ব্ল্যাক সাবাথের ফ্রন্টম্যান, ব্রিটিশ হেভি মেটাল কিংবদন্তি ওজি অসবোর্ন মারা গেছেন

ব্ল্যাক সাবাথের ফ্রন্টম্যান, ব্রিটিশ হেভি মেটাল কিংবদন্তি ও 'প্রিন্স অব ডার্কনেস' খ্যাত ওজি অসবোর্ন মারা গেছেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।
আজ সকালে পরিবারে সদস্যদের সান্নিধ্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। এক বিবৃতিতে অসবোর্ন পরিবার জানিয়েছে, 'গভীর শোকের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমাদের প্রিয় ওজি অসবোর্ন আজ সকালে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। পরিবারের ভালোবাসার মধ্যেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এই সময়ে আমাদের গোপনীয়তা রক্ষার অনুরোধ জানাচ্ছি।'
তার মৃত্যুর কারণ জানানো হয়নি। তবে গত কয়েক বছর ধরে তিনি নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন।
বিশ্ব সংগীতের অন্যতম আলোচিত ও বিতর্কিত এই শিল্পী মাত্র তিন সপ্তাহ আগে সঙ্গীতজগৎ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন হেভি মেটাল ঘরানার পথপ্রদর্শক, যার কণ্ঠের ভৌতিক সুর এই ধারার বিকাশে বড় ভূমিকা রেখেছিল। একসময় মঞ্চে বাদুড়ের মাথা কেটে খাওয়ার মতো কাণ্ড ঘটিয়ে শোরগোল ফেলে দেন তিনি। মাদকাসক্তির কারণে একসময় নিজের স্ত্রীকে খুনের চেষ্টাও করেছিলেন। পরে জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো 'দ্য অসবোর্নস'-এ পরিবারের সঙ্গে সহজ-সরল উপস্থিতির জন্য দর্শকদের ভালোবাসা কুড়ান।
চলতি মাসের ৫ তারিখ 'ব্যাক টু দ্য বিগিনিং' শীর্ষক এক বিদায়ী কনসার্টে অংশ নিয়ে দীর্ঘদিন পর একসঙ্গে মঞ্চে উঠেছিলেন নিজের গড়া ব্যান্ড ব্ল্যাক সাবাথের সদস্যদের সঙ্গে। ২০০৫ সালের পর এই প্রথম তারা একসঙ্গে বাজান। অসবোর্ন সেদিন দর্শকদের উদ্দেশে বলেন, 'আমি ছয় বছর ধরে শয্যাশায়ী ছিলাম। আমার কেমন লাগছে, সেটা আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না। হৃদয়ের গভীর থেকে ধন্যবাদ জানাই।'

জন মাইকেল অসবোর্ন (ওজি) জন্মেছিলেন ১৯৪৮ সালে, ইংল্যান্ডের বার্মিংহামের অ্যাস্টনে। বাবা-মা দুজনেই ছিলেন কারখানার শ্রমিক। শৈশব কেটেছে দারিদ্র্য আর নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে। ১১ বছর বয়সে একই বয়সী দুই ছেলের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হন—২০০৩ সালে দ্য মিরর-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজেই সেই বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলেন। এছাড়া চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে একবার জেলেও গিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'চুরি-ডাকাতির কাজ আমার একদমই ঠিকঠাক হতো না। একেবারে ব্যর্থ ছিলাম।'
শিল্পাঞ্চলের শ্রমজীবী পরিবেশেরই ছাপ পড়েছিল ওজি-র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগীত প্রকল্প ব্ল্যাক স্যাবাথের সুরে। ভারী ও ভিন্নধর্মী সেই 'সাউন্ড' (শব্দ) বদলে দিয়েছিল ব্রিটিশ রক সংগীতের ধারা। ২০১৭ সালে ব্যান্ডটির বেজ গিটারিস্ট গিজার বাটলার বলেন, 'আমরা চাইছিলাম আমাদের সময়ের দুনিয়াকে যেভাবে দেখতাম, সেটা গানে তুলে ধরতে। আনন্দের পপ গান বানাতে চাইনি। বরং শিল্পাঞ্চলের সেই কঠিন পরিবেশের অনুভূতিই আমাদের গানে তুলে ধরেছি।'
ওজি অসবোর্ন ব্ল্যাক সাবাথের সঙ্গে পাঁচটি সফল অ্যালবাম করার পর মাদকাসক্তির কারণে ১৯৭৯ সালে ব্যান্ড থেকে বাদ পড়েন। পরে ২০১৩ সালে তিনি ব্যান্ডে ফিরে আসেন, 'থার্টিন' (13) অ্যালবাম বের করেন যেটি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের চার্টে শীর্ষে উঠে। ২০১৭ সালে বার্মিংহামে 'শেষ কনসার্ট'-এর পর ২০২৫ সালে পুনর্মিলনের ঘোষণা আসে।
ব্ল্যাক সাবাথ ছাড়ার পর ওসবোর্ন একক ক্যারিয়ার শুরু করেন। ১৯৮০ সালে 'ব্লিজার্ড অব ওজ' অ্যালবাম দিয়ে যাত্রা শুরু করে তিনি ১৩টি স্টুডিও অ্যালবাম প্রকাশ করেন, যার সর্বশেষটি 'পেশেন্ট নাম্বার নাইন'।

তার সবচেয়ে কুখ্যাত ঘটনা ঘটে ১৯৮২ সালে; ডে ময়েন, আইওয়া-তে মঞ্চে একটি মৃত বাদুড়কে প্রপ ভেবে কামড়ে ধরলে পরে হাসপাতালে গিয়ে জলাতঙ্কের প্রতিষেধক নিতে হয়। আগের বছর একটি মিউজিক কোম্পানির বৈঠকে তিনি দুটো কবুতরের মাথাও কামড়ে ফেলেন।
৮০ ও ৯০ দশকে তার কয়েকটি গান ইউকে টপ ৪০-এ উঠে আসে, যেমন 'বার্ক অ্যাট দ্য মুন' ও 'পেরি মেসন'। ২০০৩ সালে মেয়ে কেলির সঙ্গে গাওয়া 'চেইঞ্জেস' গানের জন্য প্রথমবার চার্টের শীর্ষে ওঠেন।
প্রথম স্ত্রী থেলমা-র সঙ্গে তার দুটি সন্তান ছিল। তবে মদে আসক্ত হওয়ার কারণে সেই সম্পর্ক ভেঙে যায়। পরে তিনি শ্যারন-কে বিয়ে করেন, যিনি তার ম্যানেজারও ছিলেন। এই জুটির তিন সন্তান—কেলি, জ্যাক ও অ্যাইমি। শ্যারনের উদ্যোগে ১৯৯৬ সালে 'ওজফেস্ট' নামের মেটাল উৎসব শুরু হয়।
১৯৮৯ সালে মাতাল অবস্থায় শ্যারনকে শ্বাসরোধের চেষ্টা করায় গ্রেপ্তার হন অসবোর্ন। পরে অবশ্য সম্পর্ক ঠিক হয়, যদিও ২০১৬ সালে অন্য এক নারীর সঙ্গে সম্পর্কের কারণে আবারও বিচ্ছেদ ঘটে।
২০০২-২০০৫ সাল পর্যন্ত 'দ্য অসবোর্নস' নামক রিয়েলিটি শোতে পরিবারসহ অংশ নেন, যা জনপ্রিয়তা পায় ও এমি অ্যাওয়ার্ড জেতে।

২০০৩ সালে বাকিংহ্যামশায়ার-এর বাড়িতে কোয়াড বাইক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন ওজি। পরে পারকিন সিনড্রোমে আক্রান্ত হন। ২০১৯ সালে 'নো মোর ট্যুরস টু' নামের শেষ বিশ্বভ্রমণে বের হন, তবে অসুস্থতার কারণে ইউরোপ সফর বাতিল করতে হয়। ২০২৩ সালে এক বিবৃতিতে ওজি বলেন, 'তিনটি অপারেশন, স্টেম সেল চিকিৎসা, দীর্ঘ ফিজিওথেরাপি আর নতুন সাইবারনিক্স (এইচএএল) চিকিৎসার পরও আমি শারীরিকভাবে দুর্বল।'
২০২৫ সালের মে মাসে দ্য গার্ডিয়ান-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ওজি অসবোর্ন জানান, দীর্ঘ চিকিৎসাজনিত কষ্টে তিনি হতাশায় ভুগছিলেন। তিনি বলেন, 'প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বুঝতে পারি, শরীরের আরও কিছু খারাপ হয়েছে। মনে হতো, এর আর কোনো শেষ নেই।' স্ত্রী শ্যারন তখন বলেন, 'তোমার সকালে ঘুম থেকে ওঠার একটা কারণ দরকার।'
এই কারণ হয়ে ওঠে 'ব্যাক টু দ্য বিগিনিং' কনসার্ট, যা বার্মিংহামের ভিলা পার্কে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অসবোর্ন প্রথমে একক পাঁচটি গান গেয়ে শোনান। পরে ব্ল্যাক সাবাথের গিজার বাটলার, টনি আয়োমি ও বিল ওয়ার্ডের সঙ্গে চারটি গান পরিবেশন করেন। বাদুড় আকৃতির সিংহাসনে বসেই তিনি গাইছিলেন; একপর্যায়ে শ্রোতাদের উদ্দেশে বলেন, 'আই অ্যাম আয়রন ম্যান (আমি লৌহ মানব), পাগল হয়ে যাও!'
এই কনসার্টে আরও অংশ নেয় মেটালিকা, স্লেয়ার ও গানস এন' রোজেসের মতো কিংবদন্তি ব্যান্ড।
অসবোর্নকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এলটন জন লেখেন, 'তিনি ছিলেন আমার প্রিয় বন্ধু ও রক সংগীতের পথপ্রদর্শক। সত্যিকারের এক কিংবদন্তি। একইসঙ্গে জীবনে দেখা সবচেয়ে হাস্যরসিক একজন মানুষ। তাকে ভীষণ মিস করব।'