ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধী কোটায় নিয়োগ জটিলতা কাটাতে উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার

সরকারি চাকরিতে কোটায় নিয়োগের ক্ষেত্রে—বিশেষ করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য—ন্যায্য, স্বচ্ছ ও বৈষম্যহীন প্রক্রিয়া নিশ্চিতে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা (গাইডলাইন) প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার।
এ লক্ষ্যে গত ২৫ মার্চ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে ১১–সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং ইতোমধ্যেই তারা বৈঠক করে সুপারিশ প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে।
কমিটির সদস্যদের মতে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের নিয়োগে একাধিক সমস্যা রয়েছে। যেমন–সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রার্থীদের চাকরির প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ পার্বত্য অঞ্চলের প্রার্থীদের তুলনায় জটিল।
আবার অন্যদিকে, প্রতিবন্ধী কোটা প্রয়োগের ক্ষেত্রে জন্মগত বা দুর্ঘটনায় প্রতিবন্ধী হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে পার্থক্য করার কোনো নিয়ম নেই এবং যোগ্যতা নির্ধারণে সুস্পষ্ট মানদণ্ড না থাকায় বিভ্রান্তি তৈরি হয়। এর ফলে প্রকৃত প্রার্থীরা বাদ পড়েন এবং কেউ কেউ সুযোগের অপব্যবহারও করে থাকেন।
এসব সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় গাইডলাইনের খসড়া তৈরি করছে মন্ত্রণালয়।
গত বছর সংশোধনের পর সরকারি চাকরির নিয়োগে ৯৩ শতাংশ মেধা ও ৭ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করা হয়। এই কোটায় বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এসব কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট পদ মেধাতালিকা থেকে পূরণ করা হবে।
এর আগে, সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা থাকাকালে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ ছিল ৫ শতাংশ কোটা। তবে গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের পর ২০২৩ সালের ২৩ জুলাই তারিখে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
প্রতিবন্ধী কোটায় নিয়োগে সমস্যা
কমিটর এক সদস্য বলেন, প্রতিবন্ধী কোটায় নিয়োগ নিয়ে মাঝে মাঝে জটিলতা দেখা দেয়। জন্মগত প্রতিবন্ধীদের বাইরে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় অনেকেই প্রতিবন্ধী হন। এদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে গাইডলাইন দরকার। প্রকৃত প্রতিবন্ধী যাতে বাদ না পড়েন, আবার কেউ এই সুযোগের অপব্যবহার করতে না পারেন—সেদিকে নজর দেওয়া হবে।
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী কোটায় নিয়োগে সমস্যা
কমিটির আরেক সদস্য টিবিএসকে বলেন, পার্বত্য অঞ্চলের বাইরেও দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বাস করেন। তাই কোটার ক্ষেত্রে পার্বত্য ও সমতলের আদিবাসীদের সমান অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
তিনি জানান, বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রার্থীরা চাকরির প্রত্যয়নপত্র সার্কেল প্রধানের কাছ থেকে পান, আর সমতলের প্রার্থীদের জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে তা সংগ্রহ করতে হয়। এই প্রক্রিয়া সহজ করার সুপারিশ করবে কমিটি। পাশাপাশি, পিছিয়ে থাকা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার পরামর্শও সরকারকে দেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রার্থীদের প্রত্যয়ন দেওয়ার আগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে প্রতিবেদন চান জেলা প্রশাসক (ডিসি)। ইউএনও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে তথ্য যাচাই করেন। এতে সময় লেগে যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আদিবাসী বলেন, "অনেক সময় মেম্বার-চেয়ারম্যানদের সুপারিশ নিতে ঘুষ বা অনৈতিক সুবিধা দিতে হয়।"
সমতল আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের সদস্য সচিব রিপন চন্দ্র বানাই টিবিএসকে বলেন, "আগে ৫ শতাংশ কোটা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এখন ১ শতাংশে নেমেছে। বাস্তবায়নের ব্যাপারটি নিশ্চিত করা দরকার।"
তিনি বলেন, "নিয়োগ কর্তৃপক্ষ সাধারণত পার্বত্য এলাকার আদিবাসীদের গুরুত্ব দেন। এই প্রবণতা থেকে বের হতে নীতিমালা থাকা দরকার। সকল আদিবাসীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।"
সূত্র জানায়, ৪০, ৪১ ও ৪২তম বিসিএসে সাধারণ ক্যাডারে মাত্র চারজন আদিবাসী প্রার্থী সুপারিশ পেয়েছেন, যা মোট নিয়োগের মাত্র ০.০৫ শতাংশ। অন্যদিকে নন-ক্যাডার ও তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির নিয়োগে পদসংকটের কারণে আদিবাসীরা কোটা সুবিধা পাচ্ছেন না।
তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নিয়োগে কোন এলাকার প্রার্থী আবেদন করতে পারবেন, তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। এতে যেসব এলাকায় আবেদন করা যায়, সেসব স্থানে আদিবাসী না থাকলে অন্যরা কোটা সুবিধা পান।
এই প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি পাঁচটি আদিবাসী সংগঠন কোটাপদ্ধতি পর্যালোচনাকারী কমিটির কাছে যৌথ স্মারকলিপি জমা দিয়েছে। তারা চায়, আদিবাসী চাকরিপ্রার্থীদের জন্য উত্তীর্ণের ন্যূনতম নম্বর প্রচলিত মানের ৮০ শতাংশ করা হোক; লিখিত ও ব্যবহারিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে সরাসরি মৌখিক পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হোক; কোটা বিভাগ, জেলা বা জনসংখ্যার ভিত্তিতে না দেখে জাতীয়ভাবে বিবেচনা করা হোক; প্রার্থী না পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট পদ সংরক্ষণ করা হোক এবং সার্কেল প্রধান ও ডিসির বাইরে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামকেও প্রত্যয়ন দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হোক।