ঈদের ছুটিতে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ধস, ৩০ শতাংশ রপ্তানি শিপমেন্টে শিডিউল বিপর্যয়

ঈদুল আজহা উপলক্ষে টানা সরকারি ছুটির প্রভাব পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার ডেলিভারি ও কনটেইনার ওঠানামায়। শ্রমিক সংকটের কারণে বন্দরে জাহাজে কনটেইনার ওঠানামায় অতিরিক্তি এক দিন পর্যন্ত সময় লাগছে। ফলে ৩০ শতাংশ রপ্তানি শিপমেন্টের শিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে।
স্বাভাবিক সময়ে যেখানে দৈনিক গড়ে পাঁচ হাজারের বেশি আমদানি কনটেইনার জাহাজ থেকে নামানো হয়, সেই সংখ্যা এখন নেমে এসেছে অর্ধেকে। ডেলিভারি কমেছে ৮০ শতাংশের বেশি। সময়মতো কনটেইনার বন্দরে না আসায় ঘটেছে রপ্তানি চালানের শিডিউল বিপর্যয়।
ঈদের ছুটির আগে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও কাস্টমস যৌথ সভা করেছিল বন্দর সচল রাখতে। সেখানে নেওয়া হয়েছিল ১০টি সিন্ধান্ত।
কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, এসব সিদ্ধান্তের সুফল আসেনি। উল্টো বন্দরের বিদ্যমান স্টোরেজ ভাড়া চারগুণ বৃদ্ধির ফলে তাদের ক্ষতি বেড়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে ঈদের ১০ দিন ছুটির সময়ের স্টোরেজ ভাড়া মওকুফের দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ঈদুল আজহার টানা দশ দিনের সরকারি ছুটি শুরু হয় গত ৫ জুন, আগামী ১৪ জুন পর্যন্ত ছুটি অব্যাহত থাকবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার ডেলিভারি ও হ্যান্ডলিংয়ের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ঈদের ছুটি চলাকালে অস্বাভাবিক কমে গেছে কনটেইনার ডেলিভারির সংখ্যা। ৫ জুন বন্দরে কনটেইনার ডেলিভারি হয়েছিল ৪ হাজার ১২২ টিইইউ (বিশ-ফুট সমতুল্য ইউনিট)। এদিন জাহাজে কনটেইনার ওঠা-নামা বা হ্যান্ডলিং হয়েছিল ৯ হাজার ৭২০ টিইইউ, আর আমদানি কনটেইনার জাহাজ থেকে নামানো হয়েছিল ৫ হাজার ৪১১ টিইইউ।
কিন্তু এরপর থেকে বন্দরে কমতে থাকে ডেলিভারির সংখ্যা। ৬ জুন ৩ হাজার ৫০৫ টিইইউ, ৭ জুন ৫২১ টিইইউ, ৮ জুন শূন্য টিইইউ, ৯ জুন ৪৩৭ টিইইউ ও ১০ জুন ১ হাজার ৩৮১ টিইইউ কনটেইনার ডেলিভারি হয়।
ঈদের ছুটিতে কমে গেছে কনটেইনার হ্যান্ডলিং ও আমদানি কনটেইনার নামানোর সংখ্যাও। স্বাভাবিক সময়ে জাহাজ থেকে প্রায় ৫ হাজার আমদানি কনটেইনার নামানো হয়। কিন্তু ৬ জুন ৫ হাজার ৫৪৪ টিইইউ, ৭ জুন ২ হাজার ৮৩৫ টিইইউ, ৮ জুন ৩০৮ টিইইউ,. ৯ জুন ২ হাজার ১১৩ টিইইউ ও ১০ জুন ২ হাজার ৩১১ ুটিইইউ আমদানি কনটেইনার নামানো হয় জাহাজ থেকে।
চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার ডেলিভারি ও কনটেইনার ওঠানামার হিসাব ধরা হয় আগের দিন সকাল ৮টা থেকে পরের দিন সকাল ৮টা পর্যন্ত। অর্থাৎ ১০ জুন কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের তথ্য ৯ জুন সকার ৮টা থেকে ১০ জুন সকাল ৮টা পর্যন্ত সময়ের।
চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডের ধারণক্ষমতা ৫৩ হাজার ৫১৮টি কনটেইনার, যার সর্বোত্তম পরিচালনাক্ষমতা ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টিইইউ। ১০ জুন পর্যন্ত বন্দর ইয়ার্ডে কনটেইনার ছিল ৩৮ হাজার ৫২ টিইইউ।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র চিফ পারসোনাল অফিসার নাসির উদ্দিন বলেন, বন্দরে সব ধরনের কার্যক্রম চালু আছে। কনটেইনার ডেলিভারি দেওয়ারও সব প্রস্তুতি আছে বন্দর কর্তৃপক্ষের।
৩০ শতাংশ রপ্তানি শিপমেন্টের শিডিউল বিপর্যয়
ঈদের ছুটিতে শ্রমিক সংকটের কারণে বেসরকারি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোগুলো (আইসিডি) থেকে সঠিক সময়ে রপ্তানি পণ্য বন্দরে না আসায় রপ্তানি পণ্য সময়মতো জাহাজে ওঠানো যায়নি বলে জানিয়েছেন টার্মিনাল অপারেটর ও বার্থ অপারেটরা।
চট্টগ্রাম বন্দরের ১২টি কনটেইনার জেটির মধ্যে এনসিটি ও সিসিটিতে ছয়টি জেটি পরিচালনা করে সাইফ পাওয়ারটেক। সাইফ পাওয়ারটেকের নির্বাহী পরিচালক নাজমুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সঠিক সময়ে বন্দর ইয়ার্ডে কনটেইনার না পৌঁছায় রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার শিডিউল অনুযায়ী জাহাজে ওঠানো সম্ভব হয়নি। শিডিউল বিপর্যয়ে পড়া এসব কনটেইনার প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পর পরবর্তী জাহাজে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোতে পাঠানো হয়েছে।
আইসিডি মালিকদের সংগঠন বিকডা-র তথ্যানুসারে, প্রতিদিন স্বাভাবিক সময়ে ২ হাজার ২০০ টিইইউ রপ্তানি কনটেইনার জাহাজে তোলা হয়। কিন্তু শ্রমিক সংকটের কারণে কনটেইনার বোঝাই করা যায়নি। ফলে অন্তত ৩০ শতাংশ রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার জাহাজে সঠিক সময়ে তোলা যায়নি।
জাহাজে পণ্য লোড ও আনলোড করার সময়ও বেড়েছে। বন্দরর জেটিতে জাহাজ প্রবেশ করে কনটেইনার লোড-আনলোড করতে সময় লাগে ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা। ঈদের ছুটিতে শ্রমিক কমে যাওয়ায় ও কনটেইনার জট তৈরি হওয়ায় এখন সময় লাগছে ৭২ থেকে ৯৬ ঘণ্টা।
তবে দুই-এক দিনের মধ্যে এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
একটি বড় আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানির চট্টগ্রাম অফিসের ঊর্ধতন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে টিবিএসকে বলেন, জাহাজে পণ্য ওঠা-নামায় বিলম্বের কারণে এক দিন বেশি সময়ের জন্য জাহাজের আকারভেদে ১৫ হাজার ডলার থেকে ২০ হাজার ডলার পর্যন্ত ভাড়া গুনতে হবে। এই বাড়তি খরচ যুক্ত হবে পণ্যের মুল্যে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ঈদের সরকারি ছুটি কোনভাবেই পাঁচ দিনের বেশি হওয়া উচিত ছিল না। টানা ছুটির প্রভাব ইতিমধ্যে পড়তে শুরু করেছে বন্দরের কার্যক্রমে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ গত ১০ মার্চ থেকে বিদ্যমান স্টোরেজ ভাড়া চারগুণ বাড়িয়েছে। জাহাজ থেকে নামানোর পর চার দিনের বেশি বন্দরে থাকা কনটেইনারের ক্ষেত্রে এই বর্ধিত চার্জ প্রযোজ্য হয়। রমজান মাসে কৃত্রিম সরবরাহ সংকট রোধ করতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
এরপর থেকে স্টেকহোল্ডাররা এই চার্জ বাতিলের দানয় জানিয়ে এলেও বন্দর কর্তৃপক্ষ সিন্ধান্ত পরিবর্তন করেনি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদের ছুটিতে কনটেইনার ওঠা-নামা কিংবা ডেলিভারি কমে যাওয়ার ঘটনা প্রতি বছরের। তবে এবারের টানা দশ দিনের ছুটি এবং বিদ্যমান স্টোরেজ ভাড়ার চারগুণ জরিমানা এ সংকটকে অসহনীয় করে তুলেছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ সংকটের জন্য তারা দায়ী নন। তাহলে চারগুণ স্টোরেজ ভাড়ার শাস্তি এ সময়ে চালু থাকা উচিত নয়। তারা চারগুণ স্টোরেজ ভাড়ার সিদ্ধান্ত বাতিলের পাশাপাশি ঈদের টানা ১০ দিনের স্টোরেজ ভাড়া মওকুফের দাবি জানান।
চিটাগং চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, 'ব্যবসায়ীদের ওপর চারগুণ স্টোর রেন্ট চাপিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই উচিত হয়নি। কনটেইনার ডেলিভারি কম হওয়ার অজুহতে সব ব্যবসায়ীর ওপর এর দায় চাপানো হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের উচিত অহেতুক চাপিয়ে দেওয়া এই সিন্ধান্ত দ্রুত প্রত্যাহার করা।
'যদি কোনো ব্যবসায়ী ইচ্ছাকৃত কনটেইনার ডেলিভারি না নেয়, তাহলে সেই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বন্দর ব্যবস্থা নিতে পারে। ঈদের ছুটিতে বন্দর চালু থাকলেও এর সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো চালু না থাকলে ডেলিভারি কীভাবে হবে। ঈদের ছুটিতে কীভাবে সব স্টেকহোল্ডার প্রতিষ্ঠান চালু থাকে সে বিষয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের উচিত একটি নীতিমালা তৈরি করা।'
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, চার দিনের ফ্রি টাইমের পরে প্রথম সাত দিনের জন্য একটি ২০ ফুট কনটেইনারের জন্য প্রতিদিন ৬ ডলার চার্জ করা হয়, আর ৪০ ফুট কনটেইনারের জন্য ১২ ডলার খরচ হয়। এ চার্জ ধীরে ধীরে বাড়ে—তৃতীয় সপ্তাহে ২০ ফুট ও ৪০ ফুট কনটেইনারের জন্য যথাক্রমে ২৪ ডলার ও ৪৮ ডলার চার্জ দিতে হয়।
নতুন আরোপিত চারগুণ ফি অনুসারে, আমদানিকারকদের ২০ ফুট কনটেইনারের জন্য প্রতিদিন ২৪ থেকে ৯৬ ডলার এবং ৪০ ফুট কনটেইনারের জন্য প্রতিদিন ৪৮ থেকে ১৯২ ডলার দিতে হচ্ছে।
বিকেএমইএ-র পরিচালক সামছুল আজম টিবিএসকে বলেন, 'চারগুণ স্টোর রেন্টের কারণে রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পের কাঁচামাল ছাড় করতে অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হচ্ছে। পোশাক শিল্পের বর্তমান সংকটকালীন সময়ে এই সিন্ধান্ত দ্রুত প্রত্যাহার করা উচিত।'
চট্টগ্রাম গার্মেন্টস অ্যাক্সেসরিজ অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল ও বাংলাদেশ ইম্পোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি মোহাম্মদ বেলাল বলেন, 'চারগুণ স্টোররেন্ট চাপিয়ে দেওয়া দেশের অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী। আমরা স্টোর রেন্ট মওকুফের জন্য ইতিমধ্যে একাধিকবার চিঠি দিয়েছি।'