প্রথমবারের মতো নিলামে বেশি দামে ১৭১ মিলিয়ন ডলার কিনল বাংলাদেশ ব্যাংক

বাজারে ডলারের প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় মুদ্রাটির দর ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেওয়ায় ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নিলামের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ১৭১ মিলিয়ন ডলার কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তবে এই ডলার কেনার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাট-অফ রেট নির্ধারণ করেছে ১২১.৫০ টাকা। নিলামে ডলার বিক্রির জন্য অধিকাংশ ব্যাংক ১২০ টাকার আশেপাশে রেট অফার করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ কৌশলের ফলে কম রেটে ডলার বিক্রি করতে চাওয়া ব্যাংকও দাম পেয়েছে বেশি।
কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত এই কাট-অফ রেট নির্ধারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারকে ইঙ্গিত দিতে চেয়েছে যে, ডলারের দর আপাতত এর নিচে নামবে না বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই বেশি দামে ডলার কিনতে প্রস্তুত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন নীতি-নির্ধারণী কর্মকর্তা বলেন, জুনের শেষে রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট (আরইইআর) অনুযায়ী ডলারের দর ছিল ১২১.১৩ টাকা। এর ভিত্তিতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাট-অফ রেট ১২১.৫০ টাকা নির্ধারণ করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মো. কবির আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'আমরা বাজার থেকে কী পরিমাণ ডলার কিনব, তা এখনও নির্দিষ্ট করিনি। বাজার পরিস্থিতি অনুযায়ী যখন প্রয়োজন মনে করা হবে, তখনই আমরা এভাবে অকশনের মাধ্যমে ডলার কিনব।' তিনি আরও জানান, আন্তর্জাতিক লেনদেন বন্ধ থাকার দিনে (গতকাল রোববার) এই প্রক্রিয়া শুরু হলেও এ লেনদেন আজ সম্পন্ন হবে।
কাট-অফ রেট বেশি কেন?
কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেন ব্যাংকগুলোর প্রাথমিক প্রস্তাবের চেয়ে বেশি দর দিয়েছে, তার ব্যাখ্যা দেন একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি বলেন, 'ডলারের দাম যেভাবে কমছিল, তাতে বাজার আতঙ্কিত হয়ে গিয়েছিল। যেহেতু আমাদের ডলারের প্রবাহ এখন অনেক ভালো, সেহেতু এই রেট আরও কমে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।'
ওই ব্যাংকার বলেন, 'ডলারের দাম কমে গেলে আমদানিকারকরা উপকৃত হলেও রপ্তানিকারক ও রেমিট্যান্স প্রেরকরা ক্ষতিগ্রস্ত হতেন। একইসঙ্গে রেমিট্যান্সের একটা অংশ হুন্ডিতে চলে যাওয়ার হুমকিও তৈরি হতো। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশি দামে ডলার কিনে দরকে ঊর্ধ্বমুখী করার সিগন্যাল দিয়েছে।'
বাংলাদেশ ব্যাংক যখন ডলারের রেট সরাসরি নির্ধারণ করত, তখন একটি নির্দিষ্ট রেটে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ডলার কিনত। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে নেওয়া ঋণের শর্ত অনুযায়ী গত মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু করা হয়। এই ঋণ নেওয়ার সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইএমএফকে বলেছিল, আগের মতো সরাসরি বাজারে হস্তক্ষেপ করবে না, কখনও বাজার থেকে ডলার কেনার প্রয়োজন হলে বাজারদরেই কিনবে। 'সে অনুযায়ীই বর্তমানে বাজার থেকে ডলার কেনার ক্ষেত্রে নিলামের আয়োজন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক,' কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরেক নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তা বলেন।
গতকাল ডলার নিলামে এই নীতি অনুমোদন হয়েছে জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, নতুন পলিসি অনুযায়ী একটি অকশন কমিটি গঠন করা হয়েছে। যেসব ব্যাংকের কাছে অতিরিক্ত ডলার রয়েছে, এখন তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই অকশনে অংশ নিয়ে ডলার বিক্রির জন্য দর প্রস্তাব করতে পারবে। ব্যাংকগুলোর কাছে চিঠি দিয়ে রোববার বিকেল ৪টার মধ্যে ইমেইলের মাধ্যমে নিলামে অংশ নেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। ৮-১০টি ব্যাংক নিলামে অংশ নিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মারুফ বলেন, 'বাজারে ডলারের প্রবাহ অনেক বেড়ে গেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনবে, এটা একটা বিশ্বস্বীকৃত পদ্ধতি। কারণ, প্রতিটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকই তাদের হিসাব অনুযায়ী বিনিময় হারকে একটা রেঞ্জের মধ্যে রাখতে চায়। সেই রেঞ্জ বজায় রাখতে তারা ডলার কেনে বা বিক্রি করে।'
'টাকার মান বাড়ানোর মতো অবস্থায় আসেনি বাংলাদেশ'
বাংলাদেশের এখনও মুদ্রার মান বাড়ানোর (অ্যাপ্রিসিয়েশন) সময় আসেনি মন্তব্য করে মারুফ বলেন, 'ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো নিয়মিত তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে। আমরা দীর্ঘদিন আমাদের মুদ্রাকে অবমূল্যায়ন না করে ধরে রেখেছিলাম, ফলে বিনিময় হারে একটা চাপ এসেছিল। বর্তমানে ডলারের দাম নিম্নমুখী ধারায় চলে এসেছে প্রবাহ বাড়ায় এবং সেরকম চাহিদা না থাকায়। তবে এই প্রবণতা সাময়িক, দীর্ঘমেয়াদি নয়। কারণ আমাদের অর্থনীতির সামগ্রিক পরিস্থিতি অনুযায়ী মুদ্রার মান বাড়ানোর মতো অবস্থায় আমরা এখনও আসিনি। '
নিলামে অংশ নেওয়া একটি ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, 'গত কয়েকদিন ধরে ডলারের দাম কমতে থাকায় কোনো ব্যাংকই অতিরিক্ত ডলার হাতে রাখতে চাইছে না। এমন কিছু ব্যাংকও আছে যারা আন্তঃব্যাংক বাজারে ডলার বিক্রি করতে গিয়েও চাহিদামতো দাম ও ক্রেতা পায়নি। ফলে ওই ব্যাংকগুলো কিছুটা প্যানিক করার কারণে ডলারের দাম আরও বেশি প্রভাবিত হচ্ছে।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিলামের মাধ্যমে ডলার কেনায় ডলারের ক্রমাগত দরপতনের প্রবণতা কিছুটা বদলাতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
চাহিদা ও সরবরাহে পরিবর্তন
ব্যাংকগুলো জানিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার রেমিট্যান্সের ডলার কেনার ক্ষেত্রে তারা ১২০ টাকা রেট অফার করেছে। অবশ্য অনেক ব্যাংক দাবি করেছে, তারা ১২০.৫০ টাকা করেও রেমিট্যান্সের ডলার কিনেছে। তবে রেমিট্যান্সের ডলার বিক্রি করা এক্সচেঞ্জ হাউজসলো জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে রেট ২০-৫০ পয়সা বেশি থাকলেও দিনের শেষে কোনো ব্যাংকই ১২০ টাকার বেশি রেট দিতে চায়নি। এর আগে গত সপ্তাহের শুরুতে ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্সের ডলার কেনার ক্ষেত্রে ১২২.৮০ থেকে ১২২.৯০ টাকা দাম দিত।
গত কয়েক বছর ধরে ডলারের বাজারে জোগানোর তুলনায় চাহিদা ছিল অনেক বেশি। এর অন্যতম কারণ ছিল, সরকারি আমদানির অনেক পেমেন্ট বকেয়া পড়ে ছিল। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে এসব পেমেন্ট ক্লিয়ার করার জন্য ডলারের চাহিদা থাকত। পাশাপাশি অনেক বেসরকারি আমদানি ঋণপত্রের (এলসি) পেমেন্টও বকেয়া পড়ে ছিল। ডলারের দাম বাড়তে থাকায় ব্যবসায়ীরা দ্রুত এসব পেমেন্ট করে দিতে চাইছিলেন, যা বাজারের চাপ বাড়িয়ে দিয়েছিল।
তবে আমদানি এলসি খোলার চাহিদা না থাকায় ডলারের চাহিদাও বাড়ছে না মন্তব্য করে আরেকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, 'বর্তমানে বিনিয়োগ হচ্ছে না বললেই চলে। আর বিনিয়োগ না হলে মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামালসহ অনেক আমদানি হয় না।'
তিনি আরও বলেন, 'এখন যা আমদানি হচ্ছে, তার একটা বড় অংশই নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য। ভোগ্যপণ্যের আমদানি সাধারণত একটা স্থিতিশীল অবস্থানে থাকে। এছাড়া আগের যেসব ওভারডিউ আমদানি পেমেন্ট ছিল, সেগুলো এখন আর নেই। ফলে খুব দ্রুত ডলারের চাহিদা বাড়ার কথা না।
'অন্যদিকে আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ অনেক ভালো। রপ্তানি আয়ও ভালো আসছে। সবমিলিয়ে ডলারের সরবরাহ অনেক ভালো। এসব কারণে ব্যাংকগুলোর হাতে এখন ডলারের প্রাপ্যতা বেশি।'