রোডম্যাপ ও অগ্রাধিকার নেই স্বাস্থ্য খাত সংস্কার প্রতিবেদনে: বিশেষজ্ঞরা

দেশের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে প্রথমবারের মতো একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্কার কমিশন। কিন্তু এতে স্বাস্থ্যসেবার নানা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা চিহ্নিত করা হলেও সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ও সুপারিশগুলোয় অগ্রাধিকারের ঘাটতি রয়েছে বলে মত দিয়েছেন স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, এই ঘাটতি কার্যকর নীতিনির্ধারণে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে।
রোববার (১৮ মে) বিকেলে সানেম আয়োজিত 'হেলথ রিফর্ম কমিশন রিপোর্ট: কুইক ফিক্সেস অর ট্রান্সফর্মেশন' শীর্ষক এক ওয়েবিনারে এসব মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা।
ওয়েবিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হেলথ ইকোনমিক্স ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এবং সানেমের অনারারি পরিচালক ড. শাফিউন এন. শিমুল বলেন, "৩২২ পাতার এই প্রতিবেদনে ৩২টি সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। কোনটি মধ্য মেয়াদে, কোনটি দীর্ঘমেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য তা বলা আছে, কিন্তু কোনটি আগে বাস্তবায়ন হবে—সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই।"
তিনি বলেন, "হেলথ সার্ভিস কমিশন গঠনের কাজ আগে হবে, না কি পিএসসির মাধ্যমে জনবল নিয়োগ হবে আগে, সেটাও বলা হয়নি। কোনটা আগে করবো, সে বিষয়ে কোনো রোডম্যাপ নেই। ব্যয় কোথা থেকে আসবে, সেটিও স্পষ্ট নয়।"
ড. শিমুল আরও বলেন, "এই প্রতিবেদন নীতিনির্ধারকদের কাছে বোধগম্য হবে কি না, সেটাও বড় প্রশ্ন। প্রাইমারি কেয়ারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যা ভালো। তবে কীভাবে সেবা দিলে পরিবর্তন আসবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়নি।"
"পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, বা প্রাইভেট সেক্টরকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তা উল্লেখ নেই। স্বাস্থ্য খাতে ফাইন্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে সিন ট্যাক্সের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা রয়েছে, অথচ কোনো স্বাস্থ্যবিমা কাঠামোর রূপরেখা নেই। শূন্যপদের দিকে বেশি নজর দেওয়া হয়েছে, কাঠামোগত সংস্কারের দিকে নয়। ই-হেলথ সংক্রান্ত কোনো কৌশল বা অর্থায়নের পরিকল্পনাও নেই।"
"দুর্গম এলাকায় সেবা কীভাবে পৌঁছাবে তা বলা হয়নি। মানসিক স্বাস্থ্য বা বয়স্কদের স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কেও কিছু বলা হয়নি।"
তিনি আরও বলেন, "প্রতিবেদনে কমিউনিটি ক্লিনিক গুরুত্ব পায়নি। যদিও এর অবকাঠামো আছে এবং বিতর্ক থাকতে পারে মানুষ সেবা পাচ্ছে কি না—তা নিয়ে, তবে এই অবকাঠামো কীভাবে ব্যবহার করা যায়, তা দেখার দরকার ছিল। হয়তো রাজনৈতিক কারণে এই অংশটিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।"
ড. শিমুল বলেন, "এই সরকার যদি মেধাভিত্তিক নিয়োগের সংস্কৃতি চালু করত, আর রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বাদ দিয়ে যারা অপরাধ করেনি, তাদের কাজে লাগাত—তাহলে ভবিষ্যৎ সরকারের জন্য একটা ইতিবাচক দৃষ্টান্ত তৈরি হতো।"
"সংস্কার মানে হচ্ছে পুরনো কাঠামো বদলে নতুনভাবে সাজানো। কিন্তু এই প্রতিবেদনে সেটা হয়নি। এটি কেবল 'কুইক ফিক্স'। প্রতিবেদনে যেহেতু সবাই ডাক্তার, তাই ডাক্তারদের নিয়েই আলোচনা হয়েছে; নার্স, টেকনোলজিস্ট কিংবা অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি," যোগ করেন তিনি।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, "স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে ব্যয় নয়, বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে। এর সুফল পাওয়া যাবে ভবিষ্যতে। শ্রীলঙ্কা ৩০ বছর আগে বিনিয়োগ করেছিল, এখন ফল পাচ্ছে। আমাদের দেশে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কম হলেও দুর্নীতি বেশি।"
তিনি বলেন, "যারা দেশ চালান, তাদের যদি স্বাস্থ্যখাত নিয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি না থাকে, তাহলে এই সংকট কাটবে না।"
"কমিশন রোডম্যাপ দেয়নি, তবে সরকারকে রোডম্যাপ দিতে হবে। এই প্রতিবেদনের মালিকানা শুধু সরকারের নয়, রাজনৈতিক দলগুলোরও। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনও সে ধরনের কোনো রাজনৈতিক অঙ্গীকার দেখা যাচ্ছে না," বলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও সানেমের রিসার্চ ডিরেক্টর মাহতাব উদ্দিন বলেন, "সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের প্রতি এই সমালোচনাগুলো গঠনমূলক। আমরা চাই, এই সমালোচনাগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে হলেও কিছু অংশ বাস্তবায়ন হোক—যার সুফল পাবে দেশের সাধারণ মানুষ।"