বাণিজ্যে ঝুঁকি, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন ৩–৫ বছর পেছানোর দাবি ব্যবসায়ীদের

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের সময় আরও তিন থেকে পাঁচ বছর পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে দেশের শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠনগুলো। তাদের আশঙ্কা, অকাল এই উত্তরণ ক্ষতিগ্রস্ত করবে রপ্তানিকে, ঋণের খরচ বাড়াবে এবং প্রধান শিল্পখাতগুলোকে চাপে ফেলবে।
ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের (আইসিসিবি) সভাপতি মাহবুবুর রহমান গতকাল এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, "আমাদের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী মহল এলডিসি উত্তরণকে আন্তরিকভাবে সমর্থন করে। তবে আমরা জোর দিয়ে বলছি, এ উত্তরণের জন্য আরও ৩ থেকে ৫ বছরের সময় বাড়ানো প্রয়োজন।"
ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো এর আগেও আলাদাভাবে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পেছানোর আহ্বান জানালেও—এবারই প্রথম ১৬টি শীর্ষ সংগঠন যৌথভাবে এ দাবি তুলে ধরল। "'এলডিসি থেকে উত্তরণে চ্যালেঞ্জ'" শীর্ষক এ সংবাদ সম্মেলনটি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়।
সংবাদ সম্মেলনে ব্যবসায়ী নেতারা মার্কিন শুল্কের অভিঘাত মোকাবিলায়—-ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, আসিয়ানভুক্ত দেশ এবং উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি ফার্মাসিউটিক্যালস, আইটি, চামড়া, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ ও লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে রপ্তানি বহুমুখীকরণের ওপর জোর দেওয়ার আহ্বান জানান।
এছাড়া তারা ইন্ডাস্ট্রি ৪.০—অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তির জন্য মানবসম্পদ উন্নয়ন, প্রযুক্তি ও টেকসই উন্নয়ন আনতে সক্ষম মানসম্পন্ন বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ, এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সুশাসন ও জলবায়ু সহনশীলতা জোরদারের পরামর্শ দেন।
জাতিসংঘের তিনটি মানদণ্ড—মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি সূচক—টানা দুটি পর্যালোচনায় উত্তীর্ণ হওয়ায় বাংলাদেশ ২০২৬ সালের নভেম্বর মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে এলডিসি থেকে উত্তরণের তালিকায় রয়েছে।
ব্যবসায়ী নেতারা এ অর্জনকে "জাতীয় গৌরবের বিষয়" হিসেবে আখ্যা দিলেও সতর্ক করে বলেন, এ উত্তরণ অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পরিচালনা করতে হবে।
এলডিসি উত্তরণ পেছানোর দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই), বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ), বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ), মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) এবং ফরেন ইনভেস্টর্স' চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ফিকি)-সহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিরা।
রপ্তানি বাণিজ্য, সহজ শর্তের ঋণ বন্ধের ঝুঁকি
আইসিসিবি'র সভাপতি মাহবুবুর রহমান সতর্ক উল্লেখ করেন, এলডিসি উত্তরণের পর অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা হারালে রপ্তানিতে বড় ধাক্কা লাগবে। তিনি বলেন, "ইইউ, যুক্তরাজ্যসহ প্রধান বাজারগুলোতে (বাংলাদেশি পণ্যে) ১২ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ হতে পারে। জিএসপি প্লাস বা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) না হলে রপ্তানি ৬–১৪ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।"
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮১ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক শিল্প থেকে আসে। তবে রুলস অব অরিজিনের কঠোর শর্ত, উচ্চ কমপ্লায়েন্স খরচ এবং প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির কারণে— উত্তরণের পর এ খাত সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়বে বলেও জানান তিনি।
এছাড়া বর্তমানে কানাডা ও জাপানে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেলেও উত্তরণের পর বাংলাদেশি পণ্যকে এসব বাজারে যথাক্রমে ১৮ শতাংশ ও ১২.৮ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক দিতে হতে পারে বলে সতর্ক করেন তিনি। এতে বহুপাক্ষিক বাণিজ্য সুবিধা ও স্বল্পসুদের অর্থায়ন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, সহজ শর্তের ঋণ বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে বাজারভিত্তিক ঋণ নিতে হবে এবং ঋণ শোধের চাপও বেড়ে যাবে। বিশ্বব্যাংকের আইডিএ'র সহজ শর্তের ঋণের সুবিধাও হারাবে বাংলাদেশ। পাশাপাশি, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) অধীনে প্রাপ্ত বিশেষ সুবিধা, যেমন রপ্তানিতে ভর্তুকি এবং মেধাস্বত্ব আইনের [ট্রিপস] ছাড়, বন্ধ হয়ে যাবে।
ঝুঁকিতে ওষুধ শিল্প
তিনি জানান, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ওষুধ ও তৈরি পোশাক শিল্প। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প বর্তমানে স্থানীয় চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করে এবং ১৫০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি করে। মেধাস্বত্ব চুক্তিতে ছাড় পাওয়ার কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। এই খাত বর্তমানে ট্রিপস অব্যাহতি সুবিধার ওপর নির্ভরশীল, যা ২০৩৩ সাল পর্যন্ত ওষুধের পেটেন্ট ছাড়াই জেনেরিক ওষুধ উৎপাদনের সুযোগ দিচ্ছে। এ সুবিধার মেয়াদ না বাড়লে ওষুধ শিল্প প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাবে এবং ওষুধের দাম কয়েকগুণ বাড়বে বলে সতর্ক করেন মাহবুবুর রহমান।
তিনি বলেন, "উত্তরণের পর এই সুরক্ষা উঠে গেলে ক্যান্সার ও এইচআইভির মতো জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম বহুগুণ বেড়ে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ক্যান্সার চিকিৎসার ওষুধ 'ইমাটিনিব'-এর মাসিক খরচ ৩০ থেকে ৪০ ডলার থেকে বেড়ে ২ থেকে ৩ হাজার ডলারে পৌঁছাতে পারে। এইচআইভি চিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল ওষুধের বার্ষিক খরচ ১০০–১৫০ ডলার থেকে বেড়ে ১০,০০০–১২,০০০ ডলারে পৌঁছাতে পারে। এমনকি ট্রাস্টুজুমাবের মতো বায়োটেক ওষুধের দামও দশগুণের বেশি বাড়তে পারে।"
বিদ্যমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ
ব্যবসায়ী নেতারা বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট, বৈশ্বিক বাণিজ্য উত্তেজনা, বৈদেশিক বিনিয়োগ হ্রাস, বিদেশি ঋণের চাপ, ক্রমবর্ধমান ঝুঁকিপূর্ণ বা খেলাপি ঋণ, লজিস্টিকস জটিলতা, মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং জলবায়ু ঝুঁকির কথা তুলে ধরেন।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে সৃষ্ট অর্থনৈতিক চাপের কথাও উল্লেখ করেন তারা।
২০২১ সাল থেকে টাকার মান প্রায় ৪৫ শতাংশ অবমূল্যায়িত হয়েছে, এতে আমদানি ব্যয় ও মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে। ২০২৪ সালে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ১৩ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১.২৭ বিলিয়ন ডলারে, যেখানে ভিয়েতনামে এ বিনিয়োগ ৩৮ বিলিয়ন ডলার।
ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭.৫৬ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। আর্থিক খাতে দুর্বল সুশাসনের কারণে ঋণের সুযোগ কমতে পারে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করবে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা হ্রাস করবে বলে উল্লেখ করেন ব্যবসায়ী নেতারা।
আইসিসিবি সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, বিদ্যুৎ বিভ্রাট, গ্যাস সংকট এবং জ্বালানির বাড়তি খরচ শিল্প উৎপাদন ব্যাহত করছে। অপরদিকে যানজট, কাস্টমসে বিলম্ব এবং বন্দর জটিলতার কারণে লজিস্টিকস ব্যয় জিডিপির প্রায় ১৬ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, যা বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় অনেক বেশি।
তিনি বলেন, "উচ্চ লজিস্টিকস ব্যয় আমাদের বাণিজ্য প্রতিযোগিতার সক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং শিল্প কার্যক্রমকে ধীর করছে।"
উত্তরণ পিছিয়েছে ৭ দেশ
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এর আগে অনেক দেশ জাতিসংঘের শর্ত পূরণ করলেও অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক কারণে এলডিসি থেকে উত্তরণ পিছিয়ে দিয়েছে। মালদ্বীপ, ভানুয়াতু, সামোয়া, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, নেপাল, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, মিয়ানমার, তিমুর প্রভৃতি দেশের সময় বাড়ানো হয়।
তাদের মতে, এসব দেশের উদাহরণই তুলে ধরে কীভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বাহ্যিক অভিঘাত বা অবকাঠামোগত ঘাটতির কারণে অনেক দেশ উত্তরণ প্রস্তুতির জন্য অতিরিক্ত সময় নেয়।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ফিকির সাবেক সভাপতি নাসের এজাজ বিজয় বলেন, বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন পুনর্গঠন, রাজনৈতিক পরিবর্তন, অর্থনৈতিক মন্দা ও জলবায়ু ঝুঁকির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশেরও (গ্র্যাজুয়েশনের) সময় বাড়ানো দরকার।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, "বর্তমানে তৈরি পোশাক খাত সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী, কিন্তু উত্তরণের পর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ খাত।"
একই কথা বলেছে ঢাকা চেম্বারও
এদিকে একই দাবির প্রতিধ্বনি শোনা যায় গতকাল ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে।
অনুষ্ঠানে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পেছানোর জন্য বাংলাদেশ অনুরোধ করতে পারে, তবে জাতিসংঘের অনুমোদন পাওয়া অনিশ্চিত।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই উত্তরণের শর্তগুলো পূরণ করেছে। তাই উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রস্তুতি অবহেলা করা যাবে না। তা না হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ও অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মনজুর হোসেন বলেন, সরকার এখনো নির্ধারিত সময়েই এলডিসি উত্তরণে অনড় এবং এ বিষয়ে আগামী মাসে একটি উচ্চপর্যায়ের স্টেকহোল্ডার কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হবে।
"যদিও উত্তরণ পেছানো কিছু ক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনতে পারে, তবুও এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মতামত নেওয়া জরুরি," যোগ করেন তিনি।