আগে আকাশে বিমান দেখলেই যারা উৎফুল্ল হতো, এখন শব্দ শুনলেই হয় আতঙ্কিত

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলা মাধ্যমের ৯ম শ্রেণির শিক্ষার্থী জাকারিয়া ইসলাম জিহান পঞ্চম শ্রেণি থেকেই এই স্কুলে পড়ে। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকে তার আনন্দের অন্যতম উৎস ছিল মাথার ওপর দিয়ে ওড়ে যাওয়া বিমান। যখনই বিমানের শব্দ পেত, বন্ধুদের নিয়ে ছুটে যেত স্কুলের মাঠে—বিমান দেখতে, বিমানের শব্দ উপভোগ করতে।
কিন্তু সেই পরিচিত শব্দ এখন তার কাছে আতঙ্কের নাম।
সোমবার মাইলস্টোন স্কুলের একটি দ্বিতল ভবনের ওপর বিধ্বস্ত হয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান। ওই ঘটনায় জিহানের মামাতো ভাই ৯ বছর বয়সী জুনায়েতসহ এখন পর্যন্ত ৩২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন আরও অনেকে।
বুধবার মাইলস্টোন স্কুলের প্রধান ফটকে কথা হয় জিহানের সঙ্গে। তার চোখে-মুখে তখনও আতঙ্ক স্পষ্ট। ঠিক সেই মুহূর্তে আকাশে উড়ছিল একটি যাত্রীবাহী বিমান। বিমানটির গর্জন শোনামাত্রই জিহান ভয়ে কেঁপে ওঠে—চোখ তুলে তাকায় আকাশের দিকে, যেন কোনো অশুভ কিছু আবার নামছে মাথার ওপর।
জিহান জানায়, "বিমানের শব্দ শুনতে শুনতেই বড় হয়েছি। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর প্রথমদিকে প্রতিদিন অপেক্ষা করতাম কখন বিমান আসবে, আর আমরা বন্ধুদের নিয়ে মাঠে গিয়ে সেটা দেখে উল্লাস করব। বিমানের শব্দ কখনও আতঙ্কের কিছু ছিল না, বরং ছিল আনন্দের উৎস।"

"কিন্তু সোমবার চোখের সামনে যখন বিমানটি বিধ্বস্ত হলো, তখন থেকে বিমানের শব্দ পেলেই মনে হয় এই বুঝি আমাদের ওপর এসে পড়ল।"
জিহান আরও জানায়, "ঘটনার সময় আমরা ছিলাম ৭ নম্বর ভবনে। বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার বিকট শব্দ শুনে আমরা বাইরে বের হই, দেখি চারদিকে ছোটাছুটি। তখনই মনে পড়ে, আমার মামাতো ভাই জুনায়েত তো ওই ভবনে ছিল। আমরা দৌড়ে যাই আটকে পড়া শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করতে, কিন্তু আগুনের তীব্রতায় কিছুই করতে পারছিলাম না। পরে ভবনের অন্য পাশে গিয়ে গ্রিল ভেঙে কয়েকজনকে উদ্ধার করি। আমার মামাতো ভাইকেও উদ্ধার করি, কিন্তু তার শরীরের বড় একটি অংশ পুড়ে যায়, বিশেষ করে শ্বাসনালীতে সমস্যা হচ্ছিল—সে ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানেই মারা যায় সে।"
জিহান বলেন, "এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যে স্কুলের ওপর দিয়ে এমনভাবে বিমান চলে, সেই স্কুলে আর পড়ব না। এখান থেকে বাসাও ছেড়ে চলে যাব।"
স্কুলটির বাংলা মাধ্যমের ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী সিয়াম টিবিএসকে জানায়, "মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমান কখনও স্কুলের ভেতরে পড়ে যেতে পারে, এটা কোনোদিন কল্পনাও করিনি। মাঠে খেলাধুলা করার সময় যখন বিমান চলত, তখন বিমানের ছায়ার সঙ্গে দৌড়াতাম। ছায়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়াতে পারলে অন্যরকম ভালো লাগত। কিন্তু দুর্ঘটনার পর থেকে ঘুমের মধ্যেও বিমানের শব্দ শুনলে আঁতকে উঠি। কারণ দুর্ঘটনাটা আমাদের চোখের সামনেই ঘটেছে"।
"এখন সব সময় মাথায় ঘোরে—যদি সেদিন বিমানটা আমাদের ভবনে বিধ্বস্ত হতো, তাহলে আমরাও হয়তো আমাদের সহপাঠীদের মতোই অবস্থা হতো," যোগ করেন সিয়াম।
দ্বাদশ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর মা হাসিনা আক্তার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ঘটনার কথা শুনেই আমি দৌড়ে কলেজে আসি মেয়েকে খুঁজতে। এসে দেখি আমার মেয়ে ভয়ে কাঁপছে। যদিও সে অন্য ভবনে ছিল, তবে দুর্ঘটনার সময়ই সে শিশুদের বাঁচাতে ছুটে আসে। চোখের সামনে ছোট ছোট বাচ্চাদের পুড়তে দেখে আমার মেয়েটাও এখন পুরোপুরি ট্রমায় ভুগছে।"

তিনি আরও বলেন, "শুরুর দিকে মাইলস্টোনে ভর্তি করানোর পর বিমানের শব্দটা আমার কাছে বিরক্তিকর মনে হলেও বাচ্চারা খুব উপভোগ করত। তারা শব্দের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু কোনোদিন ভাবিনি, এই বিমান একদিন শিক্ষার্থীদের জীবন কেড়ে নেবে। সরকারের কাছে অনুরোধ, এই এলাকা থেকে যেন বিমান প্রশিক্ষণের কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ করা হয়। আমরা আর বিমানের শব্দে আতঙ্কে থাকতে চাই না।"
প্রতিষ্ঠানটির কলেজ বিভাগের শিক্ষক গোলাম মোস্তফা টিবিএসকে বলেন, "ঘটনার সময় আমি কলেজ ভবনে ছিলাম। বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার পরপরই আমরা শিক্ষার্থীদের উদ্ধারে ছুটে যাই। কিন্তু বিমানটি ভেঙে পড়ার আগে প্রচণ্ড শব্দ হয়েছিল। সেই শব্দে আমরা সবাই বিস্মিত হয়ে পড়ি, কারণ সাধারণত এত জোরে শব্দ হতো না।"
তিনি আরও বলেন, "সেদিন ক্যাম্পাসে থাকা প্রায় সব শিক্ষার্থীই এখন ট্রমাটাইজড। আগে যেসব বাচ্চা বিমানের শব্দ শুনে উচ্ছ্বসিত হতো, এখন সেই শব্দই তাদের কাছে আতঙ্কের। আহতদের চিকিৎসার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করাও এখন জরুরি। এজন্য শিক্ষক, অভিভাবক—সবার সম্মিলিতভাবে পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন। ওদেরকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দেওয়া খুব জরুরি।"