প্রসঙ্গ ঈদ: সরকারের "চোরেরে কও চুরি করো, গৃহস্থরে কও ধর ধর" সিস্টেম

এই যে ঈদে বাড়ি যাওয়ার জন্য ঢাকাবাসী মানুষজনের চরম আকুতি এবং হুলুস্থুল আয়োজন, এটা কিন্তু নতুন নয়। সেই ছোটবেলা থেকেই দেখছি ঈদের ৫/৬ দিন আগে থেকেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে মানুষ দেশের বাড়িতে ঈদ করবে বলে ছুটছে। রাস্তায় দীর্ঘ যানজট পেরিয়ে, পথে থেমে থেমে, ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে মানুষ ছুটেছে ট্রেনে, বাসে, নৌকায়, লঞ্চে, মোটর সাইকেলে, ভ্যানগাড়িতে, ট্রাকে। দুর্ঘটনার ঘটনাও ঘটেছে অনেক। কিন্তু মানুষকে থামানো যায়নি। যদিও গতবছর ও এ বছরে ঈদ উদযাপনের প্রেক্ষিত ভিন্ন। কিন্তু মানুষকে কি গ্রামে গিয়ে ঈদ পালন করা থেকে আমরা বিরত রাখতে পেরেছি নাকি পারছি?
সবচেয়ে সত্যি কথা হচ্ছে ঈদে এই বাড়ি যাওয়া, না যাওয়া নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে আলোচনা হচ্ছে, গণমাধ্যম ছবি দিয়ে, নিউজ করে সরকার ও দেশবাসীকে পরিস্থিতি জানিয়ে দিচ্ছে। এর ক্ষতিকারক দিক নিয়ে আলোচনা করছে। কিন্তু কাজের কাজ হয়েছে কি কিছু?
কারণ আমাদের মতো দেশগুলোতে সাধারণ মানুষকে জীবনের প্রচলিত নিয়মকানুন বা আয়োজনের বিরুদ্ধে কোনকিছু পালন করাতে চাইলে, এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে, যাতে মানুষ নিষেধ মানতে বাধ্য হয়। অন্যান্য সভ্য দেশের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। সেইসব দেশে আইন কঠোর বলেই মানুষ তা মেনে চলে। আমাদের সামনে উপায় ছিল দুইটা, হয় আইন কঠোর করতে হবে, নতুবা করোনা নিয়ে এমন জোরালো প্রচারনা চালাতে হবে, যেন মানুষ নিজের ইচ্ছায় সেই কাজ করতে না পারে।
আর ঈদের মতো পরব, যে পরবের সাথে মানুষের শিকড়ের টান জড়িত, সেই টানকে উপেক্ষা করানো কি এত সহজ? স্পষ্টভাবে বলতে চাইছি যে এই উদযাপন ঠেকানোর মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। সাধারণ মানুষের উপর এই দায় চড়িয়ে দিয়ে কোন লাভ নেই।
২৭ শে রমজান একটি জরুরি কাজে আমাকে ময়মনসিংহ যেতে হয়েছিল। কাজটা ছিল ১ ঘন্টার কিন্তু পথে থাকতে হলো ১১ ঘন্টা। সেহেরির ঠিক পরপর রওনা দেয়ার পরও রাস্তা খালি ছিল না। কারণ রাস্তাজুড়ে মানুষ। গাড়ি, ছোট ট্রাক, হিউম্যান হলার, স্কুটার, ভ্যানগাড়িতে চড়ে মানুষ ছুটছে বাড়ির দিকে। কোন বাহনে এক ইঞ্চি জায়গাও খালি ছিল না।
এরমধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ মনে হয়েছে মটর সাইকেলে করে বাড়ি ফেরার দৃশ্যটি। আমি যাত্রাপথে অসংখ্য মটর সাইকেল দেখলাম. যারা পরিবার পরিজন নিয়ে, এমনকী বাচ্চা নিয়ে, পেছনে ভাই-বন্ধু নিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছেন। আমরা বোধকরি ভুলে গেছি ২০২০ এর করোনাকালে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে এই মোটর সাইকেলেই।
স্বাভাবিক সময়ে ঈদকে সামনে রেখে যে কোন উপায়ে বাড়ি যাওয়ার ইতিহাস আমাদের আছে। ট্রেনের ছাদে দাঁড়িয়ে বা ঝুলে, বাসে দাঁড়িয়ে, লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে গাদাগাদি করে ঈদে আমরা বাড়ি যাই। এইভাবে বাড়ি যেতে গিয়ে মানুষ পথে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে, প্রাণ হারিয়েছে। এবারের এই ভিন্ন পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র বাস, ট্রেন আর লঞ্চ বন্ধ করে সরকার মনে করেছে যে তারা দায়িত্ব পালন করেছে। সরকার সব জেনে শুনে এই জনস্রোত ঠেকানোর মতো কোন ব্যবস্থা নেয়নি কেন?
ঢাকায় যারা দিনমজুর, পোষাক শ্রমিক, কল-কারখানায় কাজ করেন, দোকানে কর্মরত শ্রমিক, ছুটা গৃহকর্মী তাদের কিন্তু ঢাকায় থাকার মতো কোন আশ্রয় নেই। বছরের অনেকটা সময় তারা শুধু জীবিকার জন্য ঢাকায় অবাঞ্চিত অবস্থায় পড়ে থাকেন। কষ্ট করে আয় করেন, গ্রামে গিয়ে আনন্দ করে, সবাইকে নিয়ে ঈদ করবেন বলে। এদের জীবনের একমাত্র বড় আনন্দ পরিবার বা বাবা মায়ের সাথে ঈদ করা। আমরা যারা ঢাকাতে থাকি, চাকরি-বাকরি করে স্থায়ী আবাস গড়ে তুলেছি, তারা ঠিক এইসময়, এইভাবে ঈদে বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করছিনা। কিন্তু একটা বড় অংশ যে যেভাবে পারে গ্রামে যেতে চাইছে।
পাশাপাশি এটাও তো সত্যি আমরা করোনা মহামারির ভয়াল দিকটি তুলে ধরে জনগণকে সেইভাবে সচেতন করতে ব্যর্থ হয়েছি। কেন মানুষ ঢাকা ছেড়ে বাড়ি যাবে না, গেলে কী ঘটতে পারে, এই দিকটি কি আমরা পেরেছি জনগণকে সঠিকভাবে জানান দিতে? পারিনি। ভারতে কত লোক মারা যাচ্ছে, কোন দেশের কী ভ্যারিয়েন্ট এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছে, এসব বোঝার দায়িত্ব সাধারণ মানুষের না। সরকার করোনার এই ভয়াবহ দিকটি তুলে ধরে, মানুষকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে।
সাংবাদিকতা বিভাগে আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সাখাওয়াৎ আলী খান স্যার বলেছিলেন এমনভাবে ফিচারের ইন্ট্রো লিখতে হবে, যেন পাঠক বিস্মিত হয়ে বলে উঠে "ওরে বাবা তাই নাকি? ঘটনাটা এইরকম? জানতাম নাতো।" এরপর সে সেই খবরটি পড়বে। এক্ষেত্রেও ঠিক তাই। আমরা মানুষকে করোনার ভয়াবহতা নিয়ে এমনকিছু জানাতে পারিনি, যাতে মানুষ বলে উঠবে " ওরে বাবা তাই নাকি !! তাহলে এবার আর ঈদে দেশেই গেলাম না।"
মানুষ দেখছে দোকানপাট খোলা, হোটেল-রেস্তোরাঁ খোলা, কিছু অফিস-আদালত খোলা, গণপরিবহন খোলা, প্লেন ও পারসোনাল বা ভাড়া গাড়ি খোলা তাহলে তাদের গ্রামে যাওয়া বন্ধ কেন? ঢাকায় যদি লোক হুড়োহুড়ি, চাপাচাপি করে কেনাকাটা করতে পারে, বড়লোকেরা যদি ইফতারির আয়োজন করতে পারে তাহলে বাড়ি গিয়ে ঈদ নয় কেন?
আমরা পুরো জিনিসটাকে ঘোট পাকিয়ে ফেলেছি। বাড়ি গিয়ে ঈদ করলে কতটা অসুবিধা হতে পারে, তা আমরা ঠিকমতো বুঝাতে পারিনি মানুষকে। আর করোনায় গরীব মরেনা, এই কথারও কোন ভাল ব্যাখ্যা আমরা দিতে পারিনি। কাজেই গ্রাম অভিমুখী এই মানবস্রোত ঠেকানো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
ফেরিতে গাদাগাদি করে মানুষের অবস্থান দেখে আমরা হাসাহাসি করছি, বিরক্ত হচ্ছি। সরকার কি জানতো না যে ফেরিগুলো খোলা থাকলে মানুষ যেভাবে পারবে, সেভাবেই নদী পার হবে। নাকি ফেরি পারাপারের ছবি দেখে তাদের জ্ঞান চক্ষুর উন্মেষ ঘটেছে? সাথে সাথেই প্রজ্ঞাপণ দিয়ে ফেরি বন্ধ করেছে। কিন্তু ততোক্ষণে মানুষ ফেরি ঘাটে পৌঁছে গেছে এবং কর্তৃপক্ষের সাথে হইচই শুরু করে পুনরায় ফেরি চালু করেছে। সাধারণ মানুষ যে বাহনগুলোতে চড়েন যেমন বাস, ট্রেন ও লঞ্চ সেগুলো সব বন্ধ করে দিয়ে ঘরমুখো মানুষ কে কি আমরা আরো অসহায় করে তুলিনি?
এর চাইতে ভাল ছিল এমন নিয়ম বেঁধে দেয়া, যেন কোন একজন ব্যক্তিও গ্রামে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করতে না পারেন। প্লেন, প্রাইভেট কার, মটর সাইকেল কিছুই চলবেনা। এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ ছিল, যাতে মানুষতো দূরের কথা, একটা মশাও ঈদ করতে বাড়ি যেতে না পারে। সব পথ সীলগালা করে দেয়া উচিৎ ছিল। প্রয়োজনে আর্মি, বিজিবি, পুলিশ নামিয়ে মানুষকে ঢাকাতেই আটকে ফেলতে হতো।
অথবা মেনে চলতে হতো করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শ কমিটির সুপারিশ। তারা বলেছিলেন অর্ধেক আসনে যাত্রী বহন নিশ্চিত করে বাস, ট্রেন ও লঞ্চ চলাচল খুলে দিতে।
তা না করে আমরা জেলা ও মহানগরীর মধ্যে বাস চলাচল খুলে দিলাম। আর তাই এই করোনাকালের সব ধরণের বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে মানুষ চলেছে। সরকার "চোরেরে কও চুরি করো, আর গৃহস্থরে কও ধর ধর" নীতিতে পড়ে যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এর ফলেই এই ভয়াবহ ভিড় আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। ঈদে যেন-তেন উপায়ে বাড়ি ফেরার পথে বহু দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে অতীতে। এবার লঞ্চ বন্ধ করে দিলো বলে স্পীড বোটে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা পড়লো ২৬ জন যাত্রী।
আমরা জানি ঈদ মানে আনন্দ, উৎসব ও আয়োজন। তবে দুই বছর ঠিক বিপরীত একটি ঈদ উদযাপন করছি আমরা। অদ্ভুত এক অন্ধকারে ঢেকে গেছে আমাদের চাওয়া পাওয়া সবকিছু। চারিদিকে মৃত্যু, ক্ষুধা আর হাহাকারের মিছিল। নিদানকালের এই ঈদে মানুষের বিশেষ করে ঢাকার সামান্য আয়ের মানুষের একমাত্র আনন্দ হচ্ছে গ্রামে তার পরিবার পরিজনের সান্নিধ্যে গিয়ে ঈদ করা। এই প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে আমাদের যা করা উচিৎ ছিল আমরা কী করতে পেরেছি? পারিনি। শুধু শুধু সাধারণ মানুষের উপর দোষ চাপিয়ে নিজেরা দায়িত্ব পালনের স্বাদ গ্রহণ করছি।
- লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন