তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশায় ঝুঁকিতে বোরোর বীজতলা ও আলু
তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশায় বিপর্যস্ত দেশর বিভিন্ন অঞ্চল। আগামী কয়েক দিন এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া দপ্তর। আর এতে বোরো ধানের বীজতলা ও আলুর ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন কৃষকরা।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, দীর্ঘ সময় ধরে তাপমাত্রা কম থাকা এবং ঘন কুয়াশা থাকলে ফসল বিভিন্ন রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। এর ফলে ফলন ও গুণগত মান কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
ফসলের রোগতত্ত্ববিদরা জানান, সাধারণত টানা তিন দিন সূর্যের দেখা না পাওয়া গেলে এবং ঘন কুয়াশা থাকলে আলুখেতে লেট ব্লাইট বা নাবি ধসা রোগ দেখা দেয়। এতে আলুগাছ মরে যেতে পারে। এ সময় পাতা ভেজা থাকায় রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে। পাশাপাশি বোরো বীজতলায় চারাধ্বসা রোগ দেখা দিতে পারে। এসব কারণে কৃষকদের আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহমেদ বলেন, "আলু ও বোরো বীজতলার জন্য এ ধরনের আবহাওয়া অনুকূল নয়। সূর্যের দেখা না পেলে ফসল রোগাক্রান্ত হতে পারে। বর্তমানে আলুতে টিউবার ফরমেশন হচ্ছে, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময়ে আলু আক্রান্ত হলে ফলন অনেক কমে যাবে। তাই নিয়মিত স্প্রে করতে হবে।"
তিনি আরও বলেন, "বোরো বীজতলার ক্ষেত্রেও চারার বৃদ্ধি ব্যাহত হবে এবং মান কমে যাবে। হঠাৎ করে আবহাওয়ার এই পরিবর্তন আলু ও বোরো বীজতলায় সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এ ধরনের আবহাওয়ায় সবজি ও অন্যান্য ফসলের ফলনও কমে যেতে পারে।"
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এবার ২ দশমিক ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো বীজতলা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ইতোমধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ জমিতে বীজতলা করা হয়েছে। পাশাপাশি ৪ দশমিক ৬৭ লাখ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৮৭ শতাংশ জমিতে কৃষকেরা আলু রোপণ সম্পন্ন করেছেন।
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার ফেনীগ্রামের কৃষক আব্দুল হামিদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গত বছর আলু চাষে অনেক লোকসান হয়েছে। সে কারণে এবার দুই বিঘা জমিতে আলু করেছি। গত এক সপ্তাহ ধরে সূর্যের দেখা নেই। এর প্রভাবে আলুর উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, রোগবালাইয়ের ঝুঁকিও বাড়ছে। তবুও নিয়মিত স্প্রে করছি। কী হবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। সার্বিকভাবে আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।"
বোরো বীজতলা নিয়েও শঙ্কার কথা জানান তিনি। আব্দুল হামিদ বলেন, "বোরো বীজতলা লাগিয়েছি। চারা ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফলন কমে যাবে।"
আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, কয়েক দিন ধরেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘন কুয়াশা ও তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য কমে যাওয়ায় শীতের অনুভূতি বেড়েছে। অনেক জায়গায় সূর্যের দেখা না পাওয়ায় ভূমি যথাযথভাবে উষ্ণ হতে পারছে না। এর ফলে সার্বিকভাবে দেশে শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ শাহানাজ সুলতানা টিবিএসকে বলেন, "সোমবার সারাদিন ঘন কুয়াশা ছিল, বেশিরভাগ স্থানে সূর্যের আলো দেখা যায়নি। মঙ্গলবারও কুয়াশা থাকবে। এছাড়া আরও ২-৩ দিন শীত বেশি অনুভূত হবে। এরপর শীত কমে আসবে কিছুটা। আবার জানুয়ারিরর ৬ তারিখের পর আরেকটি শৈত্যপ্রবাহ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।"
ঝুঁকি কমাতে কী করবেন কৃষকরা?
ঝুঁকি কমাতে কৃষকদের করণীয় কী—সে বিষয়ে বিভিন্ন কৃষি সংস্থা পরামর্শ দিয়েছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) সাপ্তাহিক বুলেটিনে বলা হয়েছে, ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে বীজতলায় চারা পোড়া রোগ (সিডলিং ব্লাইট) দেখা দিতে পারে। এ রোগে আক্রান্ত চারার শিকড় ও নিচের অংশ বাদামি রং ধারণ করে। অনেক সময় চারার গোড়ায় সাদা ছত্রাক দেখা যায়। আক্রান্ত চারার বৃদ্ধি কমে যায় এবং ধীরে ধীরে পাতা হলুদ হয়ে শুকিয়ে গিয়ে চারা মারা যেতে পারে।
চলমান অতিরিক্ত ঠান্ডা আবহাওয়ায় বোরো ধানের বীজতলা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে জানিয়েছে ব্রির এগ্রোমেট ল্যাব। তবে সতর্ক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই ক্ষতি কমানো সম্ভব বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।
ব্রির এগ্রোমেট ল্যাবের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. নিয়াজ মো. ফারহাত রহমান বলেন, "এই সময়ে চারার বৃদ্ধি ধীর হয়ে যায় এবং চারা পোড়া রোগ ও থ্রিপস পোকার আক্রমণের আশঙ্কা বাড়ে। ঠান্ডাজনিত ক্ষতি কমাতে বীজতলায় ৩ থেকে ৫ সেন্টিমিটার পানি ধরে রাখা অত্যন্ত জরুরি, এতে মাটির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। পাশাপাশি সুষম মাত্রায় জৈব সার ও ইউরিয়া প্রয়োগ করলে চারার স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং শিকড়ের বৃদ্ধি স্বাভাবিক হয়।"
তিনি কৃষকদের উদ্দেশে বলেন, "ঠান্ডার সময়ে বীজতলা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কোনো সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত কৃষি অফিস বা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। প্রয়োজনে ব্রি এগ্রোমেট ল্যাবের কল সেন্টারে ফোন করে পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।"
তিনি আরও জানান, প্রতিকূল আবহাওয়াতেও বোরো ধানের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে ব্রি নিয়মিত মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাসের ভিত্তিতে সময়োপযোগী পরামর্শ দিচ্ছে।
এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আলুর নাবিধ্বসা রোগের বিষয়ে সতর্ক করেছে। সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমান আবহাওয়ায় আলুর নাবিধ্বসা রোগের ঝুঁকি রয়েছে। প্রতিরোধে অনুমোদিত মাত্রায় ম্যানকোজেব গোত্রের ছত্রাকনাশক ৭ থেকে ১০ দিন পর পর স্প্রে করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক মো. ওবায়দুর রহমান মণ্ডল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা কৃষকদের নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ ও সহায়তা দিচ্ছি।"
