টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ধসের ঝুঁকি, চট্টগ্রামে খোলা হলো ৭ আশ্রয়কেন্দ্র

টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ধসের আশঙ্কা বাড়ায় চট্টগ্রামে পাহাড়ঘেঁষা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের সরিয়ে নিতে শুরু করেছে প্রশাসন। গত ৪৮ ঘণ্টায় বন্দর নগরীতে থেমে থেমে ভারী বৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় পাহাড়ঘেঁষা আকবরশাহ, বায়েজিদ ও খুলশী এলাকার বাসিন্দাদের জন্য সাতটি জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশন।
তবে বারবার সতর্কতা সত্ত্বেও অনেক বাসিন্দা আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে অনীহা প্রকাশ করছেন। বৃষ্টি কমলে তারা আবার নিজেদের বাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন।
চট্টগ্রামের পাহাড়ঘেঁষা ঝুঁকিপূর্ণ বসতিতে প্রায় ১০ হাজার মানুষ বসবাস করে বলে জানিয়েছে প্রশাসন। এসব বাড়ি-ঘরের বেশিরভাগই অস্থায়ী এবং ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি ঢালের পাদদেশে গড়ে উঠেছে। ঝুঁকি বাড়তে থাকায় জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খাবার ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী মজুত রাখা হয়েছে।
আকবরশাহ এলাকায় উচ্ছেদ ও স্থানান্তর তদারকি করা সহকারী কমিশনার (ভূমি) হুসাইন মোহাম্মদ বলেন, 'রাতের বেলায় অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে থাকছেন, তবে দিনের বেলায় বৃষ্টি থামলে তাঁরা আবার বাসায় ফিরে যাচ্ছেন।' তিনি জানান, সোমবার রাতে আকবরশাহর দুটি আশ্রয়কেন্দ্রে ২০০ থেকে ৩০০ জন আশ্রয় নেন এবং সেখানে খাবার ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করা হয়।
তিনি আরও বলেন, 'পাহাড়ের পাদদেশ থেকে ৩০ ফুটের মধ্যে যারা বাস করে, তাদের সরিয়ে নেওয়াকেই আমরা সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছি।'

এদিকে, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর সব সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত জারি করেছে। বুধবার সকালে দেওয়া এক বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়, চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে আগামী ২৪ ঘণ্টায় আরও ভারী বৃষ্টি হতে পারে, ফলে ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ছে।
চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও হিল ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য সচিব সাদিউর রহমান জাদিদ জানান, শহরকে পাঁচটি জোনে ভাগ করে সরিয়ে নেওয়ার কাজ চলছে। তিনি বলেন, 'সাতটি আশ্রয়কেন্দ্র ইতোমধ্যে চালু আছে। পর্যাপ্ত খাবার মজুত রয়েছে এবং স্বেচ্ছাসেবকরা দিনরাত কাজ করছেন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে মানুষ সরিয়ে নিতে।'
তিনি আরও জানান, এবার ভারী বৃষ্টি হলেও আগের মতো জলাবদ্ধতা দেখা যায়নি। অনেক এলাকায় নালা-নর্দমার উন্নয়নের কারণে পানি জমে থাকেনি। কয়েকটি নীচু এলাকায় অল্প সময়ের জন্য পানি জমেছিল, তবে তা দ্রুতই নেমে যায়।
তবুও পাহাড়ধসের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। হিল ম্যানেজমেন্ট কমিটি চট্টগ্রাম শহরের ২৬টি পাহাড়ে ৬ হাজার ৫৫৮টি বাড়িকে ভূমিধসপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এসব এলাকায় অবৈধভাবে পাহাড় কাটা, নির্মাণকাজ ও উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।

চট্টগ্রামে পাহাড়ধসের ইতিহাস মর্মান্তিক। গত ১৬ বছরে সেখানে ৩০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটে ২০০৭ সালে। তখন ১১টি স্থানে ধস নেমে প্রাণ হারান ১২৭ জন।
এমন দুর্ঘটনার পরও পাহাড় কেটে গড়ে ওঠা অবৈধ বসতি ও নিয়ন্ত্রণহীন নগর উন্নয়ন বন্ধ হয়নি। চলতি বছরের শুরুর দিকে কোরিয়ান ইপিজেড এলাকায় এক পাহাড়ধসে আরও দুজনের মৃত্যু হয়—যা নিরাপত্তাবিধি উপেক্ষা ও পরিবেশ ধ্বংসের পরিণতি হিসেবে আবারও সতর্ক করে দেয়।
প্রশাসন বলছে, অবৈধ বসতি ও পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দোষীদের বিরুদ্ধে জরিমানা ও জেল—দুই ধরনের শাস্তিই দেওয়া হবে।
তবে পরিবেশবাদী ও স্থানীয়রা বলছেন, স্থায়ী আবাসনের সমাধান এবং সঠিক নগরপরিকল্পনা ছাড়া প্রতি বর্ষায় এসব সরিয়ে নেওয়া কার্যক্রম কেবল অস্থায়ী সমাধান হয়ে থাকবে।
এ মুহূর্তে প্রশাসন পাহাড়ঘেঁষা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের সতর্কতা মেনে চলা এবং আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করার আহ্বান জানিয়েছে। পাহাড়তলির এলাকায় মাইকিং করে লোকজনকে সচেতন করা হচ্ছে এবং নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সাদিউর রহমান বলেন, 'আমরা আরেকটি দুর্ঘটনা যেন না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে সবকিছু করছি। তবে মানুষের জীবন রক্ষায় আমাদের সবার সম্মিলিত সহযোগিতা দরকার।'