‘হুমকি’, মামলায় যেভাবে এস আলমের ১০,৫০০ কোটি টাকা ঋণ আদায় করতে পারছে না ইসলামী ব্যাংক

কয়েক বছর আগেই ঋণ খেলাপি হওয়া ১০ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা উদ্ধার করা নিয়ে ইসলামী ব্যাংক ও এস আলম গ্রুপের মধ্যে লড়াই বেড়েই চলছে। ব্যাংকটি বলছে, এই অর্থ উদ্ধারে মর্টগেজ (বন্ধকী) করা সম্পত্তি নিলামে তোলার ক্ষেত্রে কয়েক দফা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির চট্টগ্রাম খাতুনগঞ্জ কর্পোরেট শাখার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নামে নেওয়া এই ঋণ উদ্ধারে প্রথম দুটি নিলামে কোনো বিডার পাওয়া যায়নি।
তাদের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানটি ভীতিপ্রদর্শন ও আইনি কৌশলের মাধ্যমে বন্ধক রাখা সম্পত্তির বিক্রয় প্রক্রিয়া আটকে দিচ্ছে। এরপর দ্বিতীয়বার নিলাম ডাকা হলে আদালতে মামলা করে প্রতিষ্ঠানটি। এতে দাবি করা হয়, যেসব সম্পত্তি নিলামে তোলা হচ্ছে, সেগুলো ব্যাংকের কাছে মর্টগেজ রাখা হয়নি।
সম্ভাব্য ক্রেতারা ভীত
ইসলমাী ব্যাংক খাতুনগঞ্জ কর্পোরেট শাখার সিনিয়ির ভাইস-প্রেসিডেন্ট (এসভিপি) মুহাম্মদ জামাল উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, গত এপ্রিল মাসে নিলাম ডাকা হলে কোনো বিডার পাওয়া যায়নি। ফলে গত জুলাই মাসে দ্বিতীয়বার নিলাম ডাকা হয়। কিন্তু এস আলম আগেরবার নানা প্রভাব খাটিয়ে কোনো বিডারকে নিলামে অংশ নিতে দেননি। যাদের অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা ছিল, তাদেরও নানাভাবে হুমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়েছে এস আলমের লোকেরা।
তিনি আরও বলেন, 'জুলাই মাসে দ্বিতীয়বার নিলাম ডাকার পর এস আলম নতুন কৌশল অবলম্বন করে আদালতে মামলা করেন। এতে দাবি করা হয়, এসব সম্পত্তি ব্যাংকের কাছে মর্টগেজ দেওয়া নেই, যা সম্পূর্ণ ভুয়া। মামলার পর আদালত এ বিষয়ে সমন জারি করেন।'
জামাল উদ্দিন বলেন, ''এগুলো 'নিলাম ঠেকানোর জন্য অপকৌশল' মাত্র। আদালতে যথাপোযুক্ত কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবেন না এস আলম। গত ২৪ জুলাই নিলামের দিন ধার্য থাকলেও তার এসব অপকৌশল ও অপপ্রচারের কারণে কোনো বিডার আসেননি।''
'আমরা খুব শিগগিরই আবার নতুন করে নিলাম ডাকব। এতে কাজ না হলে এই মোটা অঙ্কের খেলাপি ঋণ আদায়ে আদালতের আশ্রয় নেওয়া হবে', যোগ করেন তিনি।
খেলাপি ঋণ ও আইনি জটিলতা
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ইসলামী ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ ঋণ বিতরণ করা হয়। এই ঋণের একটি অংশ এস আলম গ্রুপ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে গিয়েছে। এর মধ্যে শুধু খাতুনগঞ্জ শাখা থেকেই নেওয়া হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। শেখ হাসিনার পতনের পর এসব ঋণের বেশিরভাগই খেলাপি হয়। এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমও (এস আলম) তখন থেকেই বিদেশে পলাতক রয়েছেন।
অন্যদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বলছে, ঋণের নামে টাকাগুলো নিয়ে বিদেশে পাচার করেছে এস আলম। এজন্য একটি পৃথক মামলাও করেছে দুদক। এসব মামলার তদন্ত চলছে।
আইনি কৌশল, সতর্কতা
পাওনা অর্থ আদায়ে গত এপ্রিলে এস আলমের সুগার মিলের সম্পত্তি ছাড়াও চট্টগ্রাম, ঢাকা ও নরায়ণগঞ্জের প্রায় ২০ একর মর্টগেজড সম্পত্তি অর্থঋণ আদালত আইন অনুযায়ী নিলামে তোলা হয়। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের ইছানগর মৌজায় অবস্থিত এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন প্রায় ১১ একর জমি, ফ্যাক্টরি ভবন ও গুদাম ঘর রয়েছে এই নিলামের তালিকায়।
এসব সম্পত্তি নিবন্ধিত দলিলের মাধ্যমে মর্টগেজ রাখা হয়েছিল। এতে স্বাক্ষর করেছিলেন এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল্লাহ হাসান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল আলম (এস আলম)।
এরপর গত ২৪ জুলাই দ্বিতীয়বার নিলামের জন্য দিন ধার্য করা হয়। এর মধ্যেই ১১ জুলাই চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে মামলা করেন এস আলম। এতে দাবি করা হয়, যেসব সম্পত্তি নিলামে তোলা হচ্ছে, সেগুলো ব্যাংকের কাছে মর্টগেজ দেয়নি এস আলম। মামলার পরিপ্রেক্ষিত্রে এসব সম্পত্তি নিলামে ওঠানো কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়ে ব্যাংকের প্রতি সমন জারি করেন আদালত।
সমন জারির পর এস আলম বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এতে দাবি করা হয়, ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে কোম্পানির কোনো ধরনের দায়-দেনা নেই, ব্যাংকের কোনো দাবিও নাই। সম্পত্তিগুলোর মালিক (এস আলম গ্রুপ) ব্যাংকে কোনো রকম রেজিস্ট্রি বন্ধক প্রদান করেনি। ফলে, কেউ নিলামে অংশ নিলে এস আলম তার দায় নেবে না।
পুরো অর্থ উদ্ধার দুরূহ
ইসলামী ব্যাংক খাতুনগঞ্জ কর্পোরেট শাখার এক কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এস আলমের প্রতিষ্ঠান এস আলম রিফাইন্ড সুগার লিমিটেড প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়। এরপর এক টাকাও পরিশোধ করেনি। চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত সুদে-আসলে ওই ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকায়।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের পুরো নিয়ন্ত্রণ এস আলমের হাতে যাওয়ার পর ব্যাংক কোনোভাবেই ওই ঋণের টাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেনি। উল্টো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নামে আরো কয়েক হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে নিয়ে আত্মসাৎ করা হয়।
তিনি বলেন, এস আলম রিফাইন্ড সুগার মিলের নামে যে টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে, মর্টগেজড থাকা সম্পত্তি বিক্রয় করে সেটা পুরোপুরি ওঠানো সম্ভব নয়। কারণ, এসব সম্পত্তির বর্তমান বাজারমূল্য সর্ব্বোচ্চ ২ হাজার কোটি টাকা হতে পারে।
তিনি জানান, নানাভাবে প্রভাব খাটিয়ে যেসব সম্পত্তি জামানত হিসেবে রেখেছে এস আলম রিফাইন্ড সুগার, সেটার বাজারদর কয়েক গুণ বেশি দেখানো হয়েছে। ফলে ব্যাংক এই মর্টগেজড সম্পত্তি বিক্রয় করে পুরো টাকা তুলতে পারবে না। এরপর পুরো খেলাপি টাকা উদ্ধারে এস আলমের অন্যান্য সম্পত্তি বিক্রয় করার জন্য অর্থঋণ আদালতে মামলা করে ব্যাংক।
ব্যাংক কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ এমরান আহমেদ ভুইয়া টিবিএসকে বলেন, আইন অনুযায়ী যে পরিমাণ ঋণ গ্রাহক নিতে চান, তার বিপরীতে জামানত নেওয়ার বিধান হলো, স্থাবর সম্পত্তি হলে ঋণের সমপরিমাণ মূল্যের সম্পত্তি হতে হবে। এছাড়াও সমপরিমাণ ঋণের বিপরীতে ব্যাংক চেক জামানত হিসেবে গণ্য হতে পারে।
এস আলমের ঋণগুলো নামে বেনামে অনেক সময় মর্টগেজড সম্পত্তির বাজারদার কয়েক শ' গুণ বেশি দেখানো হয়েছে। আবার বেশরিভাগ ঋণের ক্ষেত্রে ভুয়া মর্টগেজ দেখানো হয়েছে। ফলে খেলাপি ঋণ পুরোপুরি ওঠানো বেশ কঠিন, যোগ করেন তিনি।
এস আলমের আইনজীবী যা বলছেন
এস আলমের আইনজীবী মাহ্দী ইবনে হাসান টিবিএসকে বলেন, 'আমরা লক্ষ্য করেছি, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, খাতুনগঞ্জ শাখা সম্প্রতি প্রকাশিত নিলাম বিজ্ঞপ্তিতে নির্দায় সম্পত্তি বেআইনিভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উল্লিখিত সম্পত্তি আমাদের মক্কেল দায়মুক্ত এবং এই ব্যাংকের অনুকূলে নতুন কোনো রেজিস্ট্রি করা বন্ধক সৃষ্ট হয়নি।'
তিনি বলেন, 'নিলাম প্রক্রিয়া গ্রহণের পূর্বে আইন অনুযায়ী কোনো নোটিশ প্রদান করা হয়নি, যা স্পষ্টভাবে আইন ও ক্ষমতার অপব্যবহার। এ বিষয়ে আমরা ইতোমধ্যেই আদালতে মামলা দায়ের করেছি এবং আদালত প্রাথমিকভাবে ব্যাংককে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তাই বিচারাধীন অবস্থায় এই সম্পত্তি সম্পর্কিত নিলাম প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ না করতে সর্বসাধারণকে অনুরোধ করা হচ্ছে।'
ব্যাংক বলছে তাদের কাছে মর্টগেজ রাখা সম্পত্তির সঠিক দলিল রয়েছে, এরপরও কেন আদাতে মামলা করল এস আলম, তা জানতে চাইলেও জবাব দিতে রাজি হননি এই আইনজীবী।
যা বলছে ইসলামী ব্যাংক
জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক খান বলেন, মর্টগেজ প্রমাণের জন্য ব্যাংকের কাছে প্রয়োজনীয় সব আইনি নথি রয়েছে। তিনি এস আলম গ্রুপের দাবিকে 'ভিত্তিহীন' বলে দাবি করেন।
তিনি আরও বলেন, মর্টগেজ রাখা সম্পত্তি বিক্রি করেও যদি পুরো টাকা উদ্ধার না করা যায়, তাহলে ব্যাংক এস আলমের অন্যান্য সম্পত্তিও বিক্রি করবে, যেগুলো সরাসরি ইসলামী ব্যাংকের কাছে মর্টগেজ রাখা হয়নি।
'আমরা এস আলমের মালিকানাধীন বেশ কয়েকটি সম্পত্তি চিহ্নিত করেছি। আইন সেসব সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আমাদের পাওনা আদায়ের ক্ষমতা দেয়। আমরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব', যোগ করেন এই কর্মকর্তা।