ব্যবসায়ীদের আপত্তি সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বন্দরে গড়ে খরচ বাড়ল ৪১ শতাংশ

প্রায় চার দশক পর চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল বাড়ানো হলো। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখন থেকে বন্দর সেবায় ব্যবহারকারীদের গড়ে ৪১ শতাংশ বেশি মাশুল গুনতে হবে। সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) থেকে এ নতুন হার কার্যকর হয়েছে।
রোববার (১৪ সেপ্টেম্বর) রাতে বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
সরকারি প্রজ্ঞাপনের বিশ্লেষণে দেখা যায়, গড়ে ৪১ শতাংশ মাশুল বাড়ানো হলেও সবচেয়ে বেশি বেড়েছে কনটেইনার পরিবহনের খরচ। ২০ ফুট দৈর্ঘ্যের প্রতিটি কনটেইনারে আগের তুলনায় ৪ হাজার ৩৯৫ টাকা বেশি মাশুল গুনতে হবে ব্যবহারকারীদের।
গত ২৪ জুলাই বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবিত নতুন মাশুল অনুমোদন করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। সে সময় বন্দর ব্যবহারকারীরা একসঙ্গে গড়ে ৪১ শতাংশ মাশুল বৃদ্ধির তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পরে এক দফা আলোচনা হলেও আপত্তি আমলে নেওয়া হয়নি। ফলে বন্দরের প্রস্তাবিত সিদ্ধান্তই শেষ পর্যন্ত বহাল রাখা হলো।
ব্যবহারকারীদের আশঙ্কা, এভাবে এক লাফে গড়ে ৪১ শতাংশ মাশুল বাড়ানো হলে হঠাৎ করে ভোক্তার ওপর চাপ বাড়বে। রপ্তানি খাতের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানও দুর্বল হয়ে পড়বে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের ক্ষেত্রে এর প্রভাব সরাসরি পড়বে। এছাড়া ভবিষ্যতে বন্দরের দুটি টার্মিনাল ছাড়া বাকিগুলো বিদেশি অপারেটরদের হাতে চলে যাচ্ছে। ফলে মাশুল বৃদ্ধির সুফল বিদেশিরাই বেশি ভোগ করবে বলে মন্তব্য করেছেন ব্যবহারকারীরা।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (সিপিএ) সচিব মো. ওমর ফারুক মাশুল বৃদ্ধির বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, এ সিদ্ধান্তে নিত্যপণ্যের দামে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। তিনি বলেন, 'আমদানিকারকরা বর্তমানে প্রতি কেজি পণ্যের জন্য ৩২ পয়সা মাশুল দেন। নতুন হারে এটি হবে সর্বোচ্চ ৪৪ পয়সা- অর্থাৎ ১২ পয়সা বেড়েছে। তাই আমরা মনে করি, এতে নিত্যপণ্যের দাম বা সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতি খুব বেশি বাড়বে না।'
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ১৯৮৬ সালের পর এই প্রথম বন্দরের মাশুল বাড়ানো হয়েছে। নতুন হার কার্যকর হলেও তা এখনো প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় কম।
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম চট্টগ্রামের সভাপতি এবং বিজিএমইএ পরিচালক এস এম আবু তৈয়ব এ বিষয়ে বলেন, 'বর্ধিত মাশুলের কারণে সবচেয়ে বেশি চাপে পড়বে তৈরি পোশাক খাত। কারণ, কাঁচামাল আমদানির সময় এক দফা, আবার রপ্তানির সময় আরেক দফা মাশুল দিতে হবে। ফলে একই পণ্যে দুইবার বাড়তি মাশুল গুনতে হবে, যা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়।'
নতুন হার অনুযায়ী, বর্তমানে প্রতিটি ২০ ফুট কনটেইনারের জন্য মাশুল গড়ে ১১ হাজার ৮৪৯ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ১৬ হাজার ২৪৩ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি কনটেইনারে গড়ে ৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বন্দরের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের নিরীক্ষিত হিসাব অনুযায়ী নতুন মাশুল হিসাব করা হয়েছে। এতে ডলারপ্রতি বিনিময় হার ধরা হয়েছে ১২২ টাকা। ডলারের হার বাড়লে মাশুলও বাড়বে, কারণ বন্দর কর্তৃপক্ষ ডলার ভিত্তিতে মাশুল আদায় করে।
আমদানি কনটেইনারে মাশুল বাড়ছে ৫ হাজার ৭২০ টাকা এবং রপ্তানি কনটেইনারে ৩ হাজার ৪৫ টাকা।
কনটেইনার ওঠানো-নামানোর মাশুলও ব্যাপক হারে বেড়েছে। আগে প্রতি কনটেইনারে এ খাতে মাশুল ছিল ৪৩ দশমিক ৪০ ডলার, এখন তা বাড়িয়ে ৬৮ ডলার করা হয়েছে। অর্থাৎ বাড়তি ২৪ দশমিক ৬০ ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩ হাজার।
প্রতি কেজি কনটেইনার পণ্যে আগে গড়ে ১ টাকা ২৮ পয়সা মাশুল দিতে হতো। এখন থেকে প্রতি কেজিতে গড়ে ৪৭ পয়সা বেশি দিতে হবে।
সমুদ্রপথে দেশের আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৯৯ শতাংশ কনটেইনার পরিবহন হয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। ফলে মাশুল বৃদ্ধির প্রভাব শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ও তৈরি পণ্য রপ্তানিতে সবচেয়ে বেশি পড়বে।
বন্দর থেকে সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজ খুব কম সুবিধা নিয়ে থাকে। মূলত এসব জাহাজ সাগরে নোঙর করে ছোট জাহাজের মাধ্যমে পণ্য খালাস করে। বন্দরের হিসাবে, সব ধরনের পণ্যে গড়ে কেজিপ্রতি মাশুল ৩৫ পয়সা থেকে বেড়ে হবে ৪৯ পয়সা। অর্থাৎ বৃদ্ধি গড়ে ৪১ শতাংশ।