ছোট ইসলামী ব্যাংকগুলোকে একীভূত করে বড় দুটি ব্যাংক গঠনের পরিকল্পনা করছে সরকার: গভর্নর

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, দেশের সমস্যাগ্রস্ত ছোট ইসলামী ব্যাংকগুলোকে একীভূত করে দুটি বড় ইসলামী ব্যাংক গঠন করা হবে।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) আয়োজিত ১০ম বার্ষিক ব্যাংকিং সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।
গভর্নর বলেন, দেশে একটি বড় ইসলামী ব্যাংক ছাড়াও বেশ কিছু ছোট ইসলামী ব্যাংক রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে অনেকেই সমস্যার মুখোমুখি। এসব ছোট ব্যাংকগুলোকে একীভূত করে দুটি বড় ইসলামী ব্যাংক গঠন করা হবে। যদিও ইসলামী ব্যাংকিংয়ের জন্য পূর্ণাঙ্গ আইন এখনও তৈরি হয়নি, তবে আন্তর্জাতিক মানের একটি ফ্রেমওয়ার্ক তৈরির জন্য কাজ চলছে।
অর্থপাচার নিয়ে গভর্নর বলেন, বিদায়ী সরকারের সময় ব্যাংকিং খাতের মাধ্যমেই ব্যাপক হারে অর্থপাচার হয়েছে। এসব টাকা ফেরত আনার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মাল্টি-এজেন্সি উদ্যোগ নিচ্ছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এই প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। এটা শুধু আইনগত নয়, নৈতিক বিষয়ও।
তিনি বলেন, ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা কোনোভাবেই পুনরাবৃত্তি হতে দেয়া হবে না। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত পাওয়া গেলে ভালো, তবে আমরা তাদের জীবন আমরা কঠিন করে তুলব।
তিনি আরও বলেন, কোনো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ যদি ব্যাংকিং নীতিমালা অনুযায়ী কাজ না করে, তাহলে আমানতকারীদের স্বার্থে আমরা অবশ্যই হস্তক্ষেপ করব—এবং তা জোরালোভাবেই করব। ইতোমধ্যে আমরা ১১টি ব্যাংকের বোর্ড ঠিকমতো কাজ না করার কারণে পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ দিয়েছি। কিছুদিন আগেও দুটি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়েছে।
গভর্নর আশাবাদ ব্যক্ত করেন, ব্যাংকগুলো নিজেরাই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে। অন্যথায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করবে এবং জনগণের আমানতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
'আমরা সেই বার্তা স্পষ্ট ও জোরালোভাবে দিতে চাই', যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংস্কারের মাধ্যমে গভর্নেন্স, বোর্ডের গঠন, সদস্যদের যোগ্যতা যাচাই এবং স্বাধীন পরিচালক নিয়োগে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করা হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার সংস্কারের কাজও চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও কার্যকর ও স্বায়ত্তশাসিত করতে আমরা কাজ করছি।
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংক পরিচালনা করবে পরিচালনা পর্ষদ। তবে আমরা দেখব তারা এবং ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে কাজ করছে কি না। রেগুলেটর হিসেবে আমরা প্রতিদিন হস্তক্ষেপ করব না, তবে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখব—আপনারা ভালো করছেন, নাকি খারাপ করছেন।
ডিজিটাল ব্যাংকিং প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, ডিজিটাল ব্যাংকিং লাইসেন্সের প্রক্রিয়াও আমরা পুনর্বিবেচনা করছি, যাতে ছোট ও অতি ক্ষুদ্র ঋণ সহজভাবে দেওয়া যায় এবং অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ে। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের (এমএফএস) মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে, যা রেকর্ড। এর মাধ্যমে আর্থিক সেবায় মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে।'
গভর্নর আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের ব্যাংকিং খাত আরও শক্তিশালী ও শ্রদ্ধার জায়গায় পৌঁছাবে। বর্তমানে কিছু ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি রয়েছে। এসব ব্যাংককে আমরা ধীরে ধীরে ঘাটতি থেকে শূন্য এবং পরে ইতিবাচক অবস্থায় নিয়ে যাব। তবে এতে সময় লাগবে। তবে আমরা আশা করি রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
সম্মেলনের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইবিএম-এর মহাপরিচালক মো. আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন, বছরব্যাপী ব্যাংকিং খাত ও সামগ্রিক অর্থনীতির পরিবর্তনগুলো বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের জন্য এই সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংকিং খাতের পরিবর্তনশীল নীতিমালা ও প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা করাই এই সম্মেলনের মূল লক্ষ্য।
তিনি আরও বলেন, গত এক দশকে বাংলাদেশের আর্থিক খাতে উল্লেখযোগ্য রূপান্তর ঘটেছে। প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ফলে গ্রাহকসেবা, খরচ নিয়ন্ত্রণ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন এসেছে। পাশাপাশি টেকসই অর্থনীতির পথে যাওয়ার জন্য ব্যাংকিং খাতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় সবুজ ও টেকসই অর্থায়নের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
সম্মেলনে ব্যাংকার, গবেষক, নীতিনির্ধারক ও আর্থিক খাত সংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজনেরা অংশ নেন।