আসন্ন বাজেটে কৃষিভিত্তিক খাতে কর অব্যাহতি প্রত্যাহারের পরিকল্পনা সরকারের

কর অব্যাহতি তুলে নেওয়ার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আসন্ন বাজেটে বহুল আলোচিত মৎস্য ও পোল্ট্রি খাতের বিদ্যমান আয়কর সুবিধা বাতিল করে স্বাভাবিক করহার প্রবর্তনের কথা ভাবছে সরকার।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এসব খাত থেকে আয় করলে তার ওপর ৩ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ হারে আয়কর প্রদান করতে হয়। তবে আগামী বাজেটে এনবিআরের নতুন পদক্ষেপের পরে এসব খাতের আয়ের ওপর নিয়মিত হারে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কর দিতে হতে পারে।
এ তালিকায় আসতে পারে হাঁস-মুরগি ও চিংড়ি হ্যাচারির আয়ও।
এছাড়া তালিকায় যুক্ত হতে পারে—পোলট্রির পেলেটেড ফিড উৎপাদন, গবাদিপশু, চিংড়ি ও মাছের পেলেটেড ফিড উৎপাদন, বীজ উৎপাদন ও বিপণন, গবাদিপশুর খামার, দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের খামার, ব্যাঙ উৎপাদন খামার, হর্টিকালচার, তুঁত চাষ, মৌমাছি চাষ প্রকল্প, রেশম গুটিপোকার খামার, মাশরুম খামার এবং ফ্লোরিকালচারের আয়।
বিশেষজ্ঞরা এ উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তবে প্রকৃত খামারিদের কিছুটা সুরক্ষার পক্ষে মত দিয়েছেন তারা। পাশাপাশি, পোলট্রি, মাছ ও গবাদিপশুর খাদ্য উৎপাদনের ওপর কর বাড়লে এসব খাদ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে বলেও তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
এনবিআর সূত্র জানায়, বর্তমানে যে আদেশ (এসআরও) দুটির মাধ্যমে এই কর অব্যাহতি প্রদান করা হচ্ছে, সেগুলো পর্যালোচনার আওতায় আনা হয়েছে এবং বাতিল করা হতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের এক কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ট্যাক্স এক্সেম্পশন (কর অব্যাহতি) ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার অংশ হিসেবে এসব খাতের সুবিধা বাতিলের পরিকল্পনা রয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "যদি এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়, তাহলে অতিরিক্ত প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় সম্ভব হতে পারে।"
তিনি জানান, এনবিআর এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব তৈরি করেছে, যা আজ বৃহস্পতিবার (১৫ মে) অর্থ উপদেষ্টার কাছে উপস্থাপন করা হবে। এরপর প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদনের ভিত্তিতে তা চূড়ান্ত হবে। আগামী ২ জুন এসব পরিবর্তন অধ্যাদেশ আকারে পাস করতে পারে সরকার।
বর্তমানে এসব খাত থেকে বার্ষিক আয় হলে প্রথম ১০ লাখ টাকার ওপর ৫ শতাংশ, পরবর্তী ১০ লাখ টাকার ওপর ১০ শতাংশ এবং অবশিষ্ট আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। অথচ এর বিপরীতে, ব্যক্তি করদাতাদের সর্বোচ্চ করহার বর্তমানে ৩০ শতাংশ এবং অধিকাংশ কোম্পানিকে ২৭.৫ শতাংশ হারে কর দিতে হয়।
মূলত দেশের মৎস্য, পোলট্রি ও গবাদিপশু খাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে এই কম করহার সুবিধা চালু হয়েছিল। তবে অভিযোগ রয়েছে, এ সুবিধার সুযোগ নিয়ে অনেকে মৎস্য খাতের আয় দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ কালো টাকা সাদা করেছেন। বিশেষ করে প্রভাবশালী রাজনীতিক, আমলা ও ব্যবসায়ীরা এই সুবিধার অপব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাতে কম হারে কর আদায়ের ফলে সরকার কোম্পানি পর্যায়ে ১৪৩ কোটি টাকা এবং ব্যক্তি পর্যায়ে ২,৯৮৫ কোটি টাকার কর ছাড় দিয়েছে।
বর্তমানে ট্যাক্স ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তারা এসব খাতে বড় অঙ্কের আয় দেখানো শতাধিক ব্যক্তির তথ্য নিয়ে কাজ করছেন।
সূত্র জানায়, কয়েকজন রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী শত শত কোটি টাকার আয় মৎস্য খাতের বলে দেখিয়ে কর সুবিধা নিয়েছেন। এতে একদিকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে কালো টাকার মালিকরা কম কর দিয়ে বৈধতার সুযোগ নিচ্ছেন।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, সাবেক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস তিন বছরে মৎস্য খাত থেকে ৯৫ কোটি টাকার বেশি আয় দেখিয়েছেন। তিনি গত আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয়।
এনবিআর সূত্র জানায়, অতীতেও এনবিআর আয়কর সুবিধা বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছিল, কিন্তু রহস্যজনক কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি।
এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক সদস্য (আয়কর নীতি) ড. সাইদ মো. আমিনুল করিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "দীর্ঘদিন ধরে এসব খাত হ্রাসকৃত কর সুবিধা পাচ্ছে। এখন সময় এসেছে তাদের রেগুলার রেটে কর প্রদান করার।"
তিনি আরও বলেন, "মৎস্য খাতের আয় দেখিয়ে কম কর দিয়ে অনেকেই কালো টাকা বৈধ করেছেন। স্বাভাবিক করহার প্রবর্তনে এ সুযোগ বন্ধ হবে।"
কর বিশেষজ্ঞ ও স্নেহাশীষ মাহমুদ অ্যান্ড কোম্পানির অংশীদার স্নেহাশীষ বড়ুয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এনবিআরের ট্যাক্স এক্সপেনডিচার পলিসি ফ্রেমওয়ার্ক অনুযায়ী, সরকারকে এক্সেম্পশন (অব্যাহতি) যৌক্তিক করতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।"
তিনি বলেন, "যারা প্রকৃত খামারি, তাদের জন্য কিছু সুবিধা রাখা যুক্তিযুক্ত হবে। তবে মৎস্য ও পোলট্রি কিংবা গবাদিপশুর খাদ্য উৎপাদনের ওপর কর বাড়ালে তা খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের ওপরও চাপ সৃষ্টি করতে পারে।"