নগরাঞ্চলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা জোরদারে ১৭০টি নতুন স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা
নগরবাসীর জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার পরিধি বাড়াতে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ প্রধান প্রধান সিটি করপোরেশনগুলোতে ১৭০টি আরবান প্রাইমারি হেলথ অ্যান্ড নিউট্রিশন সেন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা করছে সরকার। এসব কেন্দ্রের নাম হবে 'সিটি হেলথ সেন্টার'।
প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় আগামী তিন বছরের মধ্যে এই কেন্দ্রগুলো স্থাপন করার কথা রয়েছে। এ প্রকল্পে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ১ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা।
প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
প্রকল্প নথি অনুযায়ী, এই উদ্যোগের মাধ্যমে একটি 'হাব-অ্যান্ড-স্পোক' নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হবে। এর মাধ্যমে নতুন কেন্দ্রগুলোকে বিদ্যমান নাগরিক স্বাস্থ্য সুবিধাগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। এর লক্ষ্য হলো—বিশেষ করে নিম্ন-আয়ের মানুষ ও বস্তিবাসীদের জন্য—নিরবচ্ছিন্ন, ন্যায্য ও সমন্বিত সেবা নিশ্চিত করা।
প্রতিটি কেন্দ্র দুই শিফটে পরিচালিত হবে। এতে সেবাদানের সময় বাড়বে এবং মানুষের জন্য সেবা পাওয়া সহজ হবে।
এক্সপান্ডিং অ্যাকসেস টু ইন্টিগ্রেটেড হেলথ কেয়ার ফর দি আরবান পপুলেশন (২০২৫–২০২৮) শীর্ষক এই প্রকল্পটি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (ডিজিএইচএস) বাস্তবায়ন করবে। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা, যার মধ্যে বিশ্বব্যাংক দেবে ১ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা।
নগরাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবার মান ও পরিধি বাড়াতে এতে আরও চারটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে: প্রতিটি কেন্দ্রে নিরবচ্ছিন্ন কার্যক্রম নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী মোতায়েন করে জনবলকে শক্তিশালী করা; জাতীয় অত্যাবশ্যকীয় ঔষধের তালিকা অনুযায়ী অন্তত ৮০ শতাংশ ওষুধের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা এবং জাতীয় ওয়াশ ও চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মানদণ্ডগুলো পরিপূর্ণভাবে পালন করা।
রিয়েল-টাইম তথ্য সংগ্রহ, পর্যবেক্ষণ ও সেবার মানোন্নয়নের জন্য সবগুলো কেন্দ্রকে ডিএইচআইএস২ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে একীভূত করা হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, এই প্রকল্প নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই আলোচনা চলছিল। এটি কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হলে শহরের দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যগত অগ্রাধিকারের চাহিদাগুলো পূরণ করা যাবে।
তিনি টিবিএসকে বলেন, 'এই উদ্যোগটি খুবই প্রয়োজনীয়—এটি একটি অপরিহার্য প্রকল্প হতে যাচ্ছে।'
নগরাঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতি পূরণ
দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশেরও বেশি এখন নগরাঞ্চলে বাস করে। এই অঞ্চলগুলোতে কাঠামোবদ্ধ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার তীব্র সংকট রয়েছে।
বর্তমানে প্রধান শহরগুলোতে মাত্র ৩৫টি সরকারি আউটডোর ডিসপেনসারি চালু আছে। এসব ডিসপেনসারি প্রায় দেড় কোটি মানুষকে সেবা দিচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে ১৭টি ও চট্টগ্রামে রয়েছে ৯টি।
এই সংকটের কারণে শহরের বেশিরভাগ দরিদ্র মানুষ বেসরকারি বা এনজিও পরিচালিত সেবার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ফলে তাদের স্বাস্থ্যসেবা বাবদ ব্যক্তিগত খরচ (আউট-অভ-পকেট ব্যয়) বাড়ছে এবং বৈষম্য আরও প্রকট হচ্ছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্ক সুপ্রতিষ্ঠিত হলেও, নগরাঞ্চলের প্রাথমিক সেবার দায়িত্ব মূলত স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যস্ত। এর ফলে প্রশাসনে এক ধরনের বিভাজন তৈরি হয়েছে এবং জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের মধ্যে সমন্বয় দুর্বল হয়ে পড়েছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, এই উদ্যোগের লক্ষ্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে নগরবাসীর দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া।
তিনি বলেন, 'প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকবে, যা দুই শিফটে চলবে। এই কেন্দ্রগুলোতে ১২ থেকে ১৪ ধরনের রোগ পরীক্ষা করার সুবিধা থাকবে, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ দেওয়া হবে এবং প্রয়োজনে রোগীদের বিশেষায়িত বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হবে।'
আলমা-আতা (১৯৭৮) ও আস্তানা (২০১৮) ঘোষণাপত্রে নির্ধারিত বৈশ্বিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার রূপকল্প অনুযায়ী, এই নতুন সিটি হেলথ সেন্টারগুলো স্বাস্থ্য উন্নয়নমূলক, প্রতিরোধমূলক, নিরাময়মূলক এবং পুনর্বাসনমূলক সেবা দেবে।
এই প্রকল্পে জলবায়ু-সহনশীল অবকাঠামো, ডিজিটাল স্বাস্থ্য রেকর্ড ও কমিউনিটি-কেন্দ্রিক সেবার ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, যা ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
