মাইলস্টোনে বিমান বিধ্বস্ত: ক্লাস শেষে কোচিংয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল শিক্ষার্থীরা

প্রতিদিনের মতো সোমবার দুপুরেও মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের হায়দার আলী ভবনে নিয়মিত শ্রেণিকক্ষের কার্যক্রম শেষ হয় দুপুর ১টার দিকে। ভবনটির নিচতলায় বাংলা ভার্সনের ৩য় থেকে ৫ম শ্রেণি এবং ইংরেজি ভার্সনের ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস ছিল। তবে ছুটি শেষে অনেক শিক্ষার্থী থেকে গিয়েছিল বিশেষ কোচিংয়ের জন্য, কেউ অপেক্ষা করছিল অভিভাবকদের জন্য, আবার কেউ কেউ ভবনের সামনের খোলা জায়গায় খেলায় মেতে উঠেছিল।
সব কিছুই ছিল অন্য দিনের মতো স্বাভাবিক—কিন্তু না। দুপুর সোয়া ১টার দিকে হঠাৎই ভবনটির নিচতলায় আছড়ে পড়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর এফ-৭ বিজিআই প্রশিক্ষণ বিমান। সঙ্গে সঙ্গে বিকট বিস্ফোরণ, আগুন আর আতঙ্কে পুরো ভবন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে, হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন আরও অনেকে।
প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অনেকেই মনে করছেন, যদি সেদিন স্পেশাল কোচিং না থাকত, তাহলে হতাহতদের সংখ্যা হয়তো অনেক কম হতো।
৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থী আয়ান শরীরের ৪৫ শতাংশ দগ্ধ নিয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছে রাজধানীর জাতীয় বার্ণ ইনস্টিটিউটে। সেদিন স্কুল শেষে কোচিংয়ের জন্যই সে ক্যাম্পাসে ছিল।
আয়ানের খালাতো ভাই রাহিব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানায়, "ওদের ক্লাস ১টায় শেষ হলেও আয়ান স্পেশাল কোচিংয়ের জন্য ক্লাসরুমেই অপেক্ষা করছিল। যদি কোচিংয়ের জন্য না থাকত, তাহলে হয়তো ছুটি শেষে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়েও যেতে পারত।"
শুধু আয়ান নয়—সেদিন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাধিক শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ছুটি শেষে কোচিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল বলে নিশ্চিত করেছেন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা।
তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রতিটি ক্লাসে ৬০ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী স্কুলের নিজস্ব কোচিংয়ে অংশগ্রহণ করে থাকে।
অভিভাবক সাবিকুন্নাহার জানান, তার দুই সন্তান—রাজিন আহমেদ (৮ম শ্রেণি) ও আরাবী আহমেদ (৩য় শ্রেণি)—এই প্রতিষ্ঠানেই পড়ে। তবে তিনি তাদের স্কুলের কোচিংয়ে দেননি। সোমবার দুপুর ১টার আগেই তিনি স্কুলে এসে অপেক্ষা করছিলেন সন্তানদের নিয়ে বাসায় ফেরার জন্য। ছুটি হলে প্রথমে হায়দার আলী ভবন থেকে ছোট ছেলেকে নিয়ে যান পাশের ভবনে বড় ছেলেকে আনতে। পরে ক্যাম্পাসের গেটের কাছে পৌঁছানোর আগেই বিকট শব্দে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পান।
সাবিকুন্নাহার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সোমবারের দুর্ঘটনাটা বলা চলে আমার চোখের সামনেই ঘটেছে। চোখের সামনে ছোট ছোট শিশুদের দগ্ধ হতে দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। বারবার মনে হচ্ছিল, যদি আমার ছোট ছেলেটা তখন ক্লাসে থাকত, তাহলে হয়তো তাকেও হারাতে হতো। হয়তো কোচিং না দেওয়াটাই আল্লাহর রহমতে ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "স্কুল থেকেও বারবার কোচিংয়ে দিতে বলা হয়েছিল। আমার না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়তোই এখন সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। প্রতিটি শ্রেণির প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী কোচিংয়ে পড়ে। অনেক সময় প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অভিভাবকদের চাপ দেওয়া হয় কোচিংয়ে দিতে।"
কলেজ বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী রাজিন হোসেন বলেন, "আমিও কলেজের কোচিংয়ে পড়ি। আমাদের মতো অনেকেই স্কুলে কোচিং নেয়, কারণ বাইরের টিউশনে খরচ বেশি। এখানে খরচ তুলনামূলক কম। দুর্ঘটনার দিন বিধ্বস্ত ভবনে থাকা শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই কোচিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল।"
কোচিং ব্যবস্থার বিষয়টি প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষকও স্বীকার করেছেন, তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, "প্রায় প্রতিটি শ্রেণিরই কোচিং রয়েছে, যা মূল ক্লাসের পরেই চলে। শিক্ষার্থীরা ক্লাসরুমেই কোচিং নেয়। কখনো কখনো সংশ্লিষ্ট ক্লাস শিক্ষকরা পরামর্শ দেন কে কে কোচিং করবে। দুর্ঘটনার দিন যারা হতাহত হয়েছে, তাদের বেশিরভাগই কোচিংয়ে অংশ নিতে কিংবা অভিভাবকের জন্য অপেক্ষায় ছিল।"