আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের উত্থান যেভাবে

নব্বইয়ের দশকে ঢাকার মগবাজারের বিশাল সেন্টার ঘিরে উত্থান হয় শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের।
তিনি এই বিপণিবিতানের কাছে চাংপাই নামে একটি রেস্টুরেন্টের কর্মচারী ছিলেন। সেখান থেকে ধীরে ধীরে অপরাধজগতের সঙ্গে জড়িয়ে যান। পরে বিশাল সেন্টারই হয়ে ওঠে তার কর্মকাণ্ড পরিচালনার কেন্দ্র। এ জন্য অনেকে তাকে 'বিশালের সুব্রত' নামেও চেনেন।
একপর্যায়ে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, দখলবাজিতে অদ্বিতীয় হয়ে ওঠেন সুব্রত বাইন। তখন তিনি থাকতেন নয়াটোলা আমবাগানে। ক্রমে তিনি ওই এলাকায় মূর্তমান এক আতঙ্ক হয়ে ওঠেন।
আধিপত্য বিস্তার করে দরপত্র নিয়ন্ত্রণ ও বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজিতে তার নাম আসা ছিল তখনকার নিয়মিত ঘটনা। এসব কাজ করতে গিয়ে অসংখ্য খুন-জখমের ঘটনাও ঘটেছে।
সুব্রত বাইনের নামে ৩০টিরও বেশি খুনের মামলা রয়েছে, যার প্রায় সবগুলোতেই সাজাপ্রাপ্ত তিনি। এছাড়া অবৈধ অস্ত্র এবং চাঁদাবাজিসহ প্রায় ১০০ মামলার আসামি তিনি।
আরও পড়ুন: ছাত্ররা জানতেনই না তাদের বাড়ির নিচতলাতেই থাকেন শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে তাকে ধরিয়ে দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। পুরস্কার ঘোষিত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম এই সুব্রত বাইন। এরপরই সুব্রত বাইন ভারতে পালিয়ে যান। পরবর্তীকালে তিনি সেখানেই গ্রেপ্তার হন।
২০০৩ পর্যন্ত সুব্রত বাইন ছিলেন ঢাকার অপরাধ জগতের প্রভাবশালী চক্র 'সেভেন স্টার'- গ্রুপের প্রধান।
শীর্ষ এ সন্ত্রাসী আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকার রেড কর্নার নোটিশপ্রাপ্ত।
সুব্রত বাইন কলকাতার কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার পর পালিয়ে চলে যান নেপালে। সেখানে গিয়ে আবার ধরা পড়ের। এরপর সুড়ঙ্গ করে নেপাল কারাগার থেকে পালিয়ে সুব্রত বাইন আবার কলকাতায় চলে আসেন। সেখানে আবারও ধরা পড়ে। সেই থেকে কলকাতার কারাগারেই ছিলেন।
আওয়ামী লীগ আমলে সুব্রত বাইনকে ফেরত আনতে কূটনৈতিক চ্যানেলে একাধিকবার যোগাযোগ করে সরকার। এরপর দুবছর আগে সুব্রত বাইনকে গোপনে ফেরত পাঠানো হয়।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, প্রায় আড়াই বছর আগে ভারতের জেলখানা থেকে ছাড়া পায় শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন। এরপর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ গোপনে পুশব্যাকের মাধ্যমে তাকে বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে তুলে দেয়। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে এ হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
কিন্তু তাকে আদালত না পাঠিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সরাসরি গোপন বন্দিশালায় নিয়ে যায়।
একটি সূত্র জানায়, ৫ আগস্টের পর গোপন বন্দিশালা থেকে সুব্রত বাইন ছাড়া পেয়ে ফের চাঁদাবাজি শুরু করেন। মগবাজারের বিশাল সেন্টার ঘিরে আবারও গড়ে তোলেন বিশাল বাহিনী।
জানা যায়, ২৯ সেপ্টেম্বর হঠাৎই বিশাল সেন্টারে যান সুব্রত বাইন। তবে সেখানকার পুরোনো ব্যবসায়ীরা তাকে প্রথমে চিনতে পারেননি। মুখে দাড়ি রেখেছেন, চেহারায়ও বেশ পরিবর্তন এসেছে। তখন মুরাদ নামের এক ব্যক্তি তাকে সুব্রত বাইন বলে পরিচয় করিয়ে দেন। একটি দোকান দখলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন বলে জানা যায়।
আরও পড়ুন: শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন কুষ্টিয়া থেকে গ্রেপ্তার
হঠাৎ সুব্রত বাইনের আগমনের খবরে বিশাল সেন্টারের ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কারণ, এই মার্কেট থেকে সুব্রতকে একসময় প্রতি বর্গফুটে দুই টাকা করে দিতে হতো। তবে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদের মাঝামাঝি সময়ে এসে ওই টাকা দেওয়া ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। সুব্রত বাইনের আগমনের পর নতুন করে আবার চাঁদা দিতে হতে পারে—ব্যবসায়ীদের মধ্যে এমন আশঙ্কা তৈরি হয়।
আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী মতিঝিলের ইখতিয়ারের [মালিবাগ সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশ হত্যা মামলার আসামি] মাধ্যমে বেশ কিছু অত্যাধুনিক অস্ত্র কিনেছেন সুব্রত বাইন।
বর্তমানে থানা থেকে লুট হওয়া প্রায় ১৭টি অস্ত্র রয়েছে তার হাতে। সুব্রত বাইনের ডান হাতখ্যাত পুরস্কার ঘোষিত আরেক সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদের মাধ্যমে মতিঝিল গোপীবাগের একটি ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন সুব্রত।
এছাড়া, সুব্রত বাইন সুইডেন আসলামের সঙ্গে দেখা করে কাওরান বাজার একসঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারেও সমঝোতা করেছেন। এরপর থেকে তাকে ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর শুরু করেন।
আজ (২৭ মে) সকাল ৭টার দিকে কুষ্টিয়া শহরের কালিশংকরপুর এলাকার একটি বাড়ি থেকে ঢাকা থেকে যাওয়া সেনাবাহিনীর একটি দল তাকে গ্রেপ্তার করে।