৭ মাত্রার চেয়ে বড় ভূমিকম্পের জন্য ঢাকা কি প্রস্তুত?

গতকাল ৭.৭ মাত্রার এক শক্তিশালী ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে মিয়ানমারের মান্দালয়। ১০ কিলোমিটার গভীরতার এই ভূমিকম্পন বাংলাদেশের ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় অনুভূত হয়েছে।
যদিও দেশে হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি, কিন্তু ৯০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে অবস্থিত থাইল্যান্ডের ব্যাংককে অন্তত ১৪৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
প্রশ্ন উঠছে—এই মাত্রার ভূমিকম্প যদি ঢাকার কাছাকাছি কোথাও আঘাত হানে, তাহলে কী ঘটবে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইন্ডিয়ান, ইউরেশীয় এবং বার্মিজ—এই তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সন্ধিক্ষণে অবস্থান করা বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল।
ইন্ডিয়ান টেকটোনিক প্লেট ক্রমগত উত্তর দিকে সরতে থাকায় মধুপুর ও ডাউকি ফল্টে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে, যা ৭ মাত্রা বা এরচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
প্রস্তুতির ঘাটতি
বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ইশরাত ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "বাংলাদেশ ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে আছে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে বিচ্ছিন্ন কিছু কাজ হলেও কমিউনিটি এবং ভবন নির্মাণের মূল তদারকির জায়গায় কাজ হচ্ছে না। এছাড়া ভূমিকম্প ঘটে গেলে এরপরের ধাপে করণীয় কী—সে বিষয়েও আমাদের কমিউনিটি সচেতন না। আমাদের ওপেন স্পেসের এতো সংকট যে, ভূমিকম্প হলে আশ্রয় এবং উদ্ধারের বিষয়টিতেই আমাদের সবচেয়ে বেশি ভোগাবে।"
এই নগর ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, "ঢাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে পুরান ঢাকা এবং বসুন্ধরার মতো এলাকা। বিশেষ করে পুরান ঢাকার অধিকাংশ ভবনই গড়ে উঠেছে এক একটি ভবনের লাগোয়া এবং সেগুলোর যেমন ভিত্তি ঠিক নেই, তেমনি অনেক ভবনই পুরোনো। আর বসুন্ধরার মতো নরম ভূমির এলাকাগুলোতে ভূমিকম্পের ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। এজন্য ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড মেনে যথাযথভাবে ভবন উঠছে কি না, সে বিষয়ে রাজউক এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর নজরদারি বাড়াতে হবে।"
তিনি বলেন, "আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ হবে ভূমিকম্প পরবর্তী ব্যবস্থাপনা। কমিউনিটি বেইজড প্রিপারেশনটা বেশি জরুরি। মানুষ কোথায় আশ্রয় নেবে, কোথায় চিকিৎসা নেবে, কোন রাস্তা ব্যবহার করবে—সে বিষয়ে আগ থেকেই প্রস্তুতি থাকতে হবে। গড়ে তুলতে হবে কমিউনিটি বেইজড একটি উদ্ধারকারী দল।"
ভূমিকম্পের ক্ষতি কমাতে যেসকল বিষয় নিয়ে কাজ করতে হবে সে বিষয়েও ধারণা দেন এই বিশেষজ্ঞ।
তিনি চারটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে সরকারকে অনুরোধ করেন। বিষয়গুলো হচ্ছে – বিল্ডিং কোড মেনে ভবন তৈরি; বর্তমান যে ভবন রয়েছে সেগুলো যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা; ভূমিকম্প হওয়ার পরে কীভাবে পরবর্তী হ্যাজার্ড থেকে রক্ষা পাবে তার পরিকল্পনা এবং ভবন নির্মাণের এলাকার মাটি অনুযায়ী ভিত তৈরি করা।
সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি কেমন হতে পারে?
সম্প্রতি রাজউকের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্টে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার ৪০.২৮ থেকে ৬৫.৮৩ শতাংশ ভবন ধসে পড়তে পারে। এতে সময়ভেদে প্রাণহানির সংখ্যা ব্যাপক হতে পারে—ভোরে হলে ২.১ থেকে ৩.১ লাখ, দুপুরে ২.৭ থেকে ৪ লাখ এবং রাতে হলে ৩.২ থেকে ৫ লাখ মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে।
একইভাবে, সিলেটে যদি ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে, তাহলে ঢাকায় ৪০,৯৩৫ থেকে ৩ লাখ ১৪ হাজার ভবন—অর্থাৎ মোট ভবনের ১.৯১ শতাংশ থেকে ১৪.৬৬ শতাংশ—ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
রাজউকের আওতায় ঢাকায় মোট ভবনের সংখ্যা ২১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি, যার মধ্যে ৫ লাখ ১৪ হাজার কংক্রিটের তৈরি। রাজউকের জরিপ করা ৩,২৫২টি ভবনের মধ্যে ৪২টিকে উচ্চঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে ভেঙে ফেলার সুপারিশ করা হয়েছে।
গত বছর, ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব আর্থকোয়াক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সিসমোলজি-এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মোহসেন ঘাফোরি আশতিয়ানি টিবিএসকে জানান, মধুপুর ফল্টে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার ৪৯.৬ শতাংশ প্রধান সড়ক, ৫৯.৪ শতাংশ নগর সড়ক, ৯৬.২২ শতাংশ প্রধান সেতু এবং ৯৬.৭৯ শতাংশ পর্যন্ত নগর সেতু ধসে পড়তে পারে।
আর্থিক ক্ষতির দিক থেকে তিনি জানান, পরিবহন খাতে ক্ষতি হবে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনে ৮৮৭ মিলিয়ন ডলার এবং বিদ্যুৎ খাতে ২৭.১ মিলিয়ন ডলার।
কেন ঢাকা এতটা ঝুঁকিতে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকা বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে অপরিকল্পিত ও দুর্বল ভবন, বস্তি এবং সরু গলিতে ঠাসাঠাসি করে মানুষ বসবাস করছে—যা ঢাকায় ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকির মাত্রাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে।
শহরের অনেক ভবন ভূমিকম্প প্রতিরোধে নির্ধারিত নিরাপত্তা মানদণ্ড মেনে নির্মাণ করা হয়নি, ফলে সেগুলো বড় ধরনের কম্পনে মৃত্যুকূপে পরিণত হতে পারে। এছাড়া, বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল নরম ও জলাবদ্ধ পলিমাটির ওপর গড়ে ওঠায়, প্রবল ভূকম্পনে এই মাটি সহজেই নরম হয়ে ভবন ধসের ঝুঁকি অনেক গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে।
এছাড়া বিশেষজ্ঞদের মতে, জাপান বা ক্যালিফোর্নিয়ার মতো ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলের তুলনায় বাংলাদেশে জনসচেতনতা ও দক্ষ দুর্যোগ মোকাবিলা ব্যবস্থার মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে।
১৮৯৭ সালের গ্রেট ইন্ডিয়ান অর্থকোয়াকে (৮ মাত্রার ভূমিকম্প) তৎকালীন অবিভক্ত বাংলায় ১,৫০০ জনের বেশি প্রাণ হারিয়েছিল। ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্পেও হয়েছিল (৭.৬ মাত্রা) ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবহাওয়াবিদ মো. রুবায়েত কবির টিবিএসকে বলেন, "আমরা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে আছি। এমনকি দেশের বাইরের ভূমিকম্পও ঢাকায় প্রভাব ফেলতে পারে। ভবনগুলো ভূমিকম্প প্রতিরোধী হওয়া উচিত, আর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা আগে থেকেই তৈরি থাকতে হবে।"
তিনি আরও বলেন, "গতকালের ভূমিকম্পটি সম্পর্কে আগেই সতর্ক করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা, কারণ ওই অঞ্চলে একটি 'সিসমিক গ্যাপ' তৈরি হয়েছিল বা দীর্ঘদিন ভূমিকম্প হয়নি। আশপাশের টেকটোনিক প্লেট, বিশেষ করে ইউরেশীয় প্লেট, আরও ভূমিকম্প তৈরি করতে পারে—যেখানে ভবিষ্যতে বাংলাদেশেও বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।"