গুরুত্বপূর্ণ শিল্পে কর-ছাড় বাতিলের প্রস্তাব, আসতে পারে করের বড় চাপ

নতুন অর্থবছরের বাজেটে দেশীয় গুরুত্বপূর্ণ শিল্পখাতে কর অব্যাহতি ব্যাপকভাবে তুলে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। রাজস্ব নীতিতে এটি একটি বড় ধরনের পরিবর্তন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। পরিবর্তনগুলো কার্যকর হলে উৎপাদন, নির্মাণ ও ই-কমার্সসহ বিভিন্ন খাতে করের চাপ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, মোবাইল ফোন, ইলেকট্রনিক্স, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, টয়লেট্রিজ, এলপিজি সিলিন্ডার, লিফট, রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার ও কম্প্রেসর উৎপাদনকারী শিল্পে বড় অঙ্কের কর বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত তুলার সুতা ও কৃত্রিম তন্তুও এর আওতায় আসবে। পাশাপাশি নির্মাণ খাত ও রড তৈরির গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালের ওপরও কর বাড়ানোর প্রস্তাব থাকছে।
নির্মাণ খাতও ঝুঁকিতে
অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণ খাতও কর বৃদ্ধির বাইরে থাকছে না। ডুপ্লেক্স বোর্ড, কোটেড কাগজ ও সিমেন্ট শীট উৎপাদনে অতিরিক্ত ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব রয়েছে। এ ছাড়া নির্মাণ কোম্পানির ক্ষেত্রে বর্তমানে ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট হার বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকার মনে করছে, এতে অতিরিক্ত ৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে।
ডিজিটাল অর্থনীতিতেও বড় পরিবর্তন আসতে পারে। বিশেষ করে অনলাইনে পণ্য বিক্রিতে কমিশনের ওপর ভ্যাট তিনগুণ বাড়িয়ে ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব রয়েছে। ফলে দেশের ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ও বিক্রেতারা চাপে পড়বেন বলে মনে করা হচ্ছে।
আমদানি শুল্ক ছাড় কমছে
শুধু ভ্যাট নয়, অন্তত ১৪টি শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামালের ওপর বিদ্যমান আমদানি শুল্ক ছাড়ও কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এতে আমদানির সময়েই উচ্চ শুল্ক দিতে হবে, ফলে উৎপাদন খরচ বাড়বে। পাশাপাশি ১৫২টি পণ্য ও কাঁচামালের আমদানিতে ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) আরোপের প্রস্তাব রয়েছে, যা খরচের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। এ ছাড়া অনেক শিল্পখাতে করপোরেট টার্নওভার করের হার বাড়ানোর কথাও ভাবা হচ্ছে।
তবে কিছু নির্দিষ্ট খাতে সীমিত কর-সুবিধা বহাল থাকতে পারে। পরিবেশবান্ধব পণ্য ও বৈদ্যুতিক বাইক উৎপাদনে কর ছাড় বজায় রাখার প্রস্তাব রয়েছে।
ভোক্তার ওপর চাপ
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান সতর্ক করে বলেন, প্রস্তাবিত ভ্যাট ও কর বৃদ্ধির ফলে শিল্পখাতে চাপ বাড়বে, যার প্রভাব সরাসরি ভোক্তার ওপর পড়বে। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে বলেন, 'এর ফলে ভোক্তার কর ব্যয় বাড়বে।' তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কর রেয়াত সুবিধা পাওয়া শিল্পখাতগুলোর ওপর সেই সুবিধা সীমিত করার চাপও রয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব কমাতে তিনি ব্যবসা পরিচালনার খরচ কমানো এবং লজিস্টিকস খাত উন্নয়নের ওপর জোর দেন।
আগামী ২ জুন অর্থ উপদেষ্টা জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করবেন। সেদিনই বাজেট অধ্যাদেশ পাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী অর্থবছরে অতিরিক্ত কর ও ভ্যাট থেকে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করতে চায় সরকার। মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা।
যেসব প্রধান থাকে চাপ বেশি
সবচেয়ে বেশি চাপ পড়তে পারে দেশের বস্ত্র খাতে। বর্তমানে তুলা ও কৃত্রিম তন্তু উৎপাদনে কেজিপ্রতি ৩ টাকা হারে ভ্যাট দিতে হয়, যা ৫ টাকায় বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। পাশাপাশি তুলা আমদানিতে দীর্ঘদিনের শূন্য কর সুবিধা তুলে দিয়ে ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর আরোপের চিন্তা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বস্ত্র খাতে বর্তমানে ১৫ শতাংশ করপোরেট করহার বাড়িয়ে ২২.৫ শতাংশ থেকে ২৭.৫ শতাংশ করার প্রস্তাবও থাকছে।
এতে দেশীয় উৎপাদন চরম সংকটে পড়বে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। সাভারের লিটল স্টার স্পিনিং মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম বলেন, 'গ্যাস সংকটে এমনিতেই টিকে থাকার লড়াই করছি। আমার মিল এখন মাত্র ৩০ শতাংশ সক্ষমতায় চলছে। এই অবস্থায় সুতা উৎপাদনে ভ্যাট বাড়লে কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।' তিনি বলেন, রপ্তানির ক্ষেত্রে ভ্যাট নেই, অথচ স্থানীয় তাঁতিরা—যারা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কাপড় তৈরি করেন—তারা বাড়তি ভ্যাটের চাপ সামলাতে পারবেন না। এতে পোশাকের দাম বাড়বে।
হার্ডওয়্যার নির্মাতাদের জন্য ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭.৫ শতাংশ করা হতে পারে। এই খাতের মধ্যে স্ক্রু, নাট, বোল্ট, বৈদ্যুতিক লাইনের যন্ত্রাংশ এবং পোল হার্ডওয়্যার নির্মাতারা অন্তর্ভুক্ত। অনলাইন স্ট্রিমিং ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ওপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব রয়েছে।
মোবাইল ফোন উৎপাদনে বর্তমানে ২, ৫ ও ৭.৫ শতাংশ যে তিনটি ভ্যাট হার আছে, তা বাড়িয়ে যথাক্রমে ৪, ৭.৫ ও ১০ শতাংশ করা হতে পারে। তবে এই হার দুই বছরের জন্যই প্রযোজ্য হবে। এলিভেটর এবং ব্লেন্ডার, জুসার, আয়রন, রাইস কুকার ও ইলেকট্রিক কেটলির মতো ছোট ইলেকট্রনিক পণ্য নির্মাতারা ২০৩০ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান ৫ শতাংশ ভ্যাট সুবিধা পেতে পারেন।
তবে ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেকট্রিক ওভেন এবং এলপিজি সিলিন্ডার নির্মাতাদের জন্য ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। সাবান ও শ্যাম্পুর কাঁচামাল (যেমন এলএবিএসএ, এসএলইএস) আগামী অর্থবছরে ৫ শতাংশ ভ্যাট ছাড় পেতে পারে, যদিও ভবিষ্যতে তা বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
সিগারেট প্রস্তুতকারকদের টার্নওভার ট্যাক্স ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হতে পারে। আমদানি করা সিগারেট পেপারের ওপর সম্পূরক শুল্ক ১৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০০ শতাংশ করার প্রস্তাব রয়েছে। এদিকে, ইলেকট্রিক বাইক নির্মাতাদের জন্য আগের ভ্যাট ছাড় তুলে নিয়ে এখন ১৫ শতাংশ ভ্যাট কার্যকর করার প্রস্তাব রয়েছে। একইভাবে, ফ্রিজ, ফ্রিজার, এয়ার কন্ডিশনার ও কম্প্রেসর উৎপাদনকারীদের জন্যও ১৫ শতাংশ ভ্যাট কার্যকর হতে পারে।
টার্গেটেড কর-ছাড়ের উদ্যোগ
যদিও সামগ্রিকভাবে কর বাড়ানো হচ্ছে, কিছু নির্দিষ্ট খাত ও করদাতার জন্য স্বস্তির ব্যবস্থাও রাখা হচ্ছে। প্রান্তিক করদাতাদের জন্য ব্যাংকে বার্ষিক জমার করমুক্ত সীমা এক লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ টাকা করার প্রস্তাব রয়েছে, যা কিছুটা হলেও স্বস্তি দেবে।
এলএনজি আমদানিতে ভ্যাট ছাড় অব্যাহত রাখা হতে পারে। এতে করে আমদানির পর্যায়ে নয়, সরবরাহের ধাপে ভ্যাট আরোপ হতে পারে, যাতে রাজস্ব আদায়ে প্রভাব না পড়ে। পরিবেশবান্ধব শিল্প, যেমন ইলেকট্রিক বাইক এবং পাতা-ফুল-কাণ্ড দিয়ে তৈরি বায়োডিগ্রেডেবল পণ্যের নির্মাতারা বিশেষ কর-ছাড় পেতে পারেন।
আরও যেসব খাতে ছাড় দেওয়া হতে পারে তার মধ্যে রয়েছে স্যানিটারি ন্যাপকিন, প্যাকেটজাত তরল দুধ, বলপেন এবং যাত্রী পরিবহনের বিমা ভাড়ার সম্পূরক শুল্ক। আইসক্রিমের ওপর সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব রয়েছে। স্যানিটারি ন্যাপকিন ও ডায়াপারের কাঁচামাল, হাসপাতালের বেড তৈরির সরঞ্জাম এবং ওষুধশিল্পে ব্যবহৃত অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই) তৈরির কাঁচামালে ২০৩০ সাল পর্যন্ত ভ্যাট ছাড় বজায় রাখা হতে পারে।
উৎসে কর ও করপোরেট করের সমন্বয়
কাপড়সহ ১৫০টির বেশি পণ্যের আমদানিতে ২ শতাংশ উৎসে কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা পণ্যের দামে প্রভাব ফেলতে পারে। সিগারেট নির্মাতাদের জন্য এই হার ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ এবং টার্নওভারভিত্তিক উৎসে কর ০.৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করার প্রস্তাব রয়েছে।
অন্যদিকে কিছু খাতে উৎসে কর কমানোর পরিকল্পনাও আছে। মোবাইল ফোন কোম্পানির জন্য উৎসে কর কমানো হতে পারে। ঠিকাদারদের ক্ষেত্রে এই হার ৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ এবং কৃষিখাতে চাল, গম ও আলুসহ ২৭টি পণ্যের ওপর উৎসে কর ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.৫ শতাংশ করার প্রস্তাব রয়েছে।
জমি রেজিস্ট্রেশনের করহার ৪, ৬ ও ৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩, ৪ ও ৬ শতাংশ করার পরিকল্পনা আছে। পুনর্ব্যবহারযোগ্য শিল্পের কাঁচামালে কর ৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১.৫ শতাংশ, গ্যাস বিতরণ কোম্পানির উৎসে কর ২ শতাংশ থেকে ০.৬ শতাংশ এবং তেল পরিশোধন কোম্পানির কর ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১.৫ শতাংশ করার চিন্তা রয়েছে।
ইন্টারনেট সেবায় কর ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ, বিদ্যুৎ বিলের কর ৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশ এবং মোবাইল অপারেটরদের কর ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১.৫ শতাংশ করা হতে পারে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক কর্মকর্তার ভাষ্য অনুযায়ী, এই করহার সমন্বয়ের উদ্দেশ্য হলো এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করা, যেখানে কোনো কোনো কোম্পানি প্রকৃত মুনাফার চেয়ে বেশি উৎসে কর দিচ্ছে—ফলে বড় অঙ্কের রিফান্ড দাবি তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, 'এই সমস্যার সমাধানে সরকার খাতভিত্তিক গড় মুনাফা হিসাব করে উৎসে কর হার সমন্বয় করছে। এতে কিছু খাতে কর বাড়ছে, আবার কিছু খাতে কমছে।'