হাসপাতাল চালু হলে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ কমবে এবং উত্তরাঞ্চলের রোগীদের চিকিৎসা ব্যয়ও হ্রাস পাবে।
নীলফামারীর সিভিল সার্জন ডা. আব্দুর রাজ্জাক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "নীলফামারীতে এই হাসপাতালটি হলে এ অঞ্চলের মানুষকে চিকিৎসার জন্য আর রংপুর বা ঢাকায় যেতে হবে না। এই হাসপাতালের মাধ্যমে শুধু নীলফামারীর নয়, আশেপাশের জেলা যেমন পঞ্চগড় ও গাইবান্ধার মানুষও উপকৃত হবেন।"
তিনি আরও বলেন, "সৈয়দপুর বিমানবন্দর থেকে মাত্র ১০–১২ কিলোমিটার দূরে মূল সড়কের পাশে এই হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। ফলে যোগাযোগব্যবস্থা অত্যন্ত সহজ ও উন্নত হবে।"
এর আগে, গত ১৩ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম জানান, বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে চীন সরকার এদেশের জনগণের জন্য ১,০০০ শয্যার এই বিশেষায়িত হাসপাতালটি উপহার হিসেবে দিচ্ছে।
একই অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ডা. আবু জাফর জানান, নীলফামারীতে তিস্তা প্রকল্পের কাছেই এই ১,০০০ শয্যার বিশেষায়িত হাসপাতালটি নির্মাণ করবে চীন।
চীনের অর্থায়নে স্বাস্থ্যসেবা–সংক্রান্ত আরও প্রকল্প
চীনের সহায়তা দেশের স্বাস্থ্য খাতে আরও বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে।
জানা গেছে, চট্টগ্রামের দক্ষিণ কর্ণফুলীতে ৫০০ থেকে ৭০০ শয্যার একটি জেনারেল হাসপাতালের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা চালানো হবে। এছাড়া ঢাকার উপকণ্ঠ ধামরাইয়ে আহত ও প্রতিবন্ধী রোগীদের পুনর্বাসনের জন্য ১০০ শয্যার একটি রিহ্যাবিলিটেশন হাসপাতাল নির্মাণেরও পরিকল্পনা রয়েছে চীনের।
ডা. আবু জাফর বলেন, "চীন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী এবং তারা ইতোমধ্যেই বেশ কিছু প্রকল্পে সহযোগিতা করছে।"
চলতি বছর চীনের কারিগরি সহায়তায় সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে দেশের প্রথম রোবটিক ফিজিওথেরাপি সেন্টার চালু করা হয়েছে।
চীনের সহায়তায় নির্মিত এই কেন্দ্রটি উন্নত বিশ্বের মানদণ্ডে গড়ে তোলা হয়েছে। প্রকল্পে চীন সরকার প্রায় ২০ কোটি টাকার রোবটিক যন্ত্রপাতি অনুদান দিয়েছে। কেন্দ্রটিতে মোট ৬২টি রোবট রয়েছে, যার মধ্যে ২২টি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)–ভিত্তিক। এসব রোবটের মাধ্যমে রোগীর অবস্থা অনুযায়ী নির্ভুলভাবে ফিজিওথেরাপি, স্নায়ু পুনর্বাসন ও দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
এদিকে, চট্টগ্রামে প্রস্তাবিত ৫০০ থেকে ৭০০ শয্যার হাসপাতালটির ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২,৬২৭ কোটি টাকা—যার মধ্যে ১,৯৪৫ কোটি টাকা চীনের অনুদান হিসেবে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটি একটি টারশিয়ারি লেভেলের হাসপাতাল হিসেবে নির্মিত হবে, যেখানে চিকিৎসাসেবা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম একসঙ্গে পরিচালিত হবে।
হাসপাতালের সঙ্গে একটি নার্সিং কলেজ স্থাপন করা হবে, যা দক্ষ জনবলের ঘাটতি পূরণে ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি সিএসএসডি (সেন্ট্রাল স্টেরাইল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট), বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, টেলিমেডিসিন, ডিজিটাল স্বাস্থ্য রেকর্ড, মর্গ ও ফরেনসিক ইউনিটসহ আধুনিক সহায়ক অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। চিকিৎসক, নার্স ও কর্মীদের জন্য আবাসন সুবিধাও থাকবে।
ডা. আবু জাফর জানান, চীন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগে গভীর আগ্রহ দেখিয়েছে এবং ভবিষ্যতের প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগের মানদণ্ড নির্ধারণেও তারা সক্রিয় ভূমিকা নেবে।
