রেলের র্যালা

রেলগাড়ির অভিজ্ঞতা আমাদের কমবেশি সবারই রয়েছে–'আ জার্নি বাই ট্রেন' রচনা বহুবার লিখেছি ছোটবেলায়। রেলওয়ের শুরুতে ছিল ডিনামাইট ফাটিয়ে পাহাড় ফুঁড়ে সুড়ঙ্গ গড়া, রেলওয়ের পরের ইতিহাস বন কেটে গাছের গুঁড়ি আর নদী সেঁচে পাথর কুড়াবার গল্প...অর্থাৎ রেলগাড়ির আদ্যোপান্ত প্রকৃতি-বিধ্বংসী, মেটাফর হিসেবে এবং বাস্তবিক। যদিও বহু মানুষ একত্রে পরিবহণ করতে পারে বলে রেলগাড়ি এখন 'গ্রীন'। রেলরোড তৈরিতে বহু অভিবাসী গেছে একেক মহাদেশে, তারপর মিলেছে–মিলিয়েছে। তদুপরি রেলগাড়ি বহু দুর্ঘটনার নায়ক। আজ লিখবো সাহিত্যে আর সিনেমায় রেলগাড়ি-রেললাইন-রেলস্টেশন-রেলওয়ে ট্যাভার্ন কতরকম ব্যঞ্জনা বয়ে এনেছে সেসব কথা।
ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে রাত দুপুরে অই
বাংলা শিশুতোষ কবিতা দিয়ে শুরু–'আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি/ যদু মাস্টার শ্বশুরবাড়ি'র সেই লাইন–"ইস্টিশনের মিষ্টি কুল, শখের বাদাম গোলাপফুল। রেল কাম ঝমাঝম (নাকি রেন কাম ঝমাঝম?)। পা পিছলে আলুর দম।" সিপাহী বিদ্রোহের এক বছর পর ১৮৫৮ সালের ১৫ আগস্ট নাকি বাঙলায় প্রথম রেল চলেছিল হাওড়া থেকে হুগলি, সে আমলে হুগলি স্টেশনের মাস্টার ছিলেন যোগীন্দ্রলাল আঢ্য ওরফে যগু মাস্টার, অপভ্রংশক্রমে যদু মাস্টার। কোথায় পড়েছিলাম ভুলে গেছি। লোকের মুখে শেখা ছড়া ছিল- 'ঝিক্কির ঝিক্কির মৈমনসিং, আইতে যাইতে কত দিন'।
"ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই?"
শামসুর রাহমান লিখেছেন ওসব শিশুতোষ কবিতা, বড়দের জন্য লিখেছেন 'ট্রেনের জানালা থেকে'।
"ভোরবেলাকার ট্রেন হুইসল্ বাজাতে বাজাতে/ ছুটে যাচ্ছে, গাছগাছালির আড়ালবর্তিনী ডুরে-শাড়ি-পরা/ যৌবন দাঁড়িয়ে আছে আমার ভিতরে।" এই 'বড়দের জন্য' কথাটা লিখতে গিয়ে হাসি পেলো, আজকাল এ ব্যবধান ঘুচে গেছে।
"কামরায় গাড়িভরা ঘুম, /রজনী নিঝুম।" রবীন্দ্রনাথের 'রাতের গাড়ি'র লাইন, অপুর্ব সেই কবিতা, রাতের রেলগাড়ির চলন সেখানে মানুষের প্রাণের মেটাফর। আর তাঁর "রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা, ভাবি নি সম্ভব হবে কোনো দিন।" এর সেই দৈবক্রমে দেখা হয়ে যাওয়া প্রেমিকযুগলকে নিয়ে কবিতা কি ভোলা যায়? প্রেমিকা আর ডালিমরাঙা শাড়ি পরে না, কালো রেশমের ঘোমটার আড়ালে– অনতিক্রম্য দূরত্বে, সামাজিক বাধা ডিঙিয়ে মেয়েটিই কাছে ডাকে– জিজ্ঞেস করে, তাদের যেদিন বিগত, তা একেবারে গেছে কি না। প্রেমিকের স্বরে রবীন্দ্রনাথ লেখেন অমর স্তোকবাক্য– "রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।" 'ফাঁকি' কবিতার বিনুকে মনে আছে? মাত্র তেইশ বছর বয়সে যাকে মরণরোগে ধরলো, ব্যাধির চেয়ে আধি বড় হয়ে উঠলে ডাক্তার হাজামত দিলেন– হাওয়া বদল করো।

"এই সুযোগে বিনু এবার চাপল প্রথম রেলের গাড়ি, / বিয়ের পরে ছাড়ল প্রথম শ্বশুরবাড়ি।" রেলগাড়ির জানালায় দেখা দিল উদার উন্মুক্ত আকাশভরা আলো, যেন শুভদৃষ্টির আয়োজন হলো বরবধুতে নতুন করে। রেললাইনের ওপারের কাঙালি– রেলের কুলী...সব্বাইকে বিনু অন্তরের দাক্ষিণ্যে গ্রহণ করতে লাগলো মুক্তির আনন্দে। ওখানেও ফাঁকি সম্ভব? রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছিলেন, সম্ভব।
আল মাহমুদের কবিতা 'প্রত্যাবর্তনের লজ্জা'র শহরগামী যুবক ট্রেন-ফেল করে ফিরে আসছে নিজ গ্রামে, জলার বকÑ না না করে কাঁপতে থাকা কলাক্ষেতের পাতা– আটচালা ঘর আর বাসী বাসনের পাঁজা হাতে মায়ের কাছে। "শেষ ট্রেন ধরবো বলে এক রকম ছুটতে ছুটতে ষ্টেশনে পৌঁছে দেখি/ নীলবর্ণ আলোর সংকেত। হতাশার মতোন হঠাৎ/ দারুণ হুইসেল দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে... সাত মাইল হেঁটে এসে শেষ রাতের গাড়ি হারিয়ে/ এক অখ্যাত ষ্টেশনে কুয়াশায় কাঁপছি।" এ প্রত্যাবর্তনে সে লজ্জিত, কিন্তু মনে মনে এই যেন সে চেয়েছিল, তার হৃদয় আর তার স্বপ্নহীন নিদ্রায় সমাহিত দেহের এই ছিল অভিলাষ। শহরকে টিকে থাকতে হলে যেমন অনিবার্যভাবে একদিন গ্রামতুল্য হয়ে যেতে হবে তেমনই সূক্ষ্ম আভাস যেন তার লজ্জিত হয়ে ফিরত আসায়। আবুল হাসানের কবিতায়- "একবার ডাউন ট্রেনের মত বৃষ্টি এসে থেমেছিল/ আমাদের ইষ্টিশানে সারাদিন জল ডাকাতের মতো/ উৎপাত শুরু করে দিয়েছিল তারা..." তারাপদ রায়ের কবিতায় ট্রেন ধরবার হাঙ্গামা– "আমার এত ভালো লাগে এইসব ছোটখাটো হাঙ্গামা,/ উত্তরপাড়া স্টেশন পেরিয়ে ডোবার জলে/ অনিশ্চিত রেলগাড়ির দ্রুত চলন্ত ছায়া/ আমার চমৎকার লাগে।"
এলেন তানসান্ কলিকাতায় চড়ে রেলের গাড়ি
এবার বাংলা গল্প-উপন্যাসের দিকে ফিরি। 'ধাত্রীদেবতা'য় কোথাও তারাশঙ্কর লিখেছিলেন– সমস্ত শরীরের রক্ত হৃদপিন্ডে পুঞ্জীভূত করার মতো করে রেলওয়ে কোলকাতায় টেনে আনে সারা দেশের রসদ। রেলগাড়ি এখানেও আল মাহমুদের রেলগাড়ির মতো শহরের শোষণ আর লুন্ঠনের চিরন্তন প্রতীক, তার আলো অলঙ্ঘ্য কুয়াশা আর গাঢ় অন্ধকার ঠেলে গ্রামের মানুষকে নিয়ে যায় শহরে– সে যেন নতুন জমানার আলেয়া– সিটিলাইটসের হাতছানি। রেলগাড়ি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ আছেন, ছইওয়ালা নৌকায় আছেন, নৌকাডুবিতে আছেন, স্টিমারে আছেন... কোথায় নেই! তাঁকে এখানে একটু সংক্ষিপ্ত করে না নিলে ধারণ করা মুশকিল। গল্পগুচ্ছে একটি গল্প আছে 'অপরিচিতা', বিয়েতে যৌতুকের কোন্দলে একটি যুবককে পাত্রীপক্ষ ফিরিয়ে দেয় (রবীন্দ্রনাথের কি দুঃসাহস!), কিন্তু যুবকের মন থেকে পাত্রীর অদেখা রূপ মোছে না। রাতের ট্রেনে চেপে মাকে নিয়ে তীর্থে যাবার সময় সহযাত্রিনীর গলার স্বর শোনে যুবক, তার হৃদয়েও যেন ট্রেনের ছন্দের মতো জাগতে থাকে আশার দোলাচল।
"গাড়ি লোহার মৃদঙ্গে তাল দিতে দিতে চলিল; আমি মনের মধ্যে গান শুনিতে শুনিতে চলিলাম। তাহার একটিমাত্র ধুয়া– 'গাড়িতে জায়গা আছে।' আছে কি, জায়গা আছে কি। জায়গা যে পাওয়া যায় না, কেউ যে কাকেও চেনে না। অথচ সেই না-চেনাটুকু যে কুয়াশামাত্র, সে যে মায়া, সেটা ছিন্ন হইলেই যে চেনার আর অন্ত নাই। ওগো সুধাময় সুর, যে হৃদয়ের অপরূপ রূপ তুমি সেই কি আমার চিরকালের চেনা নয়। জায়গা আছে, আছে–শীঘ্র আসিতে ডাকিয়াছ, শীঘ্রই আসিয়াছি, এক নিমেষও দেরি করি নাই।" নামধাম শোনামাত্র যুবক বুঝতে পারে, এই সেই মেয়েটি। মেয়েটি যে বলেছিল- জায়গা আছে, সেই আশ্বাসের ভিতর যুবকের বাকি জীবনের স্থানসংকুলান হয়ে যায়।

মনে আছে, শরতচন্দ্রের 'গৃহদাহ'তে ঝড়বৃষ্টির রাতে সুরেশের সঙ্গে মোগলসরাইয়ে ভুল ট্রেনে উঠে পড়ে অচলার জীবন চিরদিনের জন্য উলটে গেছিল? স্ত্রী থেকে 'স্বৈরিণী'তে পরিণত হয়েছিল সে। বিভূতিভূষণের 'আরণ্যক' পুর্নিয়ার হাজার হাজার বিঘা বনভূমি ধ্বংস করে বসত গড়ার গল্প–নায়ক বি এন ডব্লিউ রেলওয়ের একটা ছোট স্টেশনে নামে, সারারাত গরুর গাড়িতে চেপে পৌঁছায় কাছারিতে, তারপর একদিন এই তিমিরময়ী বনপথে নামতে নামতে ভাবে, "লবটুলিয়া গিয়াছে, নাঢ়া ও ফুলকিয়া বইহার গিয়াছে- কিন্তু মহালিখারূপের পাহাড় রহিল- ভানুমতীদের ধন্ঝরি পাহাড়ের বনভূমি রহিল। এমন সময় আসিবে হয়তো দেশে, যখন মানুষে অরণ্য দেখিতে পাইবে না- শুধুই চাষের ক্ষেত আর পাটের কল, কাপড়ের কলের চিমনি চোখে পড়িবে, তখন তাহারা আসিবে এই নিভৃত অরণ্যপ্রদেশে, যেমন লোকে তীর্থে আসে। সেই সব অনাগত দিনের মানুষদের জন্য এ বন অক্ষুন্ন থাকুক।" বিভূতিভূষণের রানাঘাটের রেলস্টেশনে 'আদর্শ হিন্দু হোটেল'-এর হাজারী ঠাকুরকে কে ভুলতে পারে, উর্ধ্বশ্বাসে রেলের প্যাসেঞ্জারদের খাওয়াদাওয়া করা আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঠাকুরের ভাত-মাছ-ডাল-ভাজার পদ নামাবার নাভিশ্বাস রুটিন! সুবোধ ঘোষের 'জতুগৃহ' রেলস্টেশনের অপেক্ষাগারে প্রাক্তন স্বামীস্ত্রীর দেখা হবার হৃদয়বিদারী গল্প।
বাংলা সাহিত্যে রেলগাড়ি নিয়ে সবচেয়ে বেশি হয়তো লিখেছিলেন বিমল কর, কেন নয়? রেলওয়ে কলোনি, রেলওয়ে ইনস্টিটিউট লাইব্রেরি, রেলওয়ে অ্যাকাউন্টসে কেরানীর চাকরি...জীবনটাই তাঁর ঘিরে রয়েছে রেলওয়ে। ছোটগল্প 'নিষাদ' প্রথমত জলকু নামের একটি শিশুর গল্প- যে রেলওয়ে স্লিপারের ওপর দাঁড়িয়ে অসাড় রেললাইনে গভীর আক্রোশে পাথর ছুঁড়ে মারে- এই তার খেলা। কিন্তু এ খেলার পেছনে গল্প আছে, জলকুর সোহাগের ছাগলছানা মানিককে হত্যার গল্প, জলকুর পিসীর মেঘলা দুপুরের অভিসার দেখে ফেলার গল্প। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত গল্প জননী, মৃতা মায়ের পাঁচটি সন্তান মায়ের চিত্তসৎকার করছে- মেজ ছেলেটি দানাপুর যাবার ট্রেনে জানালা বন্ধ করে ছিল, সেই জানালায় এক উন্মত্ত বিহারী টিনের সুটকেস ছুঁড়ে মেরেছিল, কাঁচ ভেঙে ফলা ঢুকে মেজ ছেলেটির চোখ অন্ধ হয়ে যায়, নির্বোধ সুটকেসওয়ালা মিশে থাকে স্টেশনের উপচানো ভিড়ে। 'পলাশ' গল্পে রেলের ট্রলিতে চাপিয়ে জামাইবাবু শ্যালিকাকে পলাশফুল ফোটা প্রান্তর দেখাতে নিয়ে চলেছেন, দুর্ঘটনা এখানেও আছে, কিন্তু ভায়োলেন্স নেই। 'বালিকা বধু'তে আপ আর ডাউন মেল ট্রেনের সেই মাঠের জোছনাময় প্রান্ত ফুঁড়ে চলে যাওয়া কে ভুলতে পারে! হুমায়ুন আহমেদের 'নিশিকাব্য' গল্পটার কথা মনে পড়ছে, শেষ ট্রেনে শহরের দিকে ফিরে চলা বিবাহিত তরুণ, পেছনে ফেলে আসা এক রাতের চকিত সংসার।

এখানে একটি পুরস্কারের গল্প উল্লেখ না করলেই নয়, সাহিত্যিক বনফুল আনন্দবাজারকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে শুনিয়েছিলেন সেই গল্প। ভাগলপুর রেলস্টেশনের দিকে একপ্রকার দৌড়ে যাচ্ছিলেন বনফুল, সঙ্গে কুলি। কিন্তু ট্রেন ধরতে পারলেন না, পরের ট্রেন আগামীকাল। হঠাৎ দেখলেন ছেড়ে যাওয়া ট্রেন আবার পিছিয়ে আসছে, কামরার লোকজন চিৎকার করছে। বিমূঢ় বনফুলকে প্রণাম করে এক ভদ্রলোক এসে জানালেন- তিনি এই ট্রেনের ড্রাইভার, বনফুলের সবকয়টি বই তাঁর পড়া। গাড়ি ধরতে বনফুল দৌড়েছিলেন তা তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, বনফুলের জন্য তিনি ট্রেন ব্যাক করে নিয়ে চলে এসেছেন। বনফুলের কাছে সেই ছিল শ্রেষ্ঠ সাহিত্যপুরস্কার।
রেললাইন বহে সমান্তরাল
রেল নিয়ে ইংরেজি গল্প ও উপন্যাস অসংখ্য। এডিথ নেসবিটের 'দ্য রেলওয়ে চিল্ড্রেন' আমার পড়া প্রথম ইংরেজি বই, মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে বাপ জেলে চলে গেলে তিনটি শিশুসন্তানসহ মা চলে আসে রেলওয়ের কাছাকাছি একটি বাড়িতে, সেখানেই গড়ে ওঠে তাদের জীবন। অত্যন্ত সুখপাঠ্য উপন্যাস। পরে যখন আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমস গোগ্রাসে গিলেছি, দেখেছি রেলওয়ে বৃটিশ জাতের বড় গর্বের চিহ্ন, ব্র্যাডশ'জ রেলওয়ে গাইড নিয়ে হোমসের নিয়মিত নাড়াচাড়া। 'দ্য অ্যাডভেঞ্চার অভ ব্রুস পার্টিংটন প্ল্যানস'-এর সেই তরুণ আদর্শবাদী যুবককে ভোলা যায় না, যার মৃতদেহ রেললাইনের ওপর পাওয়া গেলেও হোমসের সন্দেহ হয়- এ রেলে কাটা পড়ে মরেনি। পরে হোমস আবিষ্কার করেন- আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন ওভারগ্রাউন্ডে এসে যেখানে জংশনের ট্রাফিকের কারণে থামে- সেখানেই একটি বাড়িতে যুবককে হত্যা করে জানালা গলিয়ে ট্রেনের ছাদে লাশ রেখে দেয়া হয়, রেললাইন যেখানে দু-ভাগ হয়ে গেছে সেই পথে চলবার সময় ঝাঁকুনিতে যুবকের মৃতদেহ রেললাইনে পড়ে যায়।

রেলওয়ে নিয়ে ক্রাইম ফিকশন আছে আগাথা ক্রিস্টির ('ফোর ফিফটি ফ্রম প্যাডিংটন'), ব্র্যাম স্টোকারের 'ড্রাকুলা'তে জনাথন হার্কার ইউরোপ চিরে ট্রেনে চলেছেন কাউন্ট ড্রাকুলার এস্টেটে- আর ভাবছেন যতোই পূবের দিকে যাচ্ছেন ট্রেনের সময়ানুবর্তিতা ততোই শ্লথ হচ্ছে। চলন্ত ট্রেন মার্ডার মিস্ট্রির চমৎকার বাহন, উদাহরণ ইয়ান ফ্লেমিং-এর 'ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ', কিংবা ক্রিস্টির 'মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস'। 'স্তাম্বুল ট্রেন' গ্রাহাম গ্রীনকে এনে দিয়েছিল তাঁর প্রথম সাফল্য।
এবার মনে করে দেখুন টলস্টয়ের আনা কারেনিনার জীবনের শেষ অধ্যায়টুকু, 'দ্য বিউটি অভ আ ডেথ'-এ মিলান কুন্দেরা এ মুহূর্তগুলো বিশ্লেষণ করেছিলেন। ঘোড়ার গাড়ি ছেড়ে ট্রেনে চেপেছেন আনা কারেনিনা, ট্রেনে তাঁর চোখে পড়ে– উন্মাদিনী নারী, উন্মূল শিশু, উদ্বাস্তু পুরুষ...সবই তাঁর চোখে ঠেকে কুৎসিত বলে... আনার হৃদয় থেকে সুন্দর বিদায় নেয়, সুন্দরের বিদায়ের আধঘন্টার ভিতর আনা আত্মহত্যা করেন। অথচ প্ল্যাটফর্মে তিনি এসেছিলেন ভ্রনস্কির কাছে যাবার জন্য। স্টেশনে মালগাড়ি ঢুকবার সময় তাঁর মনে পড়ে, ভ্রনস্কির সাথে প্রথম দেখা হবার দিনটিতেও কে এক লোক ট্রেনে কাটা পড়েছিল, বেশ তো, দুইটি ট্রেনে কাটা পড়া লাশের বন্ধনীর ভিতর সুরক্ষিত থাকবে তাঁদের নশ্বর সময়টুকু। দু'পা সিঁড়ি দিয়ে নেমে আনা রেললাইনের কাছাকাছি আসেন, মালগাড়িটা আসছে, ঠিক জলে ডুব দেবার আগের মতো শ্বাস জড়ো করা একটা অনুভূতি হয় ওঁর। চরম ট্র্যাজেডির ঠিক আগমুহূর্তে একটি আনন্দস্মৃতির উদ্ভবÑ এইখানে আনার মৃত্যু সফোক্লিসের সৃষ্টি করা ইডিপাসের ট্র্যাজেডির থেকে আলাদা, এখানে সুন্দরের সাথে কুশ্রীতার দ্বন্দ্ব নেই, লজিকের সঙ্গে কার্যকারণহীনতার কলহ নেই, শুধু একটি মুহূর্তের স্মৃতি।

তুফান মেইল যায়
রেল নিয়ে বাংলা সিনেমায় কি কি আছে একবার হিসেব করা যাক। কানন দেবীর 'শেষ উত্তর' ছবিতে গাওয়া সুপারহিট গান আছে- 'তুফান মেল যায়'। 'পথের পাঁচালি'র সেই রেললাইন দেখতে উৎসুক ছেলেমেয়েদুটিকে কে ভুলতে পারে ইহবঙ্গে! 'নায়ক'-এ উত্তমকুমার আর শর্মিলা ঠাকুরের রেলের ডাইনিং কারে সেই কথোপকথন? রেলওয়ের অপেক্ষাগৃহে 'কমললতা'র সেই শেষ প্রণাম? 'সূর্যদীঘল বাড়ি'র চাল বেচতে শহরগামী ট্রেনে উঠে পড়া গ্রামের অনাথা মেয়ের দল? 'গোলাপী এখন ট্রেনে'র ভিখারিনীদের গান?
হিন্দি সিনেমায় রেলওয়েকে অমর করে দিয়ে গেছেন মীনাকুমারী, তাঁর 'পাকিজা'য়, রেলের কম্পার্টমেন্টে নিদ্রিতা বাইজির পায়জোরহীন পায়ের কাছে কেউ রেখে গেছে প্রেমের চিঠি, অদেখার প্রেম এসে সব পুরনো অভ্যাস লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেছে এরপর। সিনেমা জুড়ে বারবার ট্রেনের হুইসল যেন এক অলভ্য প্রেমিকের তীক্ষ্ণ তীব্র আহ্বান। 'যব পেয়ার কিসিসে হোতা হ্যাঁয়'তে আশা পারেখের রেলকামরার সমান্তরালে চলেছে গাড়ি- তার ছাদে আসীন দেব আনন্দ গাইছেন- 'জিয়া ও জিয়া কুছ বোল দো!' 'আরাধনা'তে রেলের সমান্তরাল চলেছে হুডখোলা জিপগাড়ি- তাতে রাজেশ খান্না উত্তাল উদ্যমে গাইছেন- 'মেরে সপনো কি রাণী কব আওগি তু'। 'মেরে হুজুর'-এ মাখনতুল্য মোহম্মদ রফি তথা জীতেন্দ্র বোরকাবৃতা মালা সিনহাকে উদ্দেশ্য করে রেলের বগিতে গাইছেন- 'রুখ সে জারা নেকাব উঠা দো মেরে হুজুর!' ধর্মেন্দ্র-জীতেন্দ্র-হেমামালিনী-বিনোদ খান্নার জমজমাট সিনেমা- 'দ্য বার্নিং ট্রেন'। চলন্ত ট্রেনের ওপর দাঁড়িয়ে গাইছেন ঋষি আর পদ্মিনী- 'হোগা তুমসে পেয়ারা কৌন'। শাহরুখ খান যাকে বলে 'ফাল পাড়া'- তাই করছেন মালগাড়ির ট্রাকে- সঙ্গে সর্পিনী মালাইকা- রেহমানের অসামান্য সৃষ্টি সঙ্গীত- 'ছাইয়া ছাইয়া'। 'আর্থ'এ আইসক্রিমওয়ালা আমির খানের সেই কপাল থাবড়ে কান্না মনে পড়ছে, দাঙ্গা চলছে, এক ট্রেন বোঝাই ক্ষতবিক্ষত লাশ এসেছে, সেখানে আইসক্রিমওয়ালার বোনের লাশও পড়ে আছে।

ইফ ইউ মিস দ্য ট্রেন আয়াম অন
রেলগাড়ি-রেলযাত্রা নিয়ে ইংরেজি সিনেমা বিস্তর। ১৮৯৯ এর নির্বাক চলচ্চিত্রে দেখা যায় একটি বিবাহিত যুগলকে, ট্রেন টানেলে ঢুকবার বিরল অবসরে যারা একে অন্যকে চুমু খায়। ১৯৩৭ এর 'দ্য গ্রেট ব্যারিয়ার' কানাডিয়ান প্যাসিফিক রেলওয়ের রকি পর্বতমালার ভেতর দিয়ে চালু হবার গল্প। 'ব্রিফ এনকাউন্টার' রেলওয়ে ট্যাভার্ন আর ট্রেনযাত্রার পটভূমিতে তৈরি অসামান্য প্রেমলেখা। 'ডেথ অভ আ প্যাসেঞ্জার' এবং বার্ট ল্যাংকাস্টারের 'দ্য ট্রেন' (১৯৬৪) বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে তৈরি গল্প, দ্বিতীয়টি একটি সামান্য সাধারণ মানুষের দেশপ্রেম গর্জে উঠবার উপাখ্যান।
'ডক্টর জিভাগো'তে এগারোদিনের দীর্ঘ ট্রেনযাত্রার একটি চিত্র আছে, ট্রেন চলতে শুরু করলে উপদ্রুত এলাকার মায়েরা তাদের কোলের শিশুকে ঠেলে দিতে চাইছে ট্রেনের নিরাপত্তায়, পশুর মতো বোঝাই হয়ে রেলগাড়ি চলেছে উরিয়াতিনের দিকে। প্রতিদিন যাত্রীদের বিষ্ঠাময় খড় বাইরে ফেলে দেয় পুরুষরা, নারীরা আলুসেদ্ধ করে, 'বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক' চিৎকারের বিপরীতে ক্লান্ত-অতিষ্ট শ্রমদাস চেঁচিয়ে ওঠে- 'অরাজকতা দীর্ঘজীবী হোক!' মানুষের হৃদয়ে বদলে গেছে বিপ্লবের মানে! বিহ্বল জিভাগো ট্রেনের জানালার খিড়কিপথে দ্যাখে বিশাল রুশদেশ, যে মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ। আরেকটি ট্রেনযাত্রার দৃশ্য আছে এ মুভিতে, বরফঢাকা প্রান্তর চিরে, সাধারণ মানুষের ভিড় চিরে স্ট্রেলনিকভের ভয়ালদর্শন ট্রেন চলেছে, বিপ্লবী এখন জান্তা, সে আর স্বপ্নভরা তরুণ নয়, ক্ষমতাবিকৃত শাসক।
মনে করে দেখুন, 'শিন্ডলার্স লিস্ট'-এর মেয়েমানুষ বোঝাই ট্রেন সরাসরি এসে ঢুকছে আউশউইৎজ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে, ট্রেন যেন যমদূত। কে ভুলতে পারে 'দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কওয়াই'-এর রেলওয়ে ব্রিজ নির্মাতা যুদ্ধবন্দী অ্যালেক গিনেসকে! 'দ্য রেলওয়ে ম্যান'-এ কলিন ফার্থের অভিনয় দেখে অশ্রু সম্বরণ করা অসম্ভব, আপাতদৃষ্টিতে সে রেলওয়ে নিয়ে অত্যন্ত আগ্রহী- সাদামাটা জীবনযাপনকারী একটি মানুষ, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে শ্রান্ত-শোকাচ্ছন্ন এক যুদ্ধবন্দী, তার অন্তর নিরন্তর মুচড়ে চলেছে ভয়াবহ নির্যাতনের স্মৃতি। যুদ্ধ ফুরায়, যুদ্ধের স্মৃতি অফুরান।
হিচককের 'স্ট্রেনজারস অন আ ট্রেন'-এ রেলকামরার সুখদ আলাপ থেকে সমস্ত বিপদের শুরু, আর 'দ্য লেডি ভ্যানিশেস' এ ট্রেনে চড়ে অদৃশ্য হয়ে যায় এক ভদ্রমহিলা, 'শ্যাডো অভ আ ডাউট'-এ দুর্বৃত্ত মাতুল জোসেফ কটনের মৃত্যু হয় চলন্ত ট্রেনের সামনে পড়ে গিয়ে। বৃটিশ সোশ্যাল রিয়েলিস্ট কিচেন সিঙ্ক মুভিতে বারবার এসেছে ট্রেন আর রেললাইনের দৃশ্য, যেন ওটা কলকারখানার শহরের ক্ষুদ্রান্ত্রের স্বরূপ। ডিকেন্সের জীবনী নিয়ে রচিত সিনেমা 'দ্য ইনভিজিবল ওম্যান'-এর একটি দৃশ্য এখানে উল্লেখ করছি, ১৮৬৫এর স্টেপলহার্স্ট রেল দুর্ঘটনার পরপর রেলকামরায় আহত ডিকেন্স ব্যাকুল হয়ে তাঁর পান্ডুলিপির উড়ে যাওয়া পাতা খুঁজছেন, মর্মাহত প্রেমিকা দেখছেন- তাঁর কুশল-অন্বেষণে ডিকেন্স এতটুকু ব্যস্ত নন, যেন তিনি অদৃশ্যপ্রায়। কি স্বার্থপর মহান সাহিত্যিকের মন!
ফাইভ হান্ড্রেড মাইলস
রেলগাড়ি কত দূরবর্তীকে নিকট করে, কত সন্নিকটবর্তীকে নিয়ে যায় দ্বীপান্তরে, পরবাসে, মরণের মুখে। বন-পাহাড়-ফসলের মাঠ চিরে সে চলে যায় তীব্রগতি বিদ্যুৎ- বাঁধা সময়ে বাঁধা গন্তব্যে। তার ছন্দে একটা আছে-নেই ব্যাপার রয়েছে, একটা কান্নাহাসির দোলা। শিল্পসাহিত্য-সিনেমায় তাই বহুবার এসেছে রেলগাড়ির তাবত প্রসঙ্গ। 'রেলরোড ল্যামেন্টস' নামে কিছু লেখা লিখেছিলেন অকালপ্রয়াতা সাহিত্যিক প্রজ্ঞাদীপা হালদার। সেখান থেকে সামান্য উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করছি।
"আমাদের মফঃস্বল শহরটার উপর থেকে কোনো এক্সপ্রেস ট্রেন যায় না।এইটুকু লিখবার পর আমি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। কলম চলতে চায় না আর। সত্যিই তো কি বা লেখার আছে? কি আছে এই শহরে? দুধারে পুরনো বাড়ির দল, রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে।...শীতলাতলার বড় অশত্থ গাছটায় ছিটকে পড়ে সকালের রোদ। এবড়োখেবড়ো রাস্তায় ঘন্টি বাজিয়ে চলে যায় দুধ-ওয়ালা। মুদির দোকানে জটলা হয়। টাইমের কলে দাঁত মাজা, চান করা লোকেদের ভিড়। ঘোষালবাড়ির দরজার মাথায় গনেশের সামনে দুটো জবাফুল রাখা। রমণীবাবু গলা খাকড়িয়ে রকে বসে আনন্দবাজার পড়েন। নতুন কোন গল্প নেই, আছে শুধু বিষাদ যাপন, যেমনটি বিষণ্ণ আমাদের রেল-ইস্টিশন। রোজ রোজ নতুন কিছু ঘটে না বলে বোধহয় আমাদের স্টেশনটাও বড় সাদা-মাটা। মফঃস্বলী ধুলোটেপনা নিয়ে পড়ে আছে। একটা দুটো কদমগাছ, সিমেন্টের বাঁধানো বসার জায়গা, নোংরা থাবায় কান-চুলকানো নেড়ির ছানা, ধোঁয়া ওঠা চায়ের দোকান, ফুলওয়ালী মাসিরা। কি ভীষণ ঘরোয়া, কি ভীষণ মন খারাপ, যখন রোজ আমি এই ষ্টেশনটা ছেড়ে যাই আটটা বাইশের লোকালে। অনিবার্য কবিতা মনে পড়ে। সেকি জানিত না যত বড় রাজধানী, তত বিখ্যাত নয় এ হৃদয়পুর। আমাদের স্টেশনটার নাম হৃদয়পুর। এ আশ্চর্য নাম, সমস্ত ভালবাসা নিয়ে ছলকে ওঠে। তবু কোনো এক্সপ্রেস ট্রেন আমাদের ষ্টেশনটার উপর দিয়ে যায় না। ট্রেনগুলো জানতেই পারে না একগাদা মায়া নিয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় দূরপাল্লার গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করে আছে একটা আশ্চর্য স্টেশন।"
ভাবছি 'হৃদয়পুর' নামটার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে এমন রেলস্টেশন আমাদের আছে কি না, চড়াইকল, দিগরাজ, ময়নামতি, শশীদল, ধীরাশ্রম, ঘোড়াশাল, বসন্তপুর, রাজারহাট, ভোমরাদহ, তুষভান্ডার... আছে তো!