বগুড়ার ঘড়িয়া ও চন্দ্রাবতী নদী কি সত্যিই ‘নিখোঁজ’?

নদী রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা পানি উন্নয়ন বোর্ড বগুড়ার দুটি নদী—২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ঘড়িয়া ও ১৯.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ চন্দ্রাবতীকে আনুষ্ঠানিকভাবে 'নিখোঁজ' ঘোষণা করেছে। এ ঘোষণায় ওই অঞ্চলে নদীর অস্তিত্ব ও সম্ভাব্য দখল নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভাষ্য অনুযায়ী, স্থানীয়দের দাবি—জেলায় এ নামে কোনো নদীর অস্তিত্ব নেই। এ প্রসঙ্গে বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল হক বলেন, 'যদি কেউ এসব নদীর খোঁজ পান, তাহলে আমাদের জানাবেন। তখন আমরা সেগুলো নদীর তালিকায় যোগ করব।'
তবে ঐতিহাসিক নথিপত্র এই দাবিকে খণ্ডন করে। ২০০৯ সালে বগুড়া জেলা প্রশাসনের প্রকাশিত একটি গ্রন্থে দুপচাঁচিয়া উপজেলার চন্দ্রাবতী নদীর উল্লেখ রয়েছে। অপরদিকে, 'বাংলাদেশের নদ-নদীর নাম' শীর্ষক একটি প্রকাশনায় গাবতলী উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ঘরিয়া নদীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্র জানায়, গত বছর ২৫ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জেলার নদীর সংখ্যা নির্ধারণ এবং দখল-দূষণজনিত সমস্যা সমাধানে এক বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়। জেলার শীর্ষ কর্মকর্তাদের মতামত পর্যালোচনার পর সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ঘরিয়া ও চন্দ্রাবতী নদী বাদ দিয়ে বগুড়া জেলায় মোট ২৩টি নদী রয়েছে।
নদী রক্ষার খসড়া জাতীয় তালিকার জন্য মন্ত্রণালয় পরবর্তীতে বোর্ডকে একটি আনুষ্ঠানিক তালিকা জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। তবে বোর্ড ২৩টি নদীর তালিকা জমা দেয়, যেখানে আবারও ঘড়িয়া ও চন্দ্রবতী নদীকে বাদ দেয়া হয়।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তা জানান, 'উভয় নদী পূর্বের তালিকায় ছিল। জাতীয় নদী সংরক্ষণ কমিশনের রেকর্ডেও ঘড়িয়া ও চন্দ্রবতী নদী হিসেবে বগুড়ার নদীগুলোর মধ্যে উল্লেখ রয়েছে।'
১৩ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রণালয় নদী তালিকা থেকে বাদ পড়া নদীগুলো পুনরায় যাচাইয়ের জন্য পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী। কমিটির কাজ ছিল মাঠ পরিদর্শন, সরকারি নথিপত্র ও বাস্তব প্রমাণের মাধ্যমে বগুড়ার দুটি নদী—ঘড়িয়া ও চন্দ্রবতী—আসলেই রয়েছে কিনা তা যাচাই করা।
কমিটির সদস্য ছিলেন বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আসাদুল হক, সরকারি মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. রেজাউন নবী, জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার আবু শাহামা এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বগুড়া শাখার সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান।
কমিটি গঠনের পরের দিনেই অর্থাৎ ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রথমে ঘড়িয়া নদীর সন্ধানে বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার নেপালতলী এলাকায় ও সারিয়াকান্দি উপজেলার বড়িয়া এলাকা পরিদর্শন করেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। ১৬ ফেব্রুয়ারি কমিটি বিভাগীয় কমিশনারের কাছে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে, যেখানে উক্ত এলাকাগুলোর স্থানীয়রা নদীটির অস্তিত্ব অস্বীকার করেন।
তবে কমিটি মত দিয়েছে, ৭২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ইছামতি নদীর ভাটির দিকের অংশবিশেষ ঘড়িয়া নদী হতে পারে। এটি স্থানীয়দের তথ্যের উপর ভিত্তি করে জানিয়েছে কমিটি।
চন্দ্রাবতী নদী অনুসন্ধানের জন্য কমিটি দুপচাঁচিয়া উপজেলার ইসলামপুর ও চৌমোহনী পরিদর্শন করে। সেখানে স্থানীয়রা এবং এক সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নিশ্চিত করেন, চন্দ্রাবতী নামে কোনো নদী এই উপজেলায় নেই।
বরং, দুপচাঁচিয়া থেকে দুইটি নদী আদমদীঘি উপজেলার দিকে ধাবিত হয়েছে। একটি নাগর নদী, যা আত্রাই নদীতে পতিত হয়েছে। অন্যটি ইরামতী নদী, যা আদমদীঘি উপজেলার রক্তদহ বিলে মিশেছে।
কমিটির সিদ্ধান্ত ছিল, ঘড়িয়া বা চন্দ্রাবতী নদী আজ আর নেই। বগুড়ার নদীর সংখ্যা তাই মোট ২৩টি।
তবে, কমিটির এই সিদ্ধান্তের বিপরীতে পূর্বের সরকারি দলিলগুলো নদী সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য প্রদান করে। কিন্তু ২০০৯ সালে বগুড়ার জেলা প্রশাসন প্রকাশিত 'ধুনট থেকে দুপচাঁচিয়া: ঐতিহ্য সমৃদ্ধ জনপদ' বইয়ে অধ্যাপক ড. মো. আবু হানিফ শেখ ও অধ্যাপক মো. মোখলেছুর রহমান 'বগুড়া জেলার নদ-নদী' শিরোনামের লেখায় চন্দ্রাবতী নদীর কথা উল্লেখ করেছেন।
তাদের বর্ণনা অনুযায়ী, দুপচাঁচিয়া থানার চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার পশ্চিমে গুনাহর ইউনিয়নে উৎপত্তি হয়ে আদমদীঘি থানার নসরৎ হয়ে নওগাঁ জেলার রাণীনগর থানার আত্রাই নদীতে পড়েছে চন্দ্রাবতী নদী। এর দৈর্ঘ্য ১০ থেকে ১২ মাইল। জেলা প্রশাসন প্রকাশিত বইয়ে চন্দ্রাবতী নদীর বিস্তারিত বর্ণনা সহকারে উল্লেখ থাকলেও তদন্ত কমিটি তা এড়িয়ে গেছেন।
নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলছেন, বগুড়ায় অন্তত ২৯টি নদী আছে, যার মধ্যে ঘড়িয়াও রয়েছে।
তিনি বলেন, "ঘড়িয়া নদী বগুড়ার গাবতলীর ইছামতি নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে বাঙ্গালি নদীতে পতিত হয়েছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন প্রকাশিত বাংলাদেশের নদ নদী বইয়ের ২৪৬ নম্বরে এই নদীর নাম উল্লেখ রয়েছে। হয়ত কোনো স্বার্থের কারণে দুটি নদীর নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে তালিকা থেকে।"
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, নদীর শনাক্তকরণের জন্য স্থানীয় মতামতের চেয়ে জরিপ ও খতিয়ান নকশাগুলো অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য।
তিনি সতর্ক করে বলেন, "পুরোনো ভূমি দলিল দিয়ে নদীর ঐতিহাসিক অস্তিত্ব নিশ্চিত করা যায়। নদীকে 'নিখোঁজ' ঘোষণা করলে সেটি জমি দখলের সুবিধা এনে দেয়।"
নদী গবেষক ও রিভারিন পিপলস-এর পরিচালক এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, "নদী নিজে নিজে নিখোঁজ হয় না। অনেক নদী কখনোই সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত হয়নি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে নদী রক্ষার দায়িত্বে থাকা কিছু সংস্থা এখন সেগুলো ধ্বংস করতে সহায়তা করছে। সরকারকে জনগণের জন্য সঠিক নদীর সংখ্যা নিশ্চিত করতে হবে।"