চট্টগ্রামে এক বছরে ৭৩,১০১ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মামলা, ৮৬ শতাংশই এস আলম গ্রুপের

গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের এক বছরে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে ৪৬টি ব্যাংক মোট ১ হাজার ২৮টি খেলাপি ঋণের মামলা করেছে। এসব মামলায় জড়িত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৩ হাজার ১০১ কোটি টাকা—যা ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ৯ শতাংশেরও বেশি।
অর্থঋণ আদালত বিশেষায়িত বিচারিক সংস্থা, যা ব্যাংক ও ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে খেলাপি ঋণ ও আর্থিক বিরোধ নিষ্পত্তি করে। আদালতের নথি অনুসারে, এই মামলাগুলো ২০২৪ সালের ১১ আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ৪ আগস্টের মধ্যে দায়ের করা হয়েছে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড মামলার নথি বিশ্লেষণ করে দেখতে পেয়েছে, এসব মামলার মধ্যে মাত্র ৩১টি এস আলম গ্রুপ ও এর প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে, কিন্তু মোট খেলাপি ঋণের ৮৬ শতাংশই তাদের নামে। ইসলামী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক—এই তিন ব্যাংকে গ্রুপটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৩ হাজার ১২৫.৪৮ কোটি টাকা।
শুধু ইসলামী ব্যাংকেই চট্টগ্রামভিত্তিক এই শিল্পগোষ্ঠীর খেলাপি ঋণের অঙ্ক ৫১ হাজার ৩২৭.৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে খাতুনগঞ্জ শাখা থেকেই নেওয়া হয়েছে ৪২ হাজার ১৭৬.৯৪ কোটি টাকা।
ইসলামী ব্যাংকের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ওমর ফারুক খান টিবিএসকে বলেন, 'বিষয়টি তদন্তাধীন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতায় আমরা চারটি অডিট কমিটি গঠন করেছি। রিপোর্টগুলো পাওয়ার পর আমরা বলতে পারব কীভাবে এত অনিয়ম হয়েছে এবং কার কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। সরাসরি এই ধরনের অনিয়মের সাথে জড়িত ছিলেন, ব্যাংকের এমন ৮ থেকে ১০ জন উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে আমরা ইতিমধ্যেই বরখাস্ত করেছি।'
ব্যাংকটির খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে এস আলম গ্রুপের তুলে নেওয়া ঋণ শাখাটির মোট ঋণের ৫৭.৬৯ শতাংশ। এ ঋণের বিপরীতে জামানত রাখা হয়েছে মাত্র ৬ হাজার কোটি টাকা।
এমন বিপুল অঙ্কের ঋণের বিপরীতে অল্প আমানত, ঋণ প্রদানের সময় যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে কি না শাখা ব্যবস্থাপক জামাল উদ্দিন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেন, 'এস আলমের মামলাসহ চট্টগ্রাম অর্থ ঋণ আদালতে আমাদের ২৬টি মামলা চলমান রয়েছে। টাকা আদায়ের জন্য সম্ভাব্য সব আইনানুগ পন্থায় আমাদের চেষ্টাআ অব্যাহত রয়েছে।'
আদালতের নথি থেকে দেখা যায়, এস আলম গ্রুপ এবং এর সহযোগী ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো—যার মধ্যে রয়েছে এস আলম ভেজিটেবল অয়েল, এস আলম সুপার এডিবল অয়েল, এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ, এস আলম স্টিলস, এস আলম ট্রেডিং কোম্পানি, এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিল, সোনালী ট্রেডার্স, ডেল্টা অয়েল রিফাইনারি, সাদিয়া ট্রেডার্স, গ্লোবাল ট্রেডিং কর্পোরেশন, ওজি ট্রাভেলস, সেঞ্চুরি ফুড প্রোডাক্টস, আদিল কর্পোরেশন, ইনফিনিয়া সিনথেটিক ফাইবার, জেনেসিস টেক্সটাইল এক্সেসরিজ অ্যান্ড অ্যাপারেলস, চেমন ইস্পাত, সাভোলা অয়েল ও ইনফিনিটি সিআর স্ট্রিপস—এই তিনটি ব্যাংক থেকে এসব ঋণ নিয়েছে।
ব্যবসায়ী ও আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটিমাত্র গ্রুপকে এত বিপুল পরিমাণ ঋণ দেওয়াই প্রমাণ করে যে বিগত সরকার-ঘনিষ্ঠ এই শিল্পগোষ্ঠী কীভাবে নিয়ম লঙ্ঘন করেছে। এতে ব্যাংকগুলো চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এছাড়া সাধারণ ব্যবসায়ীদের পক্ষে ঋণ পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
চিটাগাং চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ টিবিএসকে বলেন, 'এরা [এস আলম গ্রুপ] ডাকাতের চাইতেও বেশি, এরা ক্রিমিনাল। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাদেরকে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যা ব্যবসায় অসম প্রতিযোগিতা তৈরি করেছিল। এর দ্বারা বহু সাধারণ ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এছাড়া ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোরও একটা দায়বদ্ধতা আছে, কিন্তু এই জায়গায় তারা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।'
তিনি বলেন, কিছু ব্যবসায়ী ব্যাংকের অতিরিক্ত সুদ ও ব্যবসায়িক কারণে ঋণ খেলাপি হয়েছেন, আবার কিছু ব্যবসায়ী ঋণ নিয়েছেনই পরিশোধ না করার উদ্দেশ্য নিয়ে। 'বড় সমস্যা হলো ট্রেডিং লোন ও ইন্ডাস্ট্রিজ লোনে সুদের হার সমান হওয়া। এটা কখনও ন্যায্য হতে পারে না। এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।'
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক ও আইনজীবী আখতার কবির চৌধুরী বলেন 'সরকারি ছত্রছায়ায় আমজনতার টাকা নিয়ে দুর্বৃত্তায়ন করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ ঋণ নিতে গেলে জামানতসহ তার আদ্যোপান্ত, বহু কাগজপত্র জমা দিতে হয়। আর এদেরকে ব্যবসার নামে হাজার কোটি টাকা দিয়ে দিয়েছে কোনো কিছু ছাড়াই।'
চট্টগ্রাম অর্থ ঋণ আদালতে মামলার চাপ
এতদিন চট্টগ্রামে মাত্র একটি অর্থঋণ আদালত ছিল, তবে গত ১৮ জুন আরও দুটি নতুন আদালত গঠন করা হয়েছে। সেখানে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে দুজন যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজকে। মামলার নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত করতে এবং বিচারিক বিলম্ব কমাতে গত ১ জুলাই থেকে সীমিত পরিসরে শুনানি শুরু হয়েছে।
চট্টগ্রামের তিনটি অর্থঋণ আদালতে প্রায় ৫ হাজার ২০০ মামলা বিচারাধীন থাকায় মামলা জট একটি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এস আলমের বিপুল খেলাপি ঋণের শিকার জনতা ব্যাংকও
এস আলম গ্রুপকে দেওয়া খেলাপি ঋণের পরিমাণে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে জনতা ব্যাংক। ১২ মামলায় ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১১ হাজার ৪৩৫.৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু এস আলম গ্রুপ ও এর প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১১ হাজার ৩৯২.১৪ কোটি টাকা।
যোগাযোগ করা হলে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মুজিবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'একক গোষ্ঠীকে কীভাবে এত ঋণ দেওয়া হয়েছে, এই বিষয়ে আমি অবগত নই। এই বিষয়ে না জেনে কিছু বলতে পারছি না।'
চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দীন বলেন, 'চট্টগ্রামে আমদানিকারকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ব্যবসায়ীদের প্রায় সময় ঋণের প্রয়োজন হয়, কিন্তু ঋণ নিতে গেলে সাধারণ ব্যবসায়ীদের হয়রানির শিকার হতে হয়। অথচ অসাধু ব্যবসায়ীদের তারা হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়ে দেয় অনায়াসে। এখানে ব্যাংক কর্তৃপক্ষও দায়ী, তারা অসাধু ব্যবসায়ীদের হয়ে কাজ করেছে। আর সাধারণ ব্যবসায়ীরা বঞ্চিত হয়েছেন।'
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে এস আলম গ্রুপের খেলাপি ঋণ
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৩৯.৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে একটি মামলাতেই এস আলম ব্রাদার্স লিমিটেডের খেলাপি ঋণ ৪০৬.০৩ কোটি টাকা।
ইসলামী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের দায়ের করা ৩১টি মামলা ছাড়াও এই শিল্পগোষ্ঠী অন্যান্য ব্যাংকেও ঋণখেলাপি হয়েছে।
সবচেয়ে বড় মামলা ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখার
খেলাপি ঋণের সবচেয়ে বড় মামলা ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখায়, যার পরিমাণ ১৩ হাজার ৩১৭.৩৪ কোটি টাকা। এই মামলায় এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমসহ ১৪ জনকে বিবাদী করা হয়েছে। মামলাটির বিচারকার্য চলমান রয়েছে।
এর পরের শীর্ষ চার খেলাপি ঋণের মামলাও এস আলম গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখায় এস আলম ভেজিটেবল অয়েলের খেলাপি ঋণ ১০ হাজার ২৮০.৩৬ কোটি টাকা।
খাতুনগঞ্জ শাখার দায়ের করা মামলায় আদালতের নির্দেশে ঢাকার মতিঝিলে এস আলম গ্রুপের একটি চারতলা বাণিজ্যিক ভবনসহ মোট ৫ কাঠা ও ৯.৯০ ডেসিমেল জমি ক্রোক করা হয়েছে।
এছাড়া এস এস পাওয়ার লিমিটেডের ৫৮ কোটি টাকার বেশি মূল্যের শেয়ার, সোনালী কার্ডো লজিস্টিক লিমিটেডের ১১৭.৭৫ কোটি টাকার শেয়ার ও চট্টগ্রামের বাঁশখালীর ৩১ হাজার ২৫১.৭০ ডেসিমেল জমি ক্রোকের আওতায় আনা হয়েছে।
এছাড়াও গুলশানের একটি ব্যাংক শাখায় থাকা এসএস পাওয়ার লিমিটেডের তিনটি মুদারাবা শর্ট নোটিশ ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে। তিন অ্যাকাউন্টে জমা রয়েছে যথাক্রমে ১০২.৩৯ কোটি, ৩৫.৮৫ কোটি ও ০.৭৭৮ কোটি টাকা।
ইসলামী ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখায় মেসার্স সোনালী ট্রেডার্সের ৪ হাজার ৯৫৩.৫৮ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের ঘটনায় গত ৪ জুলাই চট্টগ্রাম অর্থ ঋণ আদালতে মামলা দায়ের করে। একই শাখায় এস আলম গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান চেমন ইস্পাত (৩ হাজার ৬১৬.৫৫ কোটি টাকা) ও ইনফিনিটি সিআর স্ট্রিপসের (২ হাজার ৮২১.৬৮ কোটি টাকা) বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়েছে।
চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ টিবিএসকে বলেন,'কিছু ব্যবসায়ী আছেন যারা ব্যাংকের অতিরিক্ত সুদ ও ব্যবসায়িক কারণে ঋণ খেলাপি হয়েছেন, আর কিছু খেলাপির জন্যই ঋণ নিয়েছেন। এরা ডাকাতের চাইতেও বেশি, এরা ক্রিমিনাল। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাদেরকে সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যা ব্যবসায় অসম প্রতিযোগিতা তৈরি করেছিল। এর দ্বারা বহু সাধারণ ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এছাড়া লোন দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোরও একটা দায়বদ্ধতা আছে কিন্তু এই জায়গায় তারা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ব্যাংকগুলোর কোনো তদারকি নেই, নেই কোনো গবেষণা। আর ঋণ খেলাপির মূল কারণ ট্রেডিং লোন ও ইন্ডাজট্রিজ লোনে সুদের হার সমান হওয়া। এটা কখনো ন্যায্য হতে পারে না। এই বিষয়ে সংশ্লিষ কর্তৃপক্ষকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।'
বাংলাদেশ ব্যাংক যা বলছে
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান টিবিএসকে বলেন, 'ঋণ বিতরণ ও আদায়ের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্পষ্ট নীতিমালা রয়েছে। প্রতিটি তফসিলি ব্যাংক সেই নীতিমালার আলোকে ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা হলো এই নীতিমালা বাস্তবায়ন ও তদারকি করা। ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে কোথাও অসংগতি থাকলে আমরা তা ব্যাংককে অবহিত করি।
'এর পরেও ঋণ অনুমোদন বা ব্যবহারে নীতিমালার ব্যত্যয় ঘটলে সেটি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের দায়িত্ব। তবে আমরা বিষয়টি নজরদারিতে রাখি এবং আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে থাকি।'