দানব, ভিনগ্রহী প্রাণীর আস্তানা নাকি প্রকৃতির রূপ? বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্যের আড়ালে
আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে এক রহস্যময় অঞ্চল হলো বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল, যার তিনটি কোণা ছুঁয়ে আছে মিয়ামি, বারমুডা এবং পুয়ের্তো রিকোকে। এর কোনো সরকারি হিসেব না থাকলেও, গত এক শতাব্দী ধরে, অসংখ্য জাহাজ আর বিমান এই কুখ্যাত ত্রিভুজের অতল গর্ভে হারিয়ে গেছে, এমনকি পাওয়া যায়নি তাদের কোন চিহ্নও।
এই অঞ্চলের রহস্যময় ও অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যগুলো কিন্তু নতুন নয়। বহু আগেই ক্রিস্টোফার কলম্বাস তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন এখানকার কম্পাসের বিভ্রান্তিকর আচরণ নিয়ে। এরপর ১৯১৮ সালের মার্চ মাসে, মার্কিন নৌবাহিনীর বিশাল জাহাজ ইউ.এস.এস সাইক্লপস যেন এখানে এসে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
কিন্তু এই অঞ্চলের গায়ে 'বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল' তকমা লাগে আরও অনেক পরে, ১৯৬৪ সালের আগস্ট মাসে। ভিনসেন্ট গ্যাডিস নামের একজন লেখক প্রথমবারের মতো এই নামটি ব্যবহার করেন মার্কিন নৌবাহিনীর ফ্লাইট ১৯-এর উধাও হয়ে যাওয়ার এক রোমহর্ষক প্রতিবেদনে। আর সেই প্রতিবেদন প্রকাশের পরেই যেন কল্পকাহিনীর এক অফুরন্ত ঝর্ণা খুলে যায়।
এইসব রহস্যময় অন্তর্ধান জন্ম দিয়েছে নানা রোমাঞ্চকর তত্ত্বের। কেউ বলেন, এর পেছনে রয়েছে সমুদ্রের গভীরে লুকিয়ে থাকা বিশাল দৈত্য বা অতিকায় স্কুইড। আবার কারো মতে, ভিনগ্রহের প্রাণীরাই জাহাজ আর বিমানগুলোকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। অজানা কোনো শক্তির তৈরি রহস্যময় জগৎ কিংবা সমুদ্রের তলদেশে জমে থাকা মিথেন গ্যাসের বিস্ফোরণ—কোনো কিছুই বাদ যায়নি এই রহস্যের জট খোলার চেষ্টায়।
তবে কল্পনার লাগাম ছেড়ে দিলে, বাস্তবতার চিত্রটা কিন্তু অনেকটাই সাদামাটা। বিশেষজ্ঞরা বলেন, কোনো অশুভ শক্তি নয়, বরং প্রকৃতির রুদ্র রূপ, চালকের সামান্য ভুল, জাহাজের ত্রুটিপূর্ণ নকশা আর নির্ভেজাল দুর্ভাগ্য—এই সবকিছু মিলেই এখানকার বেশিরভাগ দুর্ঘটনার পেছনের কারণ।
মার্কিন নেভাল হিস্টোরিকাল ফাউন্ডেশনের ইতিহাসবিদ জন রাইলি বলেন, 'এই পথটি অত্যন্ত ব্যস্ত। ইউরোপীয়দের আবিষ্কারের সময় থেকেই এটি জাহাজ আর বিমানের এক মিলনস্থল। তাই এখানে কিছু দুর্ঘটনা ঘটাটা অনেকটা আমেরিকার ব্যস্ততম হাইওয়েতে গাড়ি দুর্ঘটনার মতো—এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।'
মার্কিন কোস্টগার্ডের লেফটেন্যান্ট এ. এল. রাসেল বলেন: 'আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, প্রকৃতির অকল্পনীয় শক্তি আর মানুষের খামখেয়ালিপনা প্রতি বছর কল্পবিজ্ঞানের গল্পকে বহুবার হার মানায়।'
আসুন, ডুব দেওয়া যাক বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের সেই রহস্যের গভীরে এবং খুঁজে বের করা যাক এর পেছনের সত্য।
ফ্লাইট ১৯: যে ঘটনা জন্ম দিয়েছিল রহস্যের
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্যময় গল্পগুলো চিরকালের জন্য জড়িয়ে আছে ১৯৪৫ সালের ৫ ডিসেম্বরের সেই অভিশপ্ত দিনের সাথে। সেইদিন ঝলমলে বিকেলে, ১৪ জন আরোহী নিয়ে পাঁচটি শক্তিশালী টর্পেডো বোমারু বিমান ফ্লোরিডার নৌঘাঁটি থেকে একটি সাধারণ প্রশিক্ষণের জন্য আকাশে ওড়ে।
প্রশিক্ষক লেফটেন্যান্ট চার্লস টেলরের নেতৃত্বে তাদের লক্ষ্য ছিল একটি ত্রিভুজাকার পথে উড়ে কিছু বোমাবর্ষণের অনুশীলন করা। কিন্তু জিপিএস-বিহীন সেই যুগে, বোমাবর্ষণের পরেই মারাত্মকভাবে পথ হারিয়ে ফেলেন টেলর। তখনকার পাইলটদের ভরসা ছিল কেবল কম্পাসের কাঁটা আর নিজেদের অনুমান।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, টেলরের বিমানের দুটো কম্পাসই তাকে ধোঁকা দিচ্ছিল। তাদের কথোপকথন থেকে জানা যায়, তার হাতে কোনো ঘড়িও ছিল না। আর অথৈ সমুদ্রের মাঝে পথের দিশা দেখানোর মতো কোনো চিহ্নও থাকে না।
দিনের স্নিগ্ধ আলো মিলিয়ে গিয়ে যখন রাতের আঁধার নামল, শান্ত সমুদ্রও তখন হয়ে উঠল হিংস্র আর উত্তাল। দিশেহারা বিমানগুলো একবার এদিকে তো আরেকবার ওদিকে ছুটতে লাগল।
শেষ মুহূর্তে টেলরের মরিয়া পরিকল্পনা শোনা যায়: যখনই কোনো বিমানের জ্বালানি ১০ গ্যালনের নিচে নেমে আসবে, তখনই পাঁচটি বিমান একসাথে সমুদ্রে ঝাঁপ দেবে।
এই অ্যাভেঞ্জার বিমানগুলো 'লোহার পাখি' নামেই পরিচিত ছিল। ইতিহাসবিদ মার্ক ইভান্স বলেন, 'এগুলোকে বানানো হতো ট্যাংকের মতো মজবুত করে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে শত শত গুলি খেয়েও এগুলো ঠিকঠাক ফিরে আসত।'
কিন্তু এই শক্তির একটা দুর্বলতাও ছিল—এগুলো ছিল ভীষণ ভারী। খালি অবস্থাতেই এর ওজন ছিল ১০,০০০ পাউন্ডের বেশি। তাই উত্তাল সমুদ্রে আছড়ে পড়ার সাথে সাথেই এর দ্রুত ডুবে যাওয়া ছিল অবশ্যম্ভাবী। এমন পরিস্থিতিতে কারো বেঁচে থাকার আশা ছিল প্রায় শূন্য, আর সেই হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা পানিতে রাতভর টিকে থাকা ছিল অসম্ভব।
এরপর বিশাল এক তল্লাশি অভিযান শুরু হয়, কিন্তু কোনো মৃতদেহ বা ধ্বংসাবশেষের চিহ্নমাত্র পাওয়া যায়নি।
এই ট্র্যাজেডির এখানেই শেষ নয়। উদ্ধার করতে গিয়ে ১৩ জন ক্রুসহ একটি উদ্ধারকারী বিমানও উধাও হয়ে যায়। এই বিমানটি ছিল 'উড়ন্ত গ্যাস ট্যাংক' নামে কুখ্যাত; সামান্য এক স্ফুলিঙ্গই পারত একে আকাশে উড়িয়ে দিতে। কাছাকাছি থাকা একটি জাহাজ জানায়, তারা একটি বিশাল আগুনের গোলা দেখেছিল—ঠিক সেখানেই, যেখানে বিমানটি থাকার কথা ছিল।
নৌবাহিনীর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এই দুর্ঘটনার জন্য পাইলটের ভুলকেই দায়ী করা হয়। কিন্তু টেলরের পরিবার এর তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং বহু পর্যালোচনার পর শেষ পর্যন্ত কারণ হিসেবে লেখা হয়—'অজানা'।
বাস্তবতার মুখোমুখি
বছরের পর বছর ধরে, আরও অনেক রহস্যময় অন্তর্ধানের ঘটনা এই ত্রিভুজের অশুভ খ্যাতিকে আরও গাঢ় করে তুলেছে।
তবে এর পেছনে কিছু ভৌগোলিক ব্যাখ্যাও রয়েছে। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল পৃথিবীর মাত্র দুটি অঞ্চলের একটি, যেখানে আসল উত্তর দিক এবং চৌম্বকীয় উত্তর দিক একই রেখায় মিলে যায়। এর ফলে কম্পাসের কাঁটা বিভ্রান্ত হতে পারে, যা নাবিকদের জন্য মারাত্মক বিপদ ডেকে আনে।
এখানেই রয়েছে বিশ্বের গভীরতম কিছু সামুদ্রিক খাদ। কোনো ধ্বংসাবশেষ হারিয়ে গেলে তা মাইলের পর মাইল গভীরে এক জলমগ্ন সমাধিতে চিরতরে বিলীন হয়ে যেতে পারে। এখানকার সমুদ্রতলের গড় গভীরতা প্রায় ১৯,০০০ ফুট, যা এক জায়গায় প্রায় ২৭,৫০০ ফুট পর্যন্ত নেমে গেছে।
এরপর আসে এখানকার খামখেয়ালী আবহাওয়ার কথা। আবহাওয়াবিদ ডেভ ফেইট বলেন, এখানকার মূল আতঙ্কের নাম হারিকেন। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো উপসাগরীয় স্রোত বা গালফ স্ট্রিম—সমুদ্রের ভেতরেই যেন এক বিশাল খরস্রোতা নদী। এর উষ্ণ পানি আর তীব্র স্রোত মুহূর্তের মধ্যে শান্ত আবহাওয়াকে ভয়ঙ্কর করে তুলতে পারে এবং জন্ম দিতে পারে বিশাল বিশাল ঢেউয়ের।
ফেইট বলেন, 'যদি স্রোতের বাইরে ঢেউ ৮ ফুট উঁচু হয়, তবে এর ভেতরে তা দুই বা তিনগুণ বেশি হতে পারে।'
কোস্টগার্ড আরও জানায়, এখানকার অপ্রত্যাশিত ঝড়গুলো প্রায়ই ভয়ঙ্কর জলস্তম্ভ তৈরি করে, যা যেকোনো জাহাজ বা বিমানের জন্য সাক্ষাৎ মৃত্যু পরোয়ানা।
তবুও, একদিকে মানুষের ভুল, ত্রুটিপূর্ণ প্রযুক্তি আর প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার মতো সাদামাটা ব্যাখ্যা, আর অন্যদিকে দৈত্যাকার স্কুইডের আক্রমণ বা ভিনগ্রহের প্রাণীদের দ্বারা অপহরণের মতো রোমাঞ্চকর কল্পনা—বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কিংবদন্তিকে উপেক্ষা করার মতো সাধ্য আজই বা কার আছে?
