হিমাগারে জায়গা নেই, সনাতন পদ্ধতিতে আলু সংরক্ষণ করছেন উত্তরবঙ্গের কৃষকরা

এবার আলু চাষ করে বিপাকে পড়েছেন উত্তরবঙ্গের কৃষকেরা। হিমাগারে সংরক্ষণ সংকটের কারণে অনেক কৃষক এবার সনাতন পদ্ধতিতে বাড়িতে আলু রেখেছেন। এদিকে, বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে। একদিকে আলু পচে যাওয়ার শঙ্কা, অন্যদিকে উঃপাদনের খরচ তুলতে না পারায় সংশয়ে দিন কাটাচ্ছেন কৃষকরা।
শিবগঞ্জের রায়নগর ইউনিয়নের কৃষক বাবুল হোসেন এবার ৬ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। শুরুতে প্রতিমণ আলু বেশি দামে বিক্রি হলেও শেষ দিকে এসে ৪০০ টাকা মণ বিক্রি করেছেন।
তিনি বলেন, 'আলুর উৎপাদন খরচ প্রতি কেজি ১৪ টাকার ওপরে। তার উপর এবার হিমাগারে সংরক্ষণ খরচ বেড়েছে। সব মিলে কৃষকেরা লোকসানে।'
তিনি আরও জানান, এবার আলু সংরক্ষণ করার জন্য হিমাগারে জায়গা না পাওয়ার কারণে বাড়িতেই রেখেছেন। তিন চারমাস এভাবে রাখলে সমস্যা হয় না। দাম বাড়লে বিক্রি করবেন।
লোকসানের কারণে আগামী বছর থেকে আলু চাষ কমিয়ে দেবেন বলেও জানান তিনি।
হিমাগারে ২০ বস্তা আলু রাখার পরে পুরো বাড়িতেই প্রায় আলু সংরক্ষণ করছেন নওগাঁ সদর উপজেলা ভীমপুর গ্রামের কৃষক গোলাম মোস্তফা।
তিনি বলেন, 'বীজের দাম বেশি হওয়ার কারণে এবার আলুর উৎপাদন খরচ বেশি হয়েছে। কিন্তু বাজারে এখন দাম কম। এই কারণে হিমাগারের পাশাপাশি বাড়িতে আলু সংরক্ষণ করেছি। এগুলো দ্রুত বিক্রি করতে হবে। নইলে পরে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তখন গরুকে খাওয়ানো ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।'
একই গ্রামের বাসিন্দা জিয়াউর রহমান বলেন, 'বিভিন্নভাবে মানুষ বলাবলি করছে এবার কৃষকেরা আলু গরুকে খাওয়াচ্ছেন। ঘটনা আংশিক সত্য। আমি প্রায় ২০ বছর ধরেই কিছুটা নষ্ট আলু গরুকে খাওয়াই। এবারও হয়তো কিছুটা খারাপ আলু অনেকে খাওয়াচ্ছেন। এটি সার্বিক চিত্র হওয়ার কথা নয়।'
তিনি আরও বলেন, 'আলু খাওয়ানোর মাধ্যমে গরু লালন-পালন করা সম্ভব নয়। গরুর প্রতিকেজি খাদ্যে যে উপাদান থাকে তা আলুতে থাকে না।'
হিমাগার মালিকরা জানান, বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলায় ৫৫টি হিমাগার রয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত ধারণক্ষমতা প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার টন। এ দুই জেলায় এবার আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২১ লাখ ৩১ হাজার ৫০০ টন (২১৩ কোটি ১৫ লাখ কেজি)।
আর বগুড়া ও রাজশাহী কৃষি অঞ্চলে ৩৫ লাখ ৮০ হাজার ১৯১ টন আলু উৎপাদিত হয়। এই অঞ্চলের ১০৭ টি হিমাগের আলু ধারণ ক্ষমতা মাত্র ১৮ লাখ ৮৯ হাজার ৮২০ টন। অর্থাৎ বাকী আলু কৃষকরা সনাতন পদ্ধতি সংরক্ষণ করেন।
কৃষকেরা বলছেন, এবার মাঠ থেকেই বেশির ভাগ আলু মধ্যস্বত্বভোগী ও ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে হিমাগারে মজুত করেন। ফলে প্রকৃত চাষীদের আলু রাখার জন্য জায়গা হয়নি হিমাগারে। ফলে বাধ্য হয়ে চাষীরা সনাতন পদ্ধতিতে বাড়িতেই আলু সংরক্ষণ করছেন।

বগুড়া জেলা প্রশাসক হোসনা আফরোজা জানান, হিমাগার ভাড়া বৃদ্ধিসহ কয়েকটি জটিলতার কারণে কৃষকদের মধ্যে সনাতন পদ্ধতিতে আলু সংরক্ষণের আগ্রহ বেড়েছে। জেলায় এবার ৬৭ টি কাঠ ও বাঁশের মাচাতে আলু সংরক্ষণ করা হচ্ছে। প্রতি মাচায় ৩৫ টন আলু ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। মাচায় আলু রেখে সুফল পেলে হিমাগার মালিকদের দৌরাত্ম্য কমবে।
ঠাঁকুরগাওয়ের রাণীশৈঙ্কল উপজেলার কৃষক রেজাউল করিম বলেন, 'এবার সারা দেশেই আলুর উৎপাদন বেড়েছে। এই কারণে হিমাগারে জায়গা হচ্ছে না। ফলে অনেকেই বাড়িতে আলু সংরক্ষণ করেছেন।'
তিনি আরও বলেন, 'অনেক সময় কিছু আলু গরুকে খাওয়ানো হয়। এটি সাধারণত ঘটে আলুর দাম কম থাকলে। কিন্তু বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে না এমনটা নয়। কম দাম হলেও আলু বিক্রি হচ্ছে। লোকসান জেনেও চাষীরা বিক্রি করছেন। উপায় তো নেই।'
কৃষকেরা বলছেন, উত্তরবঙ্গে আলু উৎপাদনে প্রসিদ্ধ রংপুর, ঠাঁকুরগাঁও, বগুড়া, জয়পুরহাটে উৎপাদিত দুই-তৃতীয়াংশ আলু সংরক্ষণের হিমাগার নেই। ফলে অধিকাংশ আলু উৎপাদন মৌসুমে কম দামে তারা বিক্রি করতে বাধ্য হন। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃষকরা।
রংপুর কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সরকারি পরিচালক শাকিল আখতারের তথ্যমতে, জেলায় ৪০টি হিমাগার রয়েচে আলু সংরক্ষণের জন্য। এখানে জেলায় উৎপাদিত আলুর ৩০ শতাংশ সংরক্ষণ করা সম্ভব। বাকী আলু কৃষকরা বিভিন্নভাবে সংরক্ষণ করছেন বলে জানা গেছে। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বাড়িতে আলু সংরক্ষণ করলেও মান ভালো থাকে।
উৎপাদন ও বাজার পরিস্থিতি:
এবার এক কেজি আলুর উৎপাদন খরচ ১৪ থেকে ১৬ টাকা। এসব আলু এবার জমিতে বিক্রি হয়েছে ১০ থেকে ১২ টাকা কেজি দরে। হিমাগার খরচ বৃদ্ধি হওয়ার কারণে অনেকে কৃষক আলু সংরক্ষণের আগ্রহ হারিয়েছেন। অনেকে আবার হিমাগারে আলু সংরক্ষণের সুযোগই পাননি।
বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন বলছে, দেশে বর্তমানে ৩৫০টি হিমাগার চালু রয়েছে। এসব হিমাগারে আলুর ধারণক্ষমতা ৩০ লাখ টন। বিগত বছরের তুলনায় এবছর দেশে ৪০ শতাংশ আলু বেশি উৎপানের তথ্যের কথাও তারা বলেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ বছর সাড়ে চার লাখ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ করা হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি ১৬ লাখ টন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত অর্থবছরে দেশে আলুর উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ ৩১ হাজার টন।
উৎপাদন-পরবর্তী ক্ষতি ও চাহিদা বিবেচনায় নিলে দেশে বছরে প্রায় ৯০ লাখ টন আলুর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।