অর্থায়নের অভাবে চট্টগ্রামে দেশের প্রথম স্মার্ট স্কুল বাস সেবা বন্ধের মুখে

চট্টগ্রাম শহরে শিক্ষার্থীদের জন্য চালু হওয়া দেশের প্রথম 'স্মার্ট স্কুল বাস' সেবা অর্থসংকটের কারণে বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় পড়েছে।
গত ১৯ মাস ধরে এই বাস সার্ভিস চট্টগ্রাম শহরের ৩ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য যাতায়াত সুবিধা দিয়ে আসছে। তবে প্রধান পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেড অর্থায়ন বন্ধ করে দেওয়ায় সেবাটির ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) যৌথভাবে এই সেবা চালু করে। বর্তমানে ১০টি ডাবল ডেকার বাসের মাধ্যমে প্রতিদিন ১০টি স্কুলের শিক্ষার্থীদের আনা-নেওয়া করা হয়।
এই সেবা শিক্ষার্থীদের নিরাপদ যাতায়াতের পাশাপাশি শহরের ট্রাফিক জট কমাতেও ভূমিকা রাখছে বলে প্রশংসিত হয়েছে।
বিআরটিসি'র চট্টগ্রাম বাস ডিপোর অপারেশন ম্যানেজার মো. জুলফিকার আলী বলেন, "২০২৪ সালে আমরা সকল শিক্ষার্থীর নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করেছি। কিন্তু ২০২৫ সালে এসে আমরা চরম অর্থসংকটে পড়েছি। চালক ও সহকারীদের সাত মাস ধরে বেতন দেওয়া সম্ভব হয়নি। প্রতিদিনের জ্বালানির খরচ চালানোর মতো টাকাও নেই।"
তিনি আরও বলেন, "আর্থিক সহায়তা ছাড়া এই সেবা আর বেশি দিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।"
৭৮ জন যাত্রীর ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এসব বাস চট্টগ্রাম শহরের বাহাদ্দারহাট, মুরাদপুর, নিউ মার্কেট, চকবাজার, চেরাগি পাহাড় ও কোতোয়ালি-সহ গুরুত্বপূর্ণ ১০টি রুটে চলাচল করে।
'স্মার্ট' এই সেবায় জিপিএস ট্র্যাকিং, জিআইএস, আইপি ক্যামেরা এবং ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়। শিক্ষার্থীরা বাসে উঠলেই অভিভাবকদের মোবাইলে তাৎক্ষণিক বার্তা পৌঁছে যায় এবং বাসের চলাচল তারা রিয়েল টাইমে ট্র্যাক করতে পারেন।
ব্যক্তিগত পরিবহন না থাকা পরিবারগুলোর মধ্যে স্মার্ট বাস সেবাটি বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
"আগে প্রতিটি শিক্ষার্থীর সঙ্গে একজন অভিভাবককে স্কুলে যেতে হতো। এতে ৩ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য প্রতিদিন প্রায় ৬ হাজার মানুষ যাতায়াত করতেন। স্মার্ট বাস চালুর পর সেই সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। এতে সময় বাঁচছে, ট্রাফিক জ্যামও কমছে," বলেন জুলফিকার আলী।
এই উদ্যোগ পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচের জন্য জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেড দুই বছরের একটি চুক্তির আওতায় পৃষ্ঠপোষকতা করতে সম্মত হয়। প্রতিষ্ঠানটি মোট ১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং ২০২৪ সালে ৭২ লাখ টাকা পরিশোধও করে।
তবে সম্প্রতি চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেডের ডেপুটি হেড অব ফ্যাসিলিটিজ অ্যান্ড এস্টেট মো. গোলাম মক্তাদির জানান, চলমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ২০২৫ সালের বাকি অর্থ অনুদান দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।
বাসে ভাড়া সংগ্রহের জন্য ফেয়ার বক্স বসানো হলেও শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছায় দেওয়া ৫ টাকার অনুদান ছিল অনিয়মিত। ফলে সেবাটি প্রায় পুরোপুরি পৃষ্ঠপোষকতার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান অর্থায়ন বন্ধ করার পর বিআরটিসি নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ বহন করছে। গত ছয় মাসে প্রতিষ্ঠানটি ৪২ লাখ টাকা ভর্তুকি দিয়েছে, যা এখন প্রায় শেষের পথে।
বাস সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ।
ডা. খাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী আসমাউল হুসনা বলেন, "যদি বাস বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে আম্মু-আব্বুকে আমাকে স্কুলে আনতে হবে। দয়া করে এটা বন্ধ করবেন না।"
মুরাদপুরের এক চাকরিজীবী অভিভাবক মো. আকবর হোসেন বলেন, "বাস চালু হওয়ার পর থেকে জিপিএস ও সিসিটিভি থাকার কারণে আমি নিশ্চিন্তে আমার সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে পারছিলাম। যদি এই সেবা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে হাজারো অভিভাবক বিপাকে পড়বেন।"
জনমনে উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. শরিফ উদ্দিন বলেন, "এখনই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। জ্বালানি খরচ মেটাতে শিক্ষার্থীদের কন্ট্রিবিউশন বাড়ানোর বিষয়ে স্কুলপ্রধানদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি যেন সেবাটি চালু রাখা যায়।"