জ্বালানি তেল থেকে ফল, চাহিদার মন্দায় চট্টগ্রাম বন্দরে যেসব পণ্যের আমদানি কমেছে

জ্বালানি তেল, ফার্নেস অয়েল, ক্লিংকার ও বিদেশি ফলসহ বাংলাদেশ সরকারের সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আয়কারী কয়েকটি পণ্যের আমদানি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের তথ্য এ বাস্তবতা তুলে ধরেছে।
এটি নিছক পরিসংখ্যানগত বিচ্যুতি নয়—বরং একটি গভীরতর অর্থনৈতিক চাপের লক্ষণ।
দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ আমদানি যে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে হয়, সেখানে শুধু ভোগ্যপণ্য নয়, উৎপাদন ও অবকাঠামো খাতের জন্য অত্যাবশ্যকীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি, লোহা, ইস্পাত ও অন্যান্য বেস মেটালের আমদানিও কমেছে। ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের জন্যও অপরিহার্য এসব পণ্য।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাহিদার এ মন্দার পেছনে আছে দেশে বিনিয়োগ চাহিদা কমে যাওয়া, এলসি মার্জিন বৃদ্ধি, আমদানি শুল্কের উচ্চ হার এবং দীর্ঘস্থায়ী ডলার সংকট ব্যবসায়িক আস্থায় ধস নামিয়েছে।
এই পতন ঘটেছে এমন এক সময়ে, যখন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৭৫ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের রেকর্ড করেছে, যা আগের অর্থবছর ২০২৩-২৪ এ ছিল ৬৮ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা।
তবে এই সংখ্যার আড়ালে রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন: রাজস্ব প্রবৃদ্ধি এসেছে আমদানির পরিমাণ থেকে নয়, বরং সীমিত সংখ্যক পণ্যের ওপর অধিক হারে শুল্ক আরোপের মাধ্যমে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, দেশের অর্থনীতির গ্রোথ রেটই (প্রবৃদ্ধির হার) বাড়েনি। এর প্রভাবে জ্বালানি তেল, ক্লিংকার এবং ফল আমদানি কমে গেছে। আমদানি কমে যাওয়ার আরো বিভিন্ন ফ্যাক্টর রয়েছে। তবে আমদানির এই ধস যদি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার প্রতিফলন হয়, তাহলে তা অর্থনীতির জন্য আশঙ্কাজনক।"
জ্বালানি আমদানিতে চাপ, ডলার সংকট ও নীতিগত পদক্ষেপ
বাংলাদেশে আমদানি করা বিভিন্ন জ্বালানির মধ্যে রয়েছে হাই স্পিড ডিজেল তেল, ফার্নেস তেল, পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিন খনিজ ও অপরিশোধিত তেল থেকে প্রাপ্ত তেল। আমদানিকৃত জ্বালানি তেল বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার উৎপাদন, পরিবহন এবং কৃষিসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন এসব জ্বালানির অধিকাংশ আমদানি করে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে ডিজেল আমদানি আগের বছরের তুলনায় ২১.৬৫ শতাংশ কমে গেছে, ফার্নেস অয়েল কমেছে ১০.২২ শতাংশ, এবং পেট্রোলিয়াম তেল আমদানি ১৬.৭৫ শতাংশ। জ্বালানি তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া, পরিবহন খাতে তেলে পরিবর্তে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া, তেলের চাহিদা কমে যাওয়া ও টাকার অবমূল্যায়নসহ বেশ কয়েকটি কারণে জ্বালানি তেল আমদানি কমেছে বলে জানিয়েছে বিপিসি সূত্র।
নাম না প্রকাশের শর্তে বিপিসির কর্মকর্তারা বলেন, তেলের ব্যবহার বা চাহিদা কমে যাওয়া আমদানি হ্রাসের অন্যতম কারণ। এছাড়া ডলার সংকটও ভূমিকা রেখেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুর দিকে ব্যাংকগুলো চাহিদা অনুযায়ী ডলার সরবরাহ করতে না পারায়, জ্বালানি তেলের বিল পরিশোধে হিমশিম খেতে হয় বিপিসিকে। ডলার সংকটের কারণে একদিকে বাড়তে থাকে বকেয়া, অন্যদিকে বিল পরিশোধে সরবরাহকারী বিদেশি তেল কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকেও চাপ বাড়তে থাকে। এসব কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জ্বালানি তেল আমদানিতে বিরূপ প্রভাব পড়ে।
চট্টগ্রাম বন্দরে রাজস্ব আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস ছিল হাই-স্পিড ডিজেল। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ডিজেল আমদানি আগের বছরের ৩৫.৬৭ লাখ টন থেকে কমে ২৭.৯৪ লাখ টনে নেমে এসেছে — অর্থাৎ ২১.৬৫ শতাংশ বা ৭.৭২ লাখ টন কমেছে।
বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য ও অপারেশন্স) মণি লাল দাশ টিবিএসকে বলেন, "ডিজেল এখন বেসরকারি খাতেও আমদানি হচ্ছে। বিভিন্ন পেট্রোকেমিক্যাল কোম্পানির কাঁচামালের বাই-প্রোডাক্ট (উপজাত) হিসেবেও জ্বালানি তেলের জোগান হচ্ছে। যেমন বসুন্ধরার গ্রুপের বিটুমিন প্ল্যান্টের ক্রুড বিটুমেন প্রক্রিয়াজাত করে প্রায় ২০ শতাংশ ডিজেল পাওয়া যাচ্ছে।"
রাজস্ব আয়ের আরেকটি অন্যতম উৎস—ফার্নেস অয়েলের আমদানি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২০.৯৫ লাখ টন থেকে কমে ১৮.৮০ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে, অর্থাৎ তা কমেছে ১০.২২ শতাংশ।
রাজস্ব আদায়ের দিক দিয়ে চতুর্থ নাম্বারে থাকা পেট্রোলিয়াম অয়েল আমদানি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১৭.০৫ লাখ টন থেকে কমে ১৪.১৯ লাখ টনে নেমে এসেছে — অর্থাৎ ২.৮৬ লাখ টন বা ১৬.৭৫ শতাংশ কমে গেছে।
ক্লিংকার আমদানিতে নির্মাণ খাতের মন্দাভাব স্পষ্ট
সিমেন্ট উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানিও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১,৬৫৮ লাখ টন থেকে কমে ১,৬১৭ লাখ টনে নেমে এসেছে, অর্থাৎ বার্ষিক হিসাবে ২.৪৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
যদিও শতাংশ হারে এই পতন তুলনামূলক কম, তবুও এটি নির্মাণ ও সরকারি প্রকল্পখাতে সামগ্রিক মন্থরতাকেই তুলে ধরে। ক্লিংকার ছিল আমদানিকৃত পণ্যের মধ্যে রাজস্ব আয়ের দিক থেকে তৃতীয় স্থানে।
বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বলেন, "রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মেগা প্রকল্পগুলোর গতি কমে গেছে। অনেক বড় ঠিকাদার এখন পলাতক। অবকাঠামো নির্মাণও কমে গেছে। ফলে সিমেন্টের ক্লিংকার আমাদনি কম। আমদানি করা ক্লিংকারের এখনো প্রায় ৫ শতাংশ অব্যবহৃত আছে।"
ফল আমদানিতে ধস: শুল্ক বেড়েছে, এলসি কঠোর
চট্টগ্রাম কাস্টমসের বেশি রাজস্ব আয় হওয়া পণ্যের মধ্যে রয়েছে আপেল, মেন্ডারিন বা কমলাসহ বিভিন্ন ধরনের ফল। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তার আগের অর্থবছরের তুলনায় আপেল আমদানি কমেছে ১১.২৭ শতাংশ। একই সময়ে মেন্ডারিন আমদানি কমেছে ২২.৭৬ শতাংশ।
ফল আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, ফল আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি, ফলকে বিলাসজাতীয় পণ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে এলসি মার্জিন বাড়িয়ে শতভাগ করাসহ বিভিন্ন কারণে এর আমদানি কমে গেছে।
"ফল পুষ্টির জন্য অপরিহার্য, বিলাসপণ্য নয়," মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, "আমরা এখন প্রতি কেজি আপেলের ওপর ১০৫.৮০ টাকা শুল্ক দিচ্ছি, যেখানে আগে ছিল ৯০ টাকা। এছাড়া মেন্ডারিন (কমলা), নাশপতিতেও কেজি প্রতি ১৫ টাকার বেশি এবং আঙ্গুর কেজি প্রতি ২৪ টাকা বাড়তি শুল্ক দিতে হচ্ছে।"
তিনি জানান, অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি আমদানিকারক ইতোমধ্যে বাজার থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন, কারণ এত কড়া শর্তের ব্যবসা পরিচালনা করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি পরিমাণের দিক থেকে আপেল ছিল পঞ্চম অবস্থানে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আপেল আমদানি কমে দাঁড়িয়েছে ১.৩৯ লাখ টনে, যেখানে আগের বছর ছিল ১.৫৭ লাখ টন।
অন্যদিকে রাজস্ব আয়ের দিক থেকে ১৫তম স্থানে থাকা মেন্ডারিন বা কমলালেবুর আমদানি ২২.৭৬ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৫৩,২২০ টনে, যা আগের বছর ছিল ৬৮,৯০৭ টন।
কাস্টমসের মূল্যায়িত দামের দিক থেকে আপেল আমদানি কমেছে ৩৫.৮৪ শতাংশ।
ফলের এই আমদানি হ্রাস ভোক্তা সাধারণের ক্রয় সক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ার-ও ইঙ্গিত দেয়, কারণ বাংলাদেশে গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের উপরে অবস্থান করছে।
ইস্পাত ও লোহা আমদানি
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত শিল্পখাতে গুরুত্বপূর্ণ লৌহ, ইস্পাত এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ধাতুর আমদানি ৪.৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৪.৪ শতাংশ কমেছে।
একই সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে আরও বড় ধস নেমেছে। এ খাতে আমদানি ২২ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ২.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে।