দেশে অর্ধেকের বেশি মানুষ অদক্ষ সেবাদাতার কাছে চিকিৎসা নেন: সমীক্ষা
বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই অপ্রশিক্ষিত বা অযোগ্য সেবা–প্রদানকারীর কাছে চিকিৎসা নেন বলে উঠে এসেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায়।
গতকাল (৩০ নভেম্বর) প্রকাশিত হেলথ অ্যান্ড মরবিডিটি স্ট্যাটাস সার্ভে (এইচএমএসএস) ২০২৫–এর ফলাফলে দেখা গেছে, রোগীদের ৫৪ শতাংশই যোগ্য চিকিৎসকের বদলে ফার্মেসির সেলসম্যানের কাছে চিকিৎসা নিয়েছেন বা নিজে নিজে ওষুধ সেবন করেছেন। সরকারি স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে গেছেন মাত্র ১১ দশমিক ৫ শতাংশ, আর প্রায় ২০ শতাংশ চিকিৎসা নিয়েছেন বেসরকারি খাত থেকে।
গত বছরের নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের ৪৭ হাজার ৪০টি পরিবারের ১ লাখ ৮৯ হাজার ৯৮৬ জনকে নিয়ে পরিচালিত এই সমীক্ষায় রোগীদের ব্যাপক অসন্তুষ্টি এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিভিন্ন কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ উঠে এসেছে।
১০টি সাধারণ রোগের তালিকায় শীর্ষে উচ্চ রক্তচাপ
সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের ১০টি সাধারণ রোগের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে উচ্চ রক্তচাপ। প্রতি হাজারে ৭৮ দশমিক ২৮ জন এই রোগে ভুগছেন। এরপর রয়েছে পেপটিক আলসার, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, চর্মরোগ, হৃদরোগ, হাঁপানি, অস্টিওপোরোসিস, হেপাটাইটিস ও ডায়রিয়া।
সমীক্ষার আগের ৯০ দিনে প্রতি হাজারে ৩৩২ জন বা মোট ৩৩ শতাংশ মানুষ অসুস্থ হয়েছেন—এতে নারীদের অসুস্থতার হার পুরুষদের তুলনায় সামান্য বেশি।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেন, অপ্রশিক্ষিত চিকিৎসা–প্রদানকারীদের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে দীর্ঘমেয়াদে রোগ শনাক্তে দেরি হচ্ছে এবং একইসঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার বাড়াচ্ছে।
জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার ডা. আব্দুস শাকুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ওষুধ কোনো 'জাদুকরী' জিনিস নয়—সঠিক ডোজ, সঠিক প্রয়োগ ও ক্লিনিক্যাল বিবেচনার ওপরেই এর কার্যকারিতা নির্ভর করে।
তিনি বলেন, "দোকানদারের পরামর্শে ওষুধ—বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিক—সেবন করা অত্যন্ত ক্ষতিকর। মেরোপেনেমের মতো ওষুধ একসময় বিপ্লব ঘটিয়েছিল, কিন্তু এখন বাংলাদেশে এটির প্রতিরোধ ক্ষমতা (রেজিস্ট্যান্স) কমে গেছে।"
তিনি আরও জানান, অনেক কিডনিরোগী ফার্মেসির পরামর্শে দীর্ঘদিন অপ্রয়োজনীয় ব্যথানাশক খেয়ে নিজেদের অবস্থাকে অজান্তেই আরও খারাপ করছেন। সামান্য অসুস্থতার ক্ষেত্রেও তিনি অন্তত একবার এমবিবিএস ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেন—না হলে অনেক ক্ষেত্রে অপূরণীয় জটিলতা দেখা দিতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের এপিডেমিওলজি ও রিসার্চ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, "বাংলাদেশে প্রতি চারজন প্রাপ্তবয়স্কের একজন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন, কিন্তু মাত্র ১৬ শতাংশ এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন—অর্থাৎ ৮৪ শতাংশই রোগ শনাক্তবিহীন, চিকিৎসাহীন বা অপর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবার আওতায় থাকছেন।"
তিনি বলেন, অনেক রোগী রক্তচাপ স্থিতিশীল হলেই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেন, ফলে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও কিডনি রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। দুর্বল স্ক্রিনিং ব্যবস্থাপনা এবং চিকিৎসার ফাঁকফোকর পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালী করা, ওষুধের সরবরাহ নিশ্চিত রাখা, কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে স্ক্রিনিং বাড়ানো, ৩০ বছর বা তার বেশি বয়সীদের নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা উৎসাহিত করা এবং টেলিমেডিসিন সেবার বিস্তৃতি নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
ব্যক্তিপ্রতি চিকিৎসা ব্যয় গড়ে ২ হাজার ৪৮৭ টাকা
সমীক্ষায় স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়ের চাপও উঠে এসেছে। সমীক্ষার আগের তিন মাসে ব্যক্তিপ্রতি গড়ে চিকিৎসা ব্যয় ছিল ২ হাজার ৪৮৭ টাকা। নারীরা গড়ে ব্যয় করেছেন ২ হাজার ৫৭৬ টাকা, আর পুরুষদের ব্যয় ২ হাজার ৩৮৭ টাকা।
সরকারি সেবার ওপর বেশি নির্ভরশীল হওয়া সত্ত্বেও নারীদের চিকিৎসা ব্যয় তুলনামূলকভাবে বেশি।
১৫–৪৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে সিজারিয়ান (সিজার) হারের জাতীয় গড় দাঁড়িয়েছে ৪৯ দশমিক ৩ শতাংশ। শহর এলাকায় এ হার আরও বেশি—৫৩ দশমিক ৩ শতাংশ; গ্রামে ৪৮ দশমিক ১ শতাংশ।
সন্তান প্রসবের গড় ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৬৫৫ টাকা। এর মধ্যে প্রসবপূর্ব সেবা (অ্যান্টেনাটাল কেয়ার) বাবদ খরচ ৫ হাজার ৬৫৮ টাকা এবং প্রসবের ব্যয় ১৩ হাজার ৬০ টাকা। শহরাঞ্চলের মায়েরা ব্যয় করেছেন গড়ে ২৬ হাজার ৩৬০ টাকা, আর গ্রামাঞ্চলে এ ব্যয় ২১ হাজার ৫৫৪ টাকা।
প্রতিবন্ধিতা ও তামাক ব্যবহার এখনো বড় উদ্বেগ
এইচএমএসএস ২০২৫ সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ৫ দশমিক ২ শতাংশ শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধিতায় ভুগছেন। শহরে এ হার সামান্য বেড়ে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। ১৮ বছর বা তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিবন্ধিতার হার আরও বেশি—৭ দশমিক ১ শতাংশ।
প্রতিবন্ধিতাজনিত চিকিৎসা ব্যয় গড়ে গ্রামে ৭ হাজার ২৬৯ টাকা এবং শহরে ৫ হাজার ৪১৭ টাকা।
তামাক ব্যবহারের হারও উদ্বেগজনক। ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী জনগোষ্ঠীর ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ তামাকপণ্য ব্যবহার করেন। গ্রামে এ হার ২৭ দশমিক ৭ শতাংশ, আর শহরে ২৪ দশমিক ১ শতাংশ। পুরুষদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৩৭ দশমিক ৯ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ।
সমীক্ষার সামগ্রিক চিত্র দেখায়—স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি, সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিস্থিতি আরও অবনতির আগে এসব বিষয়ে দ্রুত নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
