প্রায় দেড়শ বছর পর মিললো ডুবে যাওয়া জাহাজের রহস্যের জবাব

প্রায় ১৪০ বছর আগে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়ার মাধ্যমে সমুদ্রপথের এক পুরনো রহস্যের অবসান ঘটেছে। ডুবুরি ও অভিযাত্রী ডম রবিনসন প্লাইমাউথ উপকূলে পাওয়া ওই ধ্বংসাবশেষের মধ্যে কিছু ক্রোকারি সামগ্রী পরীক্ষা করে জাহাজটির তথ্য-পরিচয় নিশ্চিত করেন যে এটি ছিল এসএস ন্যান্টেস।
সমুদ্র ইতিহাসবিদ ড. হ্যারি বেনেট বলেন, ডুবুরি দলটি 'সমুদ্রতলের প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে খড়ের গাদায় সুচ খুঁজে পাওয়ার মতো এক অনন্য সাফল্য অর্জন করেছে'।
তিনি জানান, ১৮৮৮ সালের নভেম্বর মাসে কুনার্ড স্টিমশিপ কোম্পানির পরিচালিত এসএস ন্যান্টেস একটি জার্মান পালতোলা জাহাজ—থিওডোর রুগারের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। প্লাইমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ড. বেনেট বলেন, 'জাহাজের নাবিকেরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে জাহাজটি রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন।'
তিনি আরও বলেন, 'এসএস ন্যান্টেস-এর পাটাতনে ফাটল দেখা দেওয়ার পর তা বন্ধ করতে গদি ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাহাজটি ডুবে যায় এবং বহু নাবিক প্রাণ হারান। আনুমানিক ২৩ জন নিহত হন, মাত্র তিনজন বেঁচে ছিলেন।' কর্নওয়ালের টাল্যান্ড বে ও লু উপকূলে ভেসে আসে মৃতদেহ ও ধ্বংসাবশেষ। 'স্থানীয়রা তখন এক বিভীষিকাময় দৃশ্যের মুখোমুখি হন—ছিন্নভিন্ন জাহাজের টুকরো আর মরদেহের স্তূপ।'

ড. বেনেট বলেন, 'এরপর থেকে ওই ধ্বংসাবশেষ কার্যত হারিয়েই যায়। সে সময় স্যাটেলাইট ন্যাভিগেশন ছিল না, তাই ধ্বংসাবশেষের অবস্থান শনাক্ত করাটা ছিল অত্যন্ত কঠিন।' তিনি আরও বলেন, 'যদিও নাবিকেরা জাহাজটি বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত তা কয়েক ঘণ্টা ভেসে থাকার পর সাগরে তলিয়ে যায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তখনও অনেকে জাহাজের ভেতরেই ছিলেন।'
প্রায় ১৪০ বছর পর, ২০২৪ সালে স্থানীয় এক ডুবুরি দল ধ্বংসাবশেষটি শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। ডাইভিংয়ে প্রায় ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ডম রবিনসন জানান, তিনি যুক্তরাজ্যের হাইড্রোগ্রাফিক অফিস থেকে অজ্ঞাত একটি ধ্বংসাবশেষের বিষয়ে জানতে পারেন।
যেভাবে পাওয়া গেল
রবিনসন বলেন, 'ডুব দেওয়ার পরই স্পষ্ট হয়ে যায় এটি একটি পুরোনো ধরনের স্টিমশিপ। ডাইভের একেবারে শেষদিকে আমি একটি ভাঙা প্লেট পাই… সেটি তুলে আনতেই দেখি, এর গায়ে কুনার্ড স্টিমশিপ কোম্পানির ক্রেস্ট খোদাই করা। তখনই মনে হলো—হ্যাঁ, ঠিক এখানেই রয়েছে জাহাজটি।'
ড. বেনেট বলেন, 'ধ্বংসাবশেষের গঠন, মাপ, প্রযুক্তি ও কার্গোর ধরন বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া গেছে, এটি এসএস ন্যান্টেস-ই। তবে সবচেয়ে বড় প্রমাণ সেই প্লেটটি, যার পেছনে 'কুনার্ড'-এর লোগো ছাপানো ছিল—এটি নির্ভুলভাবে প্রমাণ করে, এটি কুনার্ড-এর একটি জাহাজ।'
তিনি আরও বলেন, 'পুরো অনুসন্ধান প্রক্রিয়াটি ছিল প্রায় গোয়েন্দাগিরির মতো অত্যন্ত পদ্ধতিগত।'
রবিনসন বলেন, 'এটি ছিল এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা। যখন আমি এ ধরনের রহস্য উদ্ঘাটন করি এবং সেইসব গল্প বলি, তখন মনে হয় আমি যেন নিশ্চিত করছি—এই মানুষগুলো যেন ভুলে না যান।'
তিনি জানান, প্রাথমিক আবিষ্কারের পর তিনি পুনরায় সেখানে ডুব দেন এবং কুনার্ড-এর আরেকটি ক্রোকারির টুকরো উদ্ধার করেন, যা আবিষ্কারের ক্ষেত্রে আরও একটি নিশ্চিত প্রমাণ হিসেবে কাজ করে।
'এই পৃথিবীতে এখন আর খুব বেশি রহস্য বাকি নেই,' বলেন রবিনসন। 'আমার মতো একজন সাধারণ মানুষ যখন কোনো জাহাজডুবির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করে, তখন সেটি দৈনন্দিন জীবনের গণ্ডি ছাড়িয়ে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়ায়। এটি এক অনন্য অনুভূতি।'
ড. বেনেট বলেন, 'সব কিছু মিলে গেছে, এবং আমি মনে করি স্থানীয় ডুবুরি দল একটি অসাধারণ গোয়েন্দা কাজ করেছে, যা এই সমুদ্রপথের রহস্যময় দুর্ঘটনার সমাধান দিয়েছে।' তিনি আরও বলেন, 'ভিডিও ফুটেজ ও অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার নানা দিক খতিয়ে দেখে আমি নিশ্চিত হয়েছি—এটি যে এসএস ন্যান্টেস, তাতে যুক্তিযুক্ত সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।'