এস আলমের গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক যেভাবে ২,২৫৯ কোটি টাকার লোকসানকে ১২৮ কোটি টাকা মুনাফা দেখিয়েছে

বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান—গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের—২০২৩ সালের আর্থিক প্রতিবেদন এখন প্রমাণিতভাবে একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত জালিয়াতি হিসেবে সামনে এসেছে, যেখানে ব্যাংকটির প্রকৃত আর্থিক অবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র তুলে ধরা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য প্রকাশিত এক অডিট প্রতিবেদনে, চাঞ্চল্যকর এই জালিয়াতির তথ্য উঠে এসেছে, যেখানে দেখা গেছে—গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক প্রকৃতপক্ষে ২,২৫৯ কোটি টাকার বিশাল লোকসান দিলেও, ব্যাংকটির ব্যালেন্স শিট বা স্থিতিপত্রে কারসাজির মাধ্যমে দেখিয়েছে ১২৮ কোটি টাকার মুনাফা।
এই প্রতারণাকে আরও গভীর করেছে, ব্যাংকটির ৫ শতাংশ নগদ এবং ৫ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ট বা লভ্যাংশ ঘোষণার সিদ্ধান্ত। যদি এই ঘোষণা অনুমোদিত হতো, তাহলে এই ভুয়া ১২৮ কোটি টাকার তথাকথিত মুনাফা মূলত বিতরণ হতো এস আলম, তার পরিবার এবং সহযোগীদের সঙ্গে যুক্ত শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে।
এই আর্থিক ভেলকিবাজির জন্য ব্যাংকটির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদ অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে 'উইন্ডো ড্রেসিং'-এর আশ্রয় নেয়। তারা ব্যাংকটির বিপুল পরিমাণ মন্দ ঋণ (নন-পারফর্মিং লোন) গোপন করে, যা প্রভিশনিংয়ের বাধ্যবাধকতা এড়াতে ও কৃত্রিমভাবে মুনাফা বাড়িয়ে দেখাতে করা হয়েছিল।
২০২৪ সালের ৮ আগস্ট ব্যাংকের নির্ধারিত বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) – এই জালিয়াতিপূর্ণ হিসাব অনুমোদনের কথাও ছিল, যেটি আর অনুষ্ঠিত হয়নি। সভাটি বাতিল করা হয় ঠিক তিন দিন আগে, ৫ আগস্ট, যেদিন ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক এক গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। লীগের এই রাজনৈতিক বিপর্যয় অজান্তে হলেও সেই ১২৮ কোটি টাকার 'ভুয়া' মুনাফা বিতরণকে ঠেকিয়ে দেয়। নাহলে এসব অর্থ মূলত এই ভাঁওতাবাজির নেপথ্য কুশীলবদেরই পকেটে যাওয়ার কথা ছিল।
'পরিসংখ্যানের জালিয়াতি' ফাঁস করলেন হুইসেলব্লোয়ার
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক এবং বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন এই কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে এনেছেন। টিবিএসকে তিনি জানিয়েছেন, শুধু ২০২৩ সালের প্রতিবেদনই নয়, আগের কয়েক বছরের আর্থিক প্রতিবেদনগুলোর নির্ভরযোগ্যতা নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে।
"ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনে পরিসংখ্যানগত দুর্নীতি হয়েছে," মন্তব্য করেন নুরুল আমিন। "প্রকৃত খেলাপি ঋণের (এনপিএল) পরিমাণ গোপন রাখা হয়েছিল। যেসব ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার কথা— সেগুলোকে নিয়মিত হিসেবে দেখানো হয়েছে, যাতে খেলাপির হার কম দেখানো যায় এবং মুনাফা কৃত্রিমভাবে বাড়ানো যায়।"
তিনি জানান, ২০২৩ সালে ব্যাংকটি তাদের খেলাপি ঋণ ৩ শতাংশেরও কম দেখিয়েছিল। অথচ প্রকৃত এনপিলের হার ছিল অনেক বেশি — ২০২৪ সালে তা ৮৭ থেকে ৯০ শতাংশে পৌঁছেছে। বিপুল এই পার্থক্যই বলে দেয়, কীভাবে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি ব্যাংককে—চটকদার বার্ষিক প্রতিবেদনের আড়ালে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।
নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নজরে
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ২০২৩ সালের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন যাচাইকারী অডিট প্রতিষ্ঠান শফিক বসাক অ্যান্ড কো. চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস এখন বিতর্কের মূল কেন্দ্রে। ব্যাংকিং ও পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি) — ওই হিসাবে স্বাক্ষরকারী অডিটরসহ সব পক্ষের ভূমিকা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।
এফআরসি'র চেয়ারম্যান মো. সাজ্জাদ হোসেন ভূঁইয়া টিবিএস'কে বলেন, "এই ভুল প্রতিবেদন বা জালিয়াতি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নাকি অডিটরদের কাছ থেকে এসেছে, তা নির্ধারণ করতে হবে, এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার-ও সুযোগ রয়েছে।"
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মুখপাত্র আবুল কালাম জানান, "কমিশন বিষয়টি তদন্ত করবে। কোনো অনিয়ম প্রমাণিত হলে, আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ২০২৩ সালের প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় একাধিক পক্ষ জড়িত ছিল। এই অনিয়মের পেছনে মূলত সবারই দায়িত্বজ্ঞানহীন ভূমিকা রয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী মিথ্যা আর্থিক তথ্য প্রকাশের জন্য জরিমানার বিধান রয়েছে।
অডিট প্রতিষ্ঠানের ব্যাখ্যা ও সংশোধিত হিসাব
শফিক বসাক অ্যান্ড কো. চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের একজন পার্টনার টিবিএস-কে জানান, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ২০২৩ সালের আর্থিক প্রতিবেদন প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারে প্রস্তুত করা হয়েছিল। তিনি বলেন, "এখন যেহেতু ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন হয়েছে, আর পূর্ববর্তী প্রতিবেদনটি অনুমোদিত হয়নি, তাই নতুন করে পুনঃঅডিটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর ফলে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন প্রভিশনিং নির্দেশিকা অনুযায়ী মন্দ ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়েছে, যার ফলেই এই বিশাল লোকসান উঠে এসেছে।"
প্রথমে প্রকাশিত ২০২৩ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে, ব্যাংকটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) দেখানো হয়েছিল ১ টাকা ৩০ পয়সা। তবে প্রতিবেদন পুনর্মূল্যায়নের পর দেখা যায়, প্রতি শেয়ারে লোকসান দাঁড়িয়েছে ২১ টাকা ৭৯ পয়সা। এই সংশোধিত তথ্য গতকাল বুধবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
সংশোধিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৩ সালের শেষে শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ মূল্য (এনএভি) দাঁড়িয়েছে মাইনাস ৯.১৪ টাকা এবং নিট অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো (এনওসিএফপিএস) দাঁড়ায় ঋণাত্মক ০.১৬ টাকা। ব্যাংকটির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০২২ সালের হিসাবের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে ব্যাংকটি তার বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) আয়োজন করতে পারেনি, ফলে ঘোষিত লভ্যাংশ অনুমোদিত হয়নি বা বিতরণও করা হয়নি। ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, আগামী ১৯ আগস্ট এজিএম অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে এই লভ্যাংশ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
২০২৩ সালের প্রথম আর্থিক প্রতিবেদনে বলা হয়, মোট ১৩,১৪১ কোটি টাকা বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণ (এনপিএল) ছিল ৩৪২.৭২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের মাত্র ২.৬১ শতাংশ। তবে ব্যাংকটির সূত্রগুলো জানিয়েছে, প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ইচ্ছাকৃতভাবে কম দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিযুক্ত অডিটরদের করা নিরীক্ষায় দেখা গেছে, প্রকৃত খেলাপির পরিমাণ ছিল ২,০২৮ কোটি টাকা — যা মোট ঋণের প্রায় ২৫ শতাংশ।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে এবং লোকসানের পরিমাণ আবারও ২,০০০ কোটি টাকার ঘর ছাড়াতে পারে।
বিএসইসি'র এক কর্মকর্তা বলেন, আন্তর্জাতিক আর্থিক মানদণ্ড অনুযায়ী যেকোনো অর্থবছরের আর্থিক তথ্য সংশোধনের সুযোগ আছে। অনেক সময় নিয়ন্ত্রক সংস্থা সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে তথ্য সংশোধন ও পুনঃপ্রকাশের নির্দেশ দেয়।
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, "আর্থিক প্রতিবেদনে সঠিক চিত্র না উপস্থাপনের পেছনে কোনো প্রণোদনা ছিল কি না, তা তদন্ত করা জরুরি। সেক্ষেত্রে সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।"
আইপিও এবং শেয়ারে মূল্য ধস
২০২২ সালে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ৪২৫ কোটি টাকা উত্তোলন করে, যা ওই বছরের জুন মাসে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) অনুমোদন দেয়। প্রতিটি শেয়ার ১০ টাকা মূল্যে ইস্যু করা হলেও—বর্তমানে ব্যাংকটির শেয়ারের দর নেমে এসেছে মাত্র ৩ টাকা ৩০ পয়সায়।
বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) যথাসময়ে না হওয়ায় ব্যাংকটির শেয়ার 'জেড' ক্যাটাগরিভুক্ত হয়েছে এবং সেই ক্যাটাগরিতেই লেনদেন হচ্ছে।
আইপিও থেকে তোলা অর্থের মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে (এসএমই) বিনিয়োগ করা হয়েছে ১০০ কোটি টাকা; সরকারি সিকিউরিটিজ ও বন্ডে ২৬৮.৫০ কোটি টাকা; তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজ ও বন্ডে ৫০ কোটি টাকা এবং আইপিও সংশ্লিষ্ট ব্যয়ে সাড়ে ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
সরকার পতনের পর বোর্ড পুনর্গঠন ও সংস্কার প্রচেষ্টা
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর, ২৯ আগস্ট গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়। পুরোনো বোর্ড ভেঙে দিয়ে, নতুন বোর্ডে ৫ জন স্বাধীন পরিচালককে নিয়োগ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বোর্ড চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন জানান, আগের ম্যানেজমেন্টের সময় ব্যাংকের প্রকৃত আর্থিক অবস্থা গোপন রাখা হয়েছিল। তিনি বলেন, "বর্তমান বোর্ড আগস্টে দায়িত্ব নিয়েছে, ফলে ২০২৩ সালের আর্থিক প্রতিবেদনের সঙ্গে আমাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।"
তিনি জানান, তাঁরা দায়িত্ব নেওয়ার সময় ব্যাংকে মারাত্মক তারল্য সংকট ছিল। ২০২৩ সালের ঘোষিত লভ্যাংশ পরিশোধে প্রয়োজন ছিল ১৮০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকের কাছেও ছিল না। তখনই বাংলাদেশ ব্যাংকে পুনঃনিরীক্ষার আবেদন করা হয় এবং তাতেই প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ পায়।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, "বাংলাদেশ ব্যাংকের নিযুক্ত অডিটর ছাড়াও— আমাদের অভ্যন্তরীণ ও বাইরের অডিটররা যৌথভাবে নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই ব্যাংকের প্রকৃত আর্থিক চিত্র প্রকাশ্যে আসে।"
নুরুল আমিন আরও জানান, ব্যাংকের মোট ১২-১৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ দেয়া হয়েছে, এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন বা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানে, যা পুনঃউদ্ধারে চরম জটিলতা সৃষ্টি করেছে। তিনি মনে করছেন, ২০২৪ সালেও ব্যাংকটি বিপুল পরিমাণ লোকসানে পড়বে এবং খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে।
"আমরা ব্যাংকটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি," বলেন আমিন। ব্যয় সংকোচন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তারল্য সহায়তা চেয়ে ব্যাংক পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা চলছে। এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ২,৫০০ কোটি টাকার তারল্য সহায়তা পেয়েছে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক।