এলডিসি থেকে মধ্যম আয়ের দেশ: ঔষধ শিল্পে আগামীর বাংলাদেশ

সম্প্রতি ঔষধ, গার্মেন্টস, লেদার, সফটওয়্যার সহ রপ্তানিমুখী বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা ট্রিপস পরবর্তী বিভিন্ন শিল্পখাত ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। ট্রিপস চুক্তির অনুবলে ঔষধ, জুট, সফটওয়্যারসহ আর্ন্তজাতিক পরিমণ্ডলে মেধাস্বত্বের বিষয়ে পণ্যের উৎপাদন ও বিপণনে কপিরাইট, পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক, জিআই সুরক্ষাসহ নানান বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়ে থাকে। ট্রিপস চুক্তি অনুযায়ী কোন প্রতিষ্ঠান নতুন ঔষধ আবিষ্কার করে বাজারজাত করলে সেই ঔষধটি পেটেন্ট প্রাপ্ত হয়। পেটেন্ট প্রাপ্ত ঔষধটির কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানকে সরকার তার দেশে বাধ্যতামূলক ভাবে ২০ বছরের জন্য একচেটিয়া ব্যবসা করার সুযোগ প্রদান করে থাকে। বিশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বে পেটেন্ট প্রাপ্ত ঔষধ অন্য কোন ফার্মাসিউটিক্যাল্স কোম্পানি প্রস্তুত ও বাজারজাত করতে পারে না। উক্ত সময় অতিবাহিত হওয়ার পর যেকোনো কোম্পানি জেনেরিক নামে ঔষধটি উৎপাদন ও বিপণন করার অধিকার প্রাপ্ত হয়। জেনেরিক নামে ঔষধটি উৎপাদন ও বাজারজাত করা গেলে ঔষধের দাম বহুলাংশে কমে যায়। ফলশ্রুতিতে অন্য দেশের কোম্পানি সমূহ ঔষধটি কম খরচে উৎপাদন ও বাজারজাত করতে পারে এবং সাধারণ মানুষ সস্তায় ঔষধ কিনে জীবন বাঁচাতে পারে। ১৯৯৫ সালে ট্রিপস চুক্তি কার্যকর হলে ও দোহা সম্মেলনে ঊনপঞ্চাশটি স্বল্পোন্নত এলডিসি ভুক্ত দেশকে ২০১৬ পর্যন্ত পেটেন্ট ছাড় দিয়ে ঔষধ উৎপাদন ও বাজারজাত করার সুযোগ প্রদান করা হয়। যা পরবর্তীতে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়।
২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ এলডিসি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছে। ফলে ট্রিপস ওয়েভারের আওতায় বাংলাদেশের ঔষধ কোম্পানি সমূহ বিদেশি কোম্পানির পেটেন্টকৃত জেনেরিক ঔষধ সমূহ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের বিদ্যমান সুযোগ হারাতে পারে। ফলে ঔষধের মূল্য বৃদ্ধিসহ ঔষধ রপ্তানিতে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। ট্রিপস পরবর্তী ঝুঁকি এড়াতে ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রায় এক হাজার নতুন ঔষধ নিবন্ধনের জন্য ড্রাগ কন্ট্রোল কমিটির (ডিসিসি) অনুমোদনের জন্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে আবেদন করে।
বিগত ৫ই আগস্ট ২০২৪ দেশের পট পরিবর্তনের কারণে ডিসিসির সভা বেশ কিছুদিন যাবৎ অনুষ্ঠিত হয়নি। গত ৪ই আগস্ট ২০২৫ সচিব, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সভাপতি এবং মহাপরিচালক ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে সদস্য সচিব করে ২২ সদস্য বিশিষ্ট ঔষধ নিয়ন্ত্রণ কমিটি পুনঃগঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। কমিটির কার্যপরিধি অনুযায়ী ডিসিসি ঔষধের নিরাপত্তা, কার্যকারিতা ও ব্যবহার উপযোগিতা নিরূপণ করে লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের নিকট নিবন্ধন প্রদান অথবা নিবন্ধন বাতিলের সুপারিশ করবে। উক্ত প্রজ্ঞাপনে ডিসিসির সকল সদস্যকে দায়িত্ব গ্রহণের সম্মতি প্রদানের সময়ই সভাপতি বরাবর নির্ধারিত ফরমে কমিটির কার্য পরিধির সাথে সংশ্লিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির সাথে তার কোন ধরনের স্বার্থ জড়িত নয় মর্মে একটি ঘোষণা প্রদান করতে হবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৩১০ টি অ্যালোপ্যাথিক ঔষধ প্রস্তুতকারী কোম্পানির মধ্যে একমাত্র এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি (ইডিসিএল) ছাড়া বাকী সব বেসরকারি খাতের ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। ঔষধ শিল্পে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের অবদান আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি। একথা অনস্বীকার্য যে, ব্যক্তি মালিকানাধীন ফার্মাসিউটিক্যাল্স কোম্পানি সমূহ ঝুঁকি নিয়ে এখাতে বিনিয়োগ করেছেন বিধায় স্বাধীনতার পর প্রায় পুরোপুরি আমদানি নির্ভর ঔষধ খাত আজ রপ্তানিমুখী একটি সম্ভাবনাময় শিল্প খাতে পরিণত হয়েছে। দেশের চাহিদার ৯৮ ভাগ মিটিয়ে বিশ্বের ১৬০ টি দেশে বাংলাদেশের ঔষধ রপ্তানি হচ্ছে। কেমিষ্ট, ফার্মাসিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিষ্ট, সহ প্রায় ২ লক্ষাধিক উচ্চ শিক্ষিত লোক এই শিল্পে বর্তমানে কর্মরত রয়েছে। ঔষধ নিয়ন্ত্রণ কমিটিতে ঔষধ শিল্প সমিতির কোন প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত না করায় তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তবে এদেশের বাস্তবতার নিরিখে এবং অভিজ্ঞতার আলোকে একথা বলা যায় যে, একজন প্রভাবশালী সংসদ সদস্য অথবা সরকার দলীয় ক্ষমতাধর মন্ত্রী যখন তার মালিকানাধীন ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির পক্ষে ডিসিসি/মূল্য নির্ধারণ কমিটির সভায় অংশ গ্রহণ করে থাকেন তখন কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বা স্বার্থের সংঘাত হতেই পারে এবং জনস্বাস্থ্য বিঘ্নিত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভবনা থাকে। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২২ সালে প্রকাশিত গাইড লাইনে স্বল্পোন্নত দেশ সমূহে স্বার্থের সংঘাত এড়িয়ে চলার নীতি অবলম্বন করার নির্দেশনা প্রদান করেছে। তবে স্বার্থের সংঘাতের কারণে প্রতিনিধি না রাখা হলেও ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি সমূহ তাদের স্বার্থের পরিপন্থি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংক্ষুদ্ধ হলে আপিলের বিধান ঔষধ ও কসমেটিক্স আইন ২০২৩ এ রয়েছে।
এতদিন পর্যন্ত পেটেন্ট ছাড়ের সুবিধা নিয়ে কোম্পানি সমূহ জেনেরিক ঔষধের কপি ভার্সন তৈরি করে আসলেও অদূর ভবিষ্যতে বহুজাতিক জায়ান্ট কোম্পানি সমূহের আনুকূল্য নিয়ে বিশ্ব বাজারে টিকে থাকা সম্ভব হবে না। তাই ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোকে কাঁচামাল আমদানির পরিবর্তে প্রসেস ডেভেলপসহ জেনেরিক- বায়োলজিক্যাল ঔষধ উদ্ভাবনে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালসহ গবেষণায় মনোনিবেশ করতে হবে। এজন্য দক্ষ জনবল, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে নিত্য নতুন ঔষধ আবিষ্কারে গবেষণা ও উদ্ভাবনে কোম্পানি সমূহকে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
ইতিমধ্যে দেশীয় কোম্পানিসমূহ প্রয়োজনীয় ঔষধ উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জন করলেও রিসার্চ এবং ডেভেলপমেন্টের ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি নেই। তাই এলডিসি থেকে উত্তরণ ছয় বছর পিছিয়ে দেওয়ার একটি মহলের প্রস্তাব মেনে নিলেই যে তারা এ ক্ষেত্রে প্রচুর উন্নতি করে ফেলবে তা বাস্তব সম্মত নয়। ট্রিপস এর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার ২০০৭ সালে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় ২৭ কোম্পানিকে ৪২টি অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই) প্লান্ট বরাদ্দ দেয়। দীর্ঘ ২২ বছর অতিক্রান্ত হলেও মাত্র ৪টি প্রতিষ্ঠান এপিআই উৎপাদন শুরু করেছে। বাকী প্রতিষ্ঠান সমূহকে অনতিবিলম্বে এপিআই উৎপাদন শুরুর করার নির্দেশনাসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে।
১৯৮২ পরবর্তী সময়ে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে যেভাবে ঔষধ শিল্পে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল অনুরূপভাবে ট্রিপস পরবর্তী চ্যালেঞ্জ সমূহ মোকাবেলা করে সরকার-প্রাইভেট সেক্টর মিলে এপিআইসহ রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে নিত্য নতুন জেনেরিক-বায়োলজিক্যাল ঔষধ উদ্ভাবনের মাধ্যমে আগামীতে ও ঔষধ শিল্প এগিয়ে যাবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
লেখক: সাবেক উপ-পরিচালক ও আইন কর্মকর্তা, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, ঢাকা।