৯ মাস লিবিয়ায় মানব পাচারকারীদের নির্যাতনের শিকার, মুক্তিপণ দিয়ে বাড়ি ফিরেছেন তানজির শেখ

দীর্ঘ নয় মাস লিবিয়ার মানব পাচারকারী মাফিয়া চক্রের টর্চার সেলে বন্দী ও অমানবিক নির্যাতনের শিকার হওয়া তানজির শেখ (২২) মুক্তি পেয়ে কুষ্টিয়ায় নিজ গ্রামের বাড়িতে ফিরেছেন।
তানজিরকে বিবস্ত্র করে বেধড়ক মারপিটের ভিডিও পরিবারকে পাঠিয়ে মুক্তিপণ দাবি করা হতো। মুক্তিপণ নিয়ে পরবর্তীতে তাকে ছেড়ে দেয় মানবপাচার চক্র। বুধবার (৯ জুলাই) সকাল সাড়ে ৭টায় বুরাক এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে দেশে ফেরেন তানজির।
কুষ্টিয়া পৌরসভার ২০ নম্বর ওয়ার্ডের জগতী স্টেশন বাজার এলাকার সিরাজ শেখের ছেলে তানজির। আড়াই বছর আগে কুষ্টিয়ার রবিজুল নামের এক দালালের মাধ্যমে টুরিস্ট ভিসায় লিবিয়ায় গিয়েছিল সে। ভুক্তভোগী পরিবারের কাছে থেকে দফায় দফায় ৩৪ লাখ টাকা নিয়েছে রবিজুল। সেসব টাকা ফেরতসহ রবিজুলের শাস্তি চান ভুক্তভোগী পরিবার।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, 'মানব পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। এসব মামলা গুলো আমরা গুরুত্বের সাথে তদন্ত করে দেখছি। কয়েকজন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তানজিরের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখা হবে এবং এ ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে।'
তানজিরের সাথের আরেক ভুক্তভোগী ঝিনাইদহের মতিউর রহমান সাগরও মুক্তি পেয়ে তার গ্রামের বাড়িতে ফিরেছেন। আইনি জটিলতা কাটিয়ে এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের প্রত্যাবাসন সম্পন্ন হয়েছে। তাদের ফিরিয়ে আনতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড, ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন-এর (আইওএম) লিবিয়া মিশন এবং লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
লিবিয়ার মানবপাচার চক্রের টর্চার সেলে তানজির ও সাগরের মতো প্রায় ৩০০ জন বাংলাদেশিকে বন্দী করে নির্যাতন করা হয়। ভুক্তভোগীদের বাড়ি মাদারীপুর, মাগুরা, শরীয়তপুর, সিলেট, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, নওগাঁ, নাটোরসহ বিভিন্ন এলাকায়। বন্দীদের পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
লিবিয়ায় মাফিয়াদের বন্দিশালায় দীর্ঘ নয় মাস বন্দী থাকা তানজির শেখ বলেন, 'মুক্তিপণের দাবিতে আমাকে বন্দী করে রাখা হয়। বেঁধে রাখতো, তিনবেলা লোহার রড ও লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটানো হতো। নির্মমভাবে নির্যাতন-মারপিট করা হয়। কঠোর অত্যাচার করা হতো। খাবার দিতো না, তিনবেলা শুধু মারতো।' মারতে মারতে তার শরীর ফাটিয়ে ফেলা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, 'ক্ষত জায়গায় ইনফেকশন হয়ে পচে যেতো। কোনো ঔষধ দিতো না। ভাত দিত না। সারাদিনে ৫ টাকা দামের একটা পাউরুটি ও অল্প একটু লবণাক্ত পানি খেতে দিত। লবণাক্ত পানি খাওয়ার কারণে শরীর আরও বেশী পচে যেতো। না খাওয়ার কারণে শরীর একদম শুকিয়ে যায়। সকল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে যায়। এজন্য মার খেতে খেতে অনেকে মরে যায়। মনে হতো আমিও মারা যাবো।'
তিনি বলেন, '৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ৯ মাস পর আমি মুক্তি পেয়েছি। আমার সাথে ওইখানে থেকে ঝিনাইদহের সাগর নামে একজন মুক্তি পেয়েছে। আমরা ছাড়া পাওয়ার আগের রাতে দুজন মারা গেছে। তাদের একজনের বাড়ি কুমিল্লায়।'
তানজিরের চোখের সামনেই তাদের দুজনকে পিটিয়ে মারা হয় বলে জানান তিনি।
মাফিয়াদের আস্তানায় বন্দীদের তিনবেলা মারধর করা হতো জানিয়ে তানজির বলেন, 'মারের চেয়ে উকুনের অত্যাচার ছিল আরও যন্ত্রণাদায়ক। উকুনকে জীবন শত্রু মনে হতো। আমি ও সাগর বন্দীখানায় ঢোকার তিনদিন পরে একজন বন্দী পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। আমাদের চোখের সামনে এ ঘটনা ঘটেছে। আমার চোখের সামনে তিনজনকে মেরে ফেলা হয়েছে।'
যারা বিদেশে যেতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে তানজির শেখ বলেন, 'লিবিয়া মাফিয়াতে ভরা। দালালের মাধ্যমে লিবিয়াতে গিয়ে আমি ও ঝিনাইদহের মতিউর রহমান সাগর দুজন নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছি। এজন্য দালালের মাধ্যমে লিবিয়াতে যাওয়ার দরকার নেই।'
বাঙালিদের প্রলোভন ফাঁদে ফেলে লিবিয়া মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করা হয় উল্লেখ করে তানজির বলেন, 'এরপর আটকে রেখে মুক্তিপণের টাকা আদায় করার জন্য নির্যাতন করা হয়। তাদের নির্যাতনে অনেকে মারাও যায়। দালালের মাধ্যমে লিবিয়াতে গিয়ে ঠিকমতো হাঁটা চলাফেরা করা যায় না, ঠিকমতো থাকা খাওয়া ও কাজ করা যায় না। কোনো নিরাপত্তা পাওয়া যায় না।'
চক্রের এক সদস্য কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পাটিকাবাড়ি এলাকার রবিজুল ইসলাম। তার মাধ্যমেই লিবিয়ায় যান তানজির।

রবিজুলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে তানজির বলেন, 'রবিজুল লিবিয়াতে দীর্ঘ ১২ বছর ছিল। মাফিয়া চক্রের সাথে রবিজুল দালালের সুসম্পর্ক। সেও ওই চক্রের সদস্য। আমার বাবা রবিজুলের মাধ্যমে আমাকে লিবিয়ায় পাঠিয়েছিল।'
তিনি বলেন, 'টুরিস্ট ভিসায় আমাকে প্রথমে দুবাই পাঠিয়েছিল। সেখানে তিন দিন থাকার পর মিশরে পাঠান। সেখানে সিয়াম নামের তাদের দালালের কাছে ২১ দিন ছিলাম। এরপর তার মাধ্যমে লিবিয়াতে পাঠানো হয়। সেখানে একটি মাদ্রাসায় চাকরি দেন। সেখানে ১৯ হাজার টাকা বেতন দিত। এই টাকা কিছুই হয় না। সেখানে অনেক কষ্ট হতো। ৯ মাস বুকে কষ্ট চাপা রেখে চাকরি করি।'
'এরপর আমি দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিই। বিষয়টি রবিজুল জানতে পারে। এরপর ভালো কাজ দিবে বলে আমার বাবার কাছে থেকে আরো সাড়ে ৭ লাখ টাকা নেন। এরপর সে আমাকে লিবিয়ার মাফিয়া চক্রের কাছে বিক্রি করে দেয়। তারা আমাকে নিয়ে ফাঁকা একটি জায়গায় তাদের বন্দীখানায় নিয়ে যায়। এরপর আমার ওপরে নির্যাতন-মারপিট শুরু করে। তিনটি ঘরে ১০০ জন করে মোট ৩০০ জনকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল।'
তানজির বলেন, 'দালাল রবিজুল আমাদের বলেছিলো- থাকা খাওয়া ফ্রি এবং মাসে ৪০ হাজার টাকা বেতন। সে প্রলোভন দেখিয়ে আমাকে লিবিয়ায় পাঠান এবং লিবিয়ার মাফিয়া চক্রের কাছে বিক্রি করে দেন। এরপর থেকে মুক্তিপণ আদায় করতে আমার ওপরে মধ্যযুগীয় বর্বরতা শুরু করে মাফিয়া চক্রটি।'
তিনি বলেন, 'রবিজুল আমার পরিবারের কাছ থেকে ৩৪ লাখ টাকা নিয়েছে। আমি আমাদের টাকা ফেরত চাই, একই সাথে রবিজুলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। তাকে দ্রুত গ্রেপ্তার করা হোক।'
এই চক্র সম্পর্কে ভুক্তভোগী যুবক আরও বলেন, 'লিবিয়ার ওই মাফিয়া চক্রে ১৫-২০ জন সদস্য রয়েছে। তাদের মধ্যে ৫ থেকে ৭ জন লিবিয়ার নাগরিক। প্রধান মাফিয়া লিবিয়ার আলী। উনি ওসামার ভাগ্নে বলে পরিচিত। মাফিয়া চক্রের সাথে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন যুক্ত আছে। তাদের বাসা মাদারীপুর, সিলেট ও শরীয়তপুর। তাদের মধ্যে একজনের নাম পিচ্চি সোহেল, তার বাড়ি মাদারীপুর আর কুষ্টিয়ার রবিজুল।'
তানজির বলেন, 'লিবিয়ার বন্দিশালায় আমার মত প্রায় ৩০০ জন বাংলাদেশিকে বন্দী করে অমানবিক নির্যাতন করা হতো। ৭ লাখ টাকা মুক্তিপণের জন্য আমাকে মারতে মারতে গুরুতর অসুস্থ করে ফেলেছিল। টাকা না দিলে তাদের নির্যাতন চলতেই থাকে। ফ্রিতে কাউকে ছাড়ে না। টাকা দিলে ছেড়ে দেয়।'
দীর্ঘ ৯ মাস বন্দী থাকার পর অবশেষে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান তানজির। তিনি বলেন, 'ট্যাক্সিতে করে একটা জায়গায় আমাদের নামিয়ে দেয়। এরপর সাগরের মামার কাছে আমরা আশ্রয় নিই। সেখানে কিছুদিন থাকার পর দূতাবাসের মাধ্যমে আমরা দেশে ফিরে আসি।'
তানজিরের বাবা সিরাজ শেখ বলেন, 'ভালো চাকরি ও ভালো বেতনের প্রলোভন দিয়ে আমার ছেলেকে লিবিয়ায় পাঠায় রবিজুল। তার সাথে ১১ লাখ টাকায় কন্ট্রাক্ট ছিল। প্রথমে ৫ লাখ টাকা দিই, এরপর আমার ছেলেকে লিবিয়াই পাঠিয়ে দেয়। এরপর বাকি ৬ লাখ টাকা পরিশোধ করি। এরপর ইতালি পাঠানোর কথা বলে আমার ছেলেকে মাফিয়া চক্রের কাছে বিক্রি করে দেয়।'
ছেলে বন্দী থাকা অবস্থায় রবিজুল আরও ২৫ লাখ টাকা দাবি করে বলে জানান সিরাজ শেখ। তিনি বলেন, 'এর কিছুদিন পর রবিজুল পালিয়ে আত্মগোপনে যায়। এরপর নলখোলা গ্রামের আলামিন নামের একজন আমাদের সাথে যোগাযোগ করে এবং আমার ছেলেকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করবে বলে প্রলোভন দেয়। সে ১৮ লাখ ৩০ হাজার টাকা নেয়। এতে কোন কাজই হয়নি। এরপরে মাফিয়াদের পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে আমি আমার ছেলেকে ছাড়িয়ে এনেছি। রবিজুল ও আলামিনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। একই সাথে আমি আমার টাকা ফেরত পেতে চাই।'
তানজিরের মা বলেন, 'রবিজুল দালাল প্রলোভন দিয়ে আমার ছেলেকে বিদেশে পাঠায়। এরপর তাকে মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। মাফিয়ারা মুক্তিপণের দাবিতে আমার ছেলেকে বেধে নির্মমভাবে নির্যাতন করে, মারপিট করেছে। আমার ছেলে মরা মানুষের সাথে শুয়ে ছিল।'
তিনি বলেন, 'রবিজুল আমাদের ৩৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে। এর প্রতিবাদ করতে গেলে রবিজুল আমার ছেলেকে মেরে ফেলার হুমকি দিতো। আমরা গরিব মানুষ। সবকিছু বিক্রি করে ও ধারদেনা করে এই টাকা দিয়েছি। আমরা টাকা ফেরত চাই। রবিজুল ও আলামিনের শাস্তি চাই।'
অভিযুক্ত কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পাটিকাবাড়ি ইউনিয়নের পাটিকাবাড়ি গ্রামের মিয়াপাড়ার আয়নাল মণ্ডলের ছেলে। তার সাথে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি।