ব্যাংকের প্রতি ১০ টাকা আয়ের ৬–৭ টাকাই এখন আসে বন্ড থেকে, কিন্তু আর কতদিন?
২০২৫ সালের শুরুতে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের চিত্র ছিল মলিন — আমানতের সুদের হার বেড়ে যাওয়া, মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকা, ঋণের চাহিদায় মন্থরতা, মার্জিন সংকুচিত হওয়া এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা—সব মিলিয়ে ব্যাংকগুলোর মুনাফা সংকটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।
কিন্তু বাস্তবে ঘটল উল্টোটা। প্রত্যাশা ছাপিয়ে বেসরকারি ব্যাংকের মুনাফা কেবল টিকে থাকেনি, বরং বেড়েছে—বিশেষত যেগুলোকে বলা হয় "ভালো ব্যাংক"।
এর পেছনের কারণ ছিল না ঋণ সম্প্রসারণ বা নতুন ব্যবসায়িক সাফল্য—বরং লাভের বড় উৎস হয়ে উঠেছে সরকারি বন্ড ও ট্রেজারি বিল থেকে অর্জিত আয়। সরকারি সিকিউরিটিজই এখন ব্যাংকগুলোর নতুন লাইফলাইন, যা কার্যত পুরো খাতের ব্যালান্স শিট বদলে দিয়েছে।
ব্র্যাক ব্যাংক: ট্রেজারিই এখন ত্রাতা
ব্র্যাক ব্যাংকের ক্ষেত্রে পরিবর্তনটি ছিল চোখে পড়ার মতো। ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ব্যাংকটির বিনিয়োগ আয় ছিল প্রায় ৭০০–৮০০ কোটি টাকার মধ্যে, কিন্তু ২০২৪ সালে তা রেকর্ড ২,৮৮০ কোটি টাকায় পৌঁছায়। অর্থাৎ মাত্র দুই বছরে প্রায় চারগুণ বেড়েছে।
২০২৩ সালে বিনিয়োগ আয় বেড়েছিল ৬৭ শতাংশ, আর ২০২৪ সালে আরও ১২৭ শতাংশ। যা ব্যাংকটির ঋণের সুদ বা অন্যান্য ফি থেকে অর্জিত আয়ের চেয়ে অনেকটা বেশি।
২০২৫ সালের প্রথম ৯ মাসে ব্যাংকটির নিট মুনাফা আগের বছরের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ১,৫৫৩ কোটি টাকায়। তবে একই সময়ে নেট ইন্টারেস্ট ইনকাম (ঋণ ও আমানতের সুদ পার্থক্য) প্রায় ৭ শতাংশ বা ১০০ কোটি টাকা কমেছে।
অর্থাৎ, ব্যাংকের আয় টিকিয়ে রেখেছে ট্রেজারিতে বিনিয়োগ থেকে হওয়া আয়।
জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে এই বিনিয়োগ আয় ১,৪২৯ কোটি টাকা বা ৭৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩,৩৯৪ কোটি টাকায়। ফলে মোট পরিচালন আয় (অপারেটিং ইনকাম) বেড়েছে ২২ শতাংশ। আর মোট পরিচালন আয়ের ৫৫.৩ শতাংশই এসেছে ট্রেজারি খাত থেকে, যা এক বছর আগে একই সময়ে ছিল ৪২ শতাংশ।
ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারেক রেফাত উল্লাহ খান বলেন, "আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতার কারণে প্রচুর আমানত পাচ্ছি, কিন্তু ঋণ দেওয়ার সুযোগ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। অতিরিক্ত তারল্য যদি সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করে না রাখতাম, তাহলে আমানতের সুদের হার কমাতে হতো।"
তবে তিনি বন্ডের আয় উৎসকে "অস্থায়ী ও অটেকসই" বলে উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলেন, "আমি সহকর্মীদের বলেছি, এই অস্থায়ী ইনকামের ওপর নির্ভর না করতে। তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে, কিন্তু শিল্প খাত মন্থর, আর বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬ শতাংশের কাছাকাছি নেমে এসেছে—এ অবস্থায় আর কী করা সম্ভব?"
সিটি ব্যাংক: ঋণ নয়, বন্ডেই টিকে থাকা
সিটি ব্যাংকের ক্ষেত্রে এই ধারা আরও স্পষ্ট। ২০২৫ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে ব্যাংকটির কর-পরবর্তী মুনাফা ৬০ শতাংশ বেড়ে ৭২২ কোটি টাকারও বেশি, যার প্রায় পুরোটাই এসেছে সরকারি সিকিউরিটিজ বা বন্ডে বিনিয়োগ থেকে।
ব্যাংকের বিনিয়োগ আয় এক বছরে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে হয়েছে ২,৭৭৫ কোটি টাকা, যা আগের বছর ছিল ১,০২০ কোটি টাকা। এখন এই বিনিয়োগ আয় মোট পরিচালন আয়ের প্রায় ৭৭ শতাংশ, অর্থাৎ ৩,৬২২ কোটি টাকা পরিচালন আয়ের মধ্যে মূল অংশই এসেছে ট্রেজারি থেকে।
এদিকে উচ্চ আমানত খরচ ও দুর্বল ঋণ চাহিদার কারণে ব্যাংকের মূল ঋণ ব্যবসা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর প্রমাণ, সিটি ব্যাংকের নিট সুদ আয় প্রায় ৮৭ শতাংশ হ্রাস পেয়ে এক বছর আগের ১,১৭২ কোটি টাকা থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৫০ কোটি টাকায়।
৮৮৫ কোটি টাকার উচ্চ প্রভিশন এবং পরিচালন ব্যয় বাড়ার পরও সিটি ব্যাংক লাভজনক অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছে ট্রেজারি বন্ড ও বিল থেকে রেকর্ড আয় করার কারণে।
পুঁজিবাজারের একজন বিশ্লেষক মন্তব্য করেন, "এই প্রবৃদ্ধি ঋণ থেকে আসেনি, বরং বন্ড বাজারের ওপর ভর করে টিকে থাকার কৌশল। সিটি ব্যাংকের ট্রেজারি ডেস্কই আসলে তাদের পুরো আর্থিক বিবরণীকে স্বচ্ছল রেখেছে।"
ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল): স্থিতিশীলতার ভরসা ট্রেজারিতেই
বিনিয়োগে সাধারণত রক্ষণশীল ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল)–ও এই বন্ডের জোয়ার থেকে বাদ যায়নি। ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ব্যাংকটির বিনিয়োগ আয় দ্বিগুণ হয়ে— ৫০৫ কোটি থেকে বেড়ে ১,০১৭ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, অর্থাৎ তা বেড়েছে ১০১ শতাংশ।
চলতি বছরেও সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। ২০২৫ সালের প্রথম ৯ মাসে ইবিএলের বিনিয়োগ আয় আরও ৩৯ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ১,০৯৫ কোটি টাকায়, যা এখন ব্যাংকের মোট পরিচালন আয়ের ৪৮ শতাংশ। আগের বছরে যা ছিল ৩৯ শতাংশ।
অন্যদিকে, ব্যাংকের নিট সুদ আয় ১০ শতাংশ কমে ৭১২ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। অর্থাৎ, ঋণের সুদ ব্যবধানের পরিবর্তে ট্রেজারি রিটার্নই এখন ব্যাংকের মুনাফার প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে। ইবিএলের মোট পরিচালন আয়ের মধ্যে নিট সুদ আয়ের অবদান এখন ৩৯ শতাংশ, যা এক বছর আগে ছিল ৩১ শতাংশ।
ইবিএলের মোট বিনিয়োগ পোর্টফোলিওর ৮৬ শতাংশই এখন সরকারি সিকিউরিটিজে নিয়োজিত, যা ২০২০ সালে ছিল ৭৯ শতাংশ।
ইবিএলের এক সিনিয়র ট্রেজারি কর্মকর্তা বলেন,"ঋণ প্রবৃদ্ধি মন্থর, খেলাপির ঝুঁকি বাড়ছে, তারল্যের অস্থিরতা বাড়ছে — এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো ঝুঁকিমুক্ত সম্পদেই আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছে।"
এমটিবি: ম্লান হয়েছে মূল আয়ের মার্জিন
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি)-এর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি একেবারেই বিপরীতমুখী বা বলা যায় এক ধরনের বৈপরীত্যপূর্ণ চিত্র তৈরি করেছে।
২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে ব্যাংকটির নিট সুদ আয় আগের বছরের তুলনায় ৫৮ শতাংশ হ্রাস পেয়ে প্রায় ৬২৯ কোটি টাকা থেকে নেমে এসেছে ২৬৩ কোটি টাকার নিচে। বিপরীতে, বিনিয়োগ আয় প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৭৩ কোটি টাকায়।
ফলে এমটিবির মোট পরিচালন আয়ের ৬০ শতাংশই এখন আসে বিনিয়োগ থেকে, যেখানে গত বছর এই হার ছিল মাত্র ৩৭ শতাংশ। অর্থাৎ, ব্যাংকের মুনাফার ইঞ্জিন এখন ঋণ ব্যবসা থেকে সরে গিয়ে সরকারি সিকিউরিটিজ নির্ভর হয়ে পড়েছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমাদের মূল ব্যাংকিং কার্যক্রম থেকে আয় বেশ কমে গেছে, কারণ বাজারে ঋণ চাহিদা কমে গেছে।"
তিনি আরও যোগ করেন, "আসলে এটা শুধু এমটিবির নয়, প্রায় সব ব্যাংকের জন্যই বাস্তবতা। খেলাপি ঋণ বেড়েছে, আমানতের সুদহারও বেড়েছে, আর ব্যাংকগুলোর ব্যালান্সশিট এখন আর আগের মতো সম্প্রসারিত হচ্ছে না — ফলে মূল ব্যাংকিং আয়ের জায়গাটা একেবারেই সংকুচিত হয়ে পড়েছে।"
প্রাইম ব্যাংকের মুনাফা যেভাবে বেড়েছে
২০২৪ সালে প্রাইম ব্যাংকের আয় বৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি ছিল সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ হতে আয়, যেখানে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের উচ্চ রিটার্ন মূল সুদ আয়ের সংকোচনকে পুষিয়ে দেয়।
ব্যাংকটির বিনিয়োগ আয় এক বছরে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে ২০২৪ সালে দাঁড়ায় ১,০২৭ কোটি টাকায়, যা ২০২৩ সালে ছিল মাত্র ৫১৩ কোটি টাকা। এর ফলে ব্যাংকের মোট পরিচালন আয় ১৫.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২২.৫ শতাংশে এসেছে এই বিনিয়োগ থেকেই। এই উত্থান এসেছে মূলত সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডের ভালো মুনাফার ফলে। অনেক ব্যাংকই এখন ঝুঁকিমুক্ত ও তুলনামূলকভাবে বেশি রিটার্ন পেতে ট্রেজারি ও বন্ডে বিনিয়োগ করেছে।
২০২৫ সালে এসে এই প্রবণতা আরও বেগবান হয়েছে।
চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে প্রাইম ব্যাংকের নিট সুদ আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭৩৯ কোটি টাকা থেকে নেমে এসেছে ৩৭৫ কোটি টাকায়। তবু ব্যাংকের মোট পরিচালন আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,৯৬২ কোটি টাকায়, যা প্রায় ১৮৫ কোটি টাকার বৃদ্ধি নির্দেশ করে।
এই উত্থানের প্রধান উৎস–সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত আয়ের উল্লম্ফন। এই খাতে আয় এক বছরে প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ৬৯৩ কোটি টাকা থেকে পৌঁছেছে ১,২২১ কোটি টাকার বেশি।
ফলে এখন প্রাইম ব্যাংকের মোট অপারেটিং আয়ের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই আসে বিনিয়োগ খাত থেকে, মূল ঋণ ব্যবসার পরিবর্তে।
ব্যাংক এশিয়া: ঋণ নয়, এখন মুনাফার ভরসা ট্রেজারি আয়ে
সবচেয়ে নাটকীয় পরিবর্তন দেখা গেছে ব্যাংক এশিয়ায়।
২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকটির নিট সুদ আয় ঘুরে দাঁড়িয়েছে নেতিবাচক অবস্থায়— যেখানে ২০২৪ সালের একই সময়ে ব্যাংকটি ৩৫৩ কোটি টাকার মুনাফা করেছিল, সেখানে ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে ক্ষতি হয়েছে ১১০ কোটি টাকা।
তবে বিপরীতে, ব্যাংকের বিনিয়োগ আয় প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,২৪৮ কোটি টাকায়, যা আগের বছরের ৬৪৬ কোটি টাকার তুলনায় বড় উল্লম্ফন।
এই আয় এসেছে মূলত সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ড থেকে, যা ব্যাংকের সম্ভাব্য মুনাফা পতনকে এককভাবে ঠেকিয়ে দিয়েছে।
বর্তমানে ব্যাংক এশিয়ার মোট অপারেটিং আয়ের প্রায় প্রতি ১০ টাকার মধ্যে ৯ টাকাই আসছে বিনিয়োগ খাত থেকে, যেখানে ২০২৪ সালে এই অনুপাত ছিল অর্ধেকেরও কম।
ডাচ-বাংলা ব্যাংক: আয় বেড়েছে, কিন্তু নির্ভরতা এখন বন্ডের ওপর
ডাচ-বাংলা ব্যাংকের (ডিবিবিএল) আয়ও অনেকাংশে ট্রেজারির আয়ের ওপর নির্ভর করছে।
২০২৪ সালে ব্যাংকটির বিনিয়োগ আয় ৩০৫ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,০৪৭ কোটি টাকায় — মূলত সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বড় অঙ্কের বিনিয়োগের ফলেই।
একই সময়ে ব্যাংকের নিট সুদ আয় ৩১ শতাংশ বাড়ে, কারণ ডিবিবিএল ঋণের সুদের হার বাড়াতে পেরেছিল আমানতের খরচ বৃদ্ধির চেয়ে দ্রুত গতিতে।
তবে ২০২৫ সালের প্রথমার্ধের চিত্র ভিন্ন। এ সময়ে ব্যাংকটির বিনিয়োগ আয় আগের বছরের তুলনায় ১২৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৯৩৫ কোটি টাকা, অথচ নিট সুদ আয় ১৩ শতাংশ কমে গেছে। ফলে ব্যাংকের মোট পরিচালন আয়ের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি এখন আসে ট্রেজারি থেকে, যেখানে এক বছর আগেও এই অনুপাত ছিল মাত্র ২০ শতাংশ।
ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন বলেন, "সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ মানে উচ্চ মুনাফা, কোনো মন্দ ঋণের ঝুঁকি নেই এবং সম্পূর্ণ নিরাপদ। সুদের হার এখন এত বেশি যে, অনেক ব্যাংক ১০ থেকে ২০ বছরের মেয়াদি বন্ডও কিনছে।"
তিনি আরও বলেন, "নতুন বিনিয়োগ নেই, ব্যবসা সম্প্রসারণও নেই— এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো আর কী করবে? না হলে আমাদের আমানতের সুদের হার কমাতে হতো।"
তবে ডিবিবিএল-এর এই সাফল্য এক ধরনের দ্বিমুখী বাস্তবতা তুলে ধরে। দক্ষ ট্রেজারি ব্যবস্থাপনা ব্যাংকটির আয় স্থিতিশীল রেখেছে বটে, কিন্তু মূল ঋণ কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বন্ডনির্ভর মুনাফার প্রবণতা—ব্যাংক খাতের কাঠামোগত দুর্বলতার দিকেই ইঙ্গিত করছে।
দেশজ ঋণ পাঁচ বছরে দ্বিগুণ, সুদের হার এক দশকে সর্বোচ্চ
গত পাঁচ বছরে সরকারের দেশজ বা অভ্যন্তরীণ উৎসের ঋণ দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে, কারণ সরকার ক্রমবর্ধমান বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে বাজার-ভিত্তিক ঋণ গ্রহণের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষে সরকারি সিকিউরিটিজের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৮০ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকায়, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল মাত্র ২ লাখ ৯০ হাজার ২৯০ কোটি টাকা। সরকারি সিকিউরিটিজের জিডিপিতে অনুপাত ১০ শতাংশ বেড়ে হয়েছে থেকে ১১.৫ শতাংশ; আর ছোট সঞ্চয়কারীদের জন্য থাকা সঞ্চয়পত্র ও ক্ষুদ্র-সঞ্চয় স্কিমের দায়ের স্থিতি ৩ লাখ ৪১ হাজার ১৫১ কোটি টাকায় ধীরগতিতে বেড়েছে, যা ছোট সঞ্চয়পত্র থেকে বাজারভিত্তিক ঋণে স্থানান্তরের ইঙ্গিত দেয়।
দেশজ ঋণের মূল স্তম্ভ হিসেবে ট্রেজারি বন্ড-ই রয়ে গেছে, যা পাঁচ বছরে ৮৮ শতাংশ বেড়ে ৪ লাখ ৭ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা হয়েছে। এর পাশাপাশি, ট্রেজারি বিল দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা, কারণ সরকার স্বল্পমেয়াদি উপকরণ ব্যবহার করে তারল্যের চাপ মোকাবিলা করেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে চালু হওয়া সুকুক— বন্ড পোর্টফোলিওতে ১৯,০০০ কোটি টাকা যুক্ত করেছে।
তবে এই পরিবর্তন এসেছে কিছু খরচের সঙ্গে। মহামারির সময় ১ শতাংশের নিচে নেমে যাওয়া সুদ— ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে সমস্ত মেয়াদের জন্য ১২–১৩ শতাংশে পৌঁছেছে, যা এক দশকের সর্বোচ্চ। এর পেছনে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সুদের কড়াকড়ি ও ব্যাংকিং ব্যবস্থায় তরলতার সংকট। একই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেপো অপারেশন এবং তারল্য সহায়তা বেড়ে হয়েছে ৩ লাখ কোটি টাকার বেশি, যা পাঁচ বছরে ছয় গুণ বৃদ্ধি।
একইসময়ে সরকারের বাহ্যিক ঋণও প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৮১ হাজার ৯২৬ কোটি টাকায়, যা জিডিপির ১৯.৫ শতাংশ এবং তা বিদেশি অর্থায়নের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতারকে তুলে ধরে।
তবে কয়েক মাসের ধারাবাহিক বৃদ্ধির পর সেপ্টেম্বরে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার কিছুটা কমেছে, যা ব্যাংকিং ব্যবস্থায় তারল্য পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ঋণের খরচ কিছুটা হ্রাসের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিলাম তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে ১০.০৮ শতাংশে পৌঁছে যাওয়া ৯১-দিনের ট্রেজারি বিলের কাট-অফ রেট ২৯ সেপ্টেম্বরের শেষ নিলামে ধীরে ধীরে ৯.৯১ শতাংশে নেমে এসেছে। অনুরূপ হ্রাস লক্ষ্য করা গেছে ১৮২-দিন ও ৩৬৪-দিনের বিলেও, যা প্রায় ১০.১৩ শতাংশ থেকে যথাক্রমে ৯.৭৯ শতাংশ ও ৯.৬৮ শতাংশে নেমেছে।
দীর্ঘমেয়াদি বন্ডের সুদের হারও মৃদু নেমেছে। মাসের শুরুতে জারি হওয়া ২ বছর মেয়াদি বন্ড ১০.১৭ শতাংশ, ৫ বছরের বন্ড ১০.০৩ শতাংশ, এবং ১০–২০ বছর মেয়াদি বন্ড ৯.৬৭–৯.৯০ শতাংশ রেঞ্জে নেমেছে। গত কয়েক মাসের মধ্যে এই প্রথম মুনাফা বা সুদের কার্ভ ১০ শতাংশের সীমার নিচে হয়েছে।
ঋণচাহিদা কবে বাড়বে?
এই প্রশ্ন বিভিন্ন ব্যাংকের তিনজন এমডি ও চারজন ট্রেজারি প্রধানের কাছে প্রশ্ন রাখা হলে, সবাই একইভাবে আশাপ্রকাশ করেন, নির্বাচনের পরই ঋণচাহিদা বাড়বে।
ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি তারেক রেফাত উল্লাহ খান বলেন, "দেশি-বিদেশি অনেক বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ আগ্রহী, তবে তাঁরা অপেক্ষা করছেন, নির্বাচিত সরকার এলেই তারা বিনিয়োগ করবেন। কিছু বিদেশি বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে আসতে চাচ্ছেন, যাতে মার্কিন শুল্ক সুবিধার সুযোগ নেওয়া যায়।"
তিনি আরও জানান, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরলে অবকাঠামোসহ উন্নয়ন প্রকল্পে নতুন বিনিয়োগ আসবে। নতুন একটি এফএসআরইউ (ফ্লোটিং স্টোরেজ রি-গ্যাসিফিকেশন ইউনিট) স্থাপনের পরিকল্পনাও রয়েছে, যা গ্যাস সরবরাহ বাড়াবে এবং শিল্পখাতে প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে।
তারেক রেফাত বলেন, "আমি আশাবাদী যে বর্তমানের দুর্বল ঋণচাহিদা ২০২৬ সালের মধ্যেই পুনরুদ্ধার হতে শুরু করবে।"
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, নির্বাচন সম্পন্ন হলে ব্যবসায়িক আস্থা ফিরে আসবে এবং ঋণচাহিদাও বাড়বে। তিনি বলেন, "বিনিয়োগকারীরা অপেক্ষা করছেন—সবকিছু নির্ভর করছে পরিস্থিতি কীভাবে গড়ে ওঠে তার ওপর।"
ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও একই মত প্রকাশ করেন।
অর্থনীতিবিদরা যা বলছেন
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকারি সিকিউরিটিজে ব্যাপক বিনিয়োগ করে ব্যাংকগুলো কোনো ভুল করেনি, কারণ বেসরকারি খাতের ঋণচাহিদা তীব্রভাবে কমে গেছে। তবে একইসঙ্গে তিনি ব্যাংকখাতের উদ্ভাবন ও পণ্য বৈচিত্র্যের অভাব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
এই অর্থনীতিবিদ আরও সতর্ক করেন দেশের বর্ধিত অভ্যন্তরীণ ঋণভার নিয়ে। তিনি বলেন, "যদি আমরা নিজস্বভাবে বেশি রাজস্ব সংগ্রহ করতে না পারি, তাহলে ঋণের বোঝা আরও বাড়বে এবং রাজস্ব স্থিতিশীলতার ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।"
