১৫ মাস পেরিয়েও প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ সৌদভিত্তিক আরএসজিটিআই, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে ভোগান্তি

পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে (পিসিটি) কার্যক্রম শুরুর ১৫ মাস পার হলেও সৌদিভিত্তিক অপারেটর রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল (আরএসজিটিআই) এখনো প্রতিশ্রুত সরঞ্জাম আনতে পারেনি; দেখতে পারেনি প্রত্যাশিত কর্মদক্ষতাও।
এর ফলে টার্মিনালে দেখা যাচ্ছে বিলম্ব, বাণিজ্যে বিঘ্ন ঘটছে; এতে আমদানি-রপ্তানিকারক ও কাস্টমস এজেন্টদের মধ্যেও ক্ষোভ বাড়ছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) নিজস্ব অর্থায়নে ১,২৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করে। লক্ষ্য ছিল, বছরে ৫ লাখ টিইইউ (২০ ফুট সমমানের কনটেইনার) সামলানোর সক্ষমতা যোগ করে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরকে আরও শক্তিশালী করা।
কিন্তু ২২ বছরের 'ইকুইপ, অপারেট অ্যান্ড মেইনটেইন' চুক্তির আওতায় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আরএসজিটিআইয়ের কাছে টার্মিনালটি হস্তান্তর এবং ২০২৪ সালের জুনে কার্যক্রম শুরুর পরও এর সক্ষমতার বড় অংশই অব্যবহৃত রয়ে গেছে।
প্রাথমিকভাবে ১,৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ এবং আধুনিক স্ক্যানার, গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল অপারেটর। তবে এখনো সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি।
ক্ষোভ প্রকাশ করে বন্দর ব্যবহারকারীরা সিপিএকে আহ্বান জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি অপারেটর কেন কনসেশন চুক্তির শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলো—তা তদন্ত করা প্রয়োজন।
এদিকে, ধীরগতির অগ্রগতির কথা স্বীকার করেছে সৌদি অপারেটর আরএসজিটিআই। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, বেশিরভাগ সমস্যা ইতোমধ্যে সমাধান হয়েছে এবং অবশিষ্ট বিষয়গুলো, বিশেষ করে ভারী যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজও চলছে।
জট ও বিলম্ব
অপারেটরের দুর্বল পারফরম্যান্সে ক্ষুব্ধ হয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (সিসিএএ) গত ৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি দিয়েছে। এতে আরএসজিটিআইয়ের বিরুদ্ধে অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা এবং অবকাঠামোগত সংকট সমাধানে ব্যর্থতার অভিযোগ আনা হয়।
নকশা অনুযায়ী ইয়ার্ডের ধারণক্ষমতার বাইরে গিয়ে অনেক কনটেইনার জমা রাখা হচ্ছে। এর ফলে ভয়াবহ জট তৈরি হচ্ছে, যা এলসিএল (লেস-দ্যান-কনটেইনার-লোড) কার্গো খালাস এবং এফসিএল (ফুল-কনটেইনার-লোড) পণ্য সরবরাহ—দুটিতেই দীর্ঘ বিলম্ব ঘটাচ্ছে।
যেখানে এই কাজ শেষ হওয়ার কথা কয়েক ঘণ্টায়, সেখানে এখন কয়েক দিন সময় লেগে যাচ্ছে। এতে শিল্পখাতজুড়ে সরবরাহ চেইনে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।
আমদানিকারকদের অভিযোগ, কাঁচামাল সময়মতো কারখানায় পৌঁছাচ্ছে না। এতে উৎপাদন কমাতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
অন্যদিকে, রপ্তানিকারকরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চালান পাঠাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ফলে জরিমানা গুনতে হচ্ছে এবং বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সরঞ্জামের ঘাটতি ও অদক্ষ জনবল
সমস্যার মূল কারণ আধুনিক কার্গো হ্যান্ডলিং সরঞ্জামের অভাব। গ্যান্ট্রি ক্রেন, স্ক্যানার ও পর্যাপ্ত আরটিজি (রাবার-টাইয়ার্ড গ্যান্ট্রি ক্রেন) না থাকায় নির্দিষ্ট সময়ে প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম কার্গো খালাস হচ্ছে।
কাস্টমস এজেন্টদের অভিযোগ, বর্তমানে যে যন্ত্রপাতি ব্যবহার হচ্ছে তা অদক্ষ জনবল দিয়ে পরিচালিত হওয়ায় পণ্যেরও ক্ষতি হচ্ছে।
জনবলের ঘাটতি সমস্যাকে আরও প্রকট করেছে। টার্মিনালের অধিকাংশ শ্রমিকরা যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন। ফলে স্বাভাবিক লোডিং ও আনলোডিং কাজ শেষ করতে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগছে।
মানোন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত দক্ষ শ্রমিক নিয়োগ, কাঠামোবদ্ধ প্রশিক্ষণ এবং নিয়মিত তদারকি চালুর দাবি তুলেছেন কাস্টমস এজেন্টরা।
চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের কাস্টমস বিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ রেজাউল করিম স্বপন বলেন, "এই টার্মিনাল আধুনিক প্রযুক্তি এনে বাণিজ্যের গতি বাড়ানোর জন্য চালু হয়েছিল। কিন্তু ১৫ মাস পরও আমরা সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন দেখতে পাইনি। আমদানিকারক, রপ্তানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্টরা প্রতিদিনই এই অপারেটরের অদক্ষতার কারণে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন।"

সতর্কবার্তা উপেক্ষা ও বাড়তি ক্ষতি
বন্দরসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, টার্মিনাল আউটসোর্স করার সময় সিপিএ প্রাথমিক সতর্কবার্তা উপেক্ষা করেছিল। ২০২২ সালের শেষ দিকে ট্রায়াল অপারেশনে দেখা গিয়েছিল, সিপিএ নিজস্ব ব্যবস্থায় দক্ষতার সঙ্গে জাহাজ পরিচালনা করতে সক্ষম। তখনই ৪৬০ কোটি টাকার সরঞ্জাম কেনার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছিল। কর্মকর্তারা তখন ধারণা করেছিলেন, বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরুর এক বছরের মধ্যেই এই খরচ উঠে আসবে।
কিন্তু প্রভাবশালী মহলের চাপে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব আরএসজিটিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। এখন পর্যন্ত সৌদিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি প্রতিশ্রুত ১,৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগও করেনি।
ফলে দেশের সবচেয়ে ব্যস্ত সমুদ্রবন্দরের চাপ কমানোর জন্য নির্মিত টার্মিনালটি এখন ব্যাপকভাবে অব্যবহৃত রয়ে গেছে।
কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, সম্ভাব্য আয় থেকে ইতোমধ্যেই রাষ্ট্র হাজার হাজার কোটি টাকা হারিয়েছে।
কী বলছে আরএসজিটিআই
কনটেইনার খালাসে বিলম্বসহ নানা সমস্যায় সিসিএএ যে অভিযোগপত্র দিয়েছে, সেটি পাওয়ার কথা স্বীকার করেছে এই অপারেটর।
পিসিটির কাস্টমার রিলেশনস প্রধান সৈয়দ তারিক বলেন, "সমস্যার সমাধানে আমরা ইতোমধ্যেই স্টেকহোল্ডার এবং সিপিএর সঙ্গে বৈঠক করেছি।"
তিনি আরও বলেন, "টার্মিনালে জট তৈরি হয়েছে মূলত আমাদের সক্ষমতার বাইরে অতিরিক্ত জাহাজ ভেড়ানোর কারণে। আমরা যেখানে ৪ থেকে ৫টি জাহাজ সামলাতে সক্ষম, গত দুই মাসে সেখানে ৮ থেকে ৯টি জাহাজ সামলাতে হয়েছে।"
সরঞ্জাম স্থাপনের বিষয়ে সৈয়দ তারিক বলেন, "চারটি আরটিজি ইতোমধ্যেই এসে গেছে, যা অক্টোবরের শেষ নাগাদ চালু হবে। আরও ১০টি আসার পথে। আগামী জানুয়ারির মধ্যে চারটি গ্যান্ট্রি ক্রেন আসবে এবং এপ্রিলের মধ্যে সেগুলো চালু হবে।"
তিনি আরও জানান, "বর্তমানে আমরা মাসে ১৫ হাজার থেকে ১৭ হাজার টিইইউ সামলাচ্ছি। সব সরঞ্জাম স্থাপন সম্পন্ন হলে মাসে ৩০ হাজার টিইইউ'র বেশি সামলানো সম্ভব হবে।"
কী বলছে বন্দর কর্তৃপক্ষ
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (সিপিএ) সচিব ও মুখপাত্র মোহাম্মদ ওমর ফারুক জানান, ৭ সেপ্টেম্বর এক বৈঠকে আরএসজিটিআইকে দ্রুত কার্যক্রম জোরদারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, "আমরা শিগগিরই অগ্রগতি আশা করছি। রাজস্বের পাশাপাশি এ অংশীদারিত্ব বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের কূটনৈতিক সম্পর্ককেও আরও দৃঢ় করছে।"
তবে কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পৌঁছাতে আরও এক থেকে দুই মাস সময় লাগতে পারে। ফলে ব্যবসায়ীদের জন্য তাৎক্ষণিক স্বস্তির খবর নেই।
সুযোগ নষ্ট
পতেঙ্গা টার্মিনালকে মূলত একটি ফ্ল্যাগশিপ সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব প্রকল্প হিসেবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, যা বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর কার্যক্রমে আধুনিকায়নের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারত। কিন্তু ১৫ মাস পর তা পরিণত হয়েছে সময়সীমা ভঙ্গ, অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি ও বাড়তে থাকা ক্ষতির গল্পে—যার ভার সরাসরি পড়ছে আমদানিকারক, রপ্তানিকারক এবং পুরো অর্থনীতির ওপর।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, "আমরা এই বিশ্বখ্যাত অপারেটরকে স্বাগত জানিয়েছিলাম, যেহেতু তাদের বিভিন্ন দেশে টার্মিনাল পরিচালনার অভিজ্ঞতা আছে। আশা করেছিলাম আধুনিক প্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিকমানের দক্ষতা পিসিটিতে দেখা যাবে। কিন্তু তাদের কার্যক্রমে আমরা এখন গভীরভাবে হতাশ।"
তিনি আরও বলেন, কেন অপারেটর প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হলো তা খতিয়ে দেখা এবং কনসেশন চুক্তির দুর্বলতাগুলো এই ফলাফলের পেছনে ভূমিকা রেখেছে কি না তা বন্দর কর্তৃপক্ষের পর্যালোচনা করা উচিত।