হলিউডের অভিনেতারা কেন ধর্মঘটে?
 
হলিউডের প্রধান স্টুডিওগুলোর সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রির চলচ্চিত্র ও টিভি চিত্রনাট্যকার এবং অভিনেতাদের আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার পর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ধর্মঘটের মুখে পড়ে অচল হয়ে গেছে হলিউড। বিগত ৬৩ বছরের মধ্যে এই প্রথম হলিউডের অভিনেতা ও চিত্রনাট্যকাররা একযোগে ধর্মঘট পালন করছেন, যার ফলে এই মুহূর্তে প্রচুর প্রোডাকশনের কাজ বন্ধ রয়েছে ইন্ডাস্ট্রিতে। পারিশ্রমিক, বেতন-ভাতা সংক্রান্ত আরও ভালো চুক্তি পাওয়ার দাবি তুলে এ ধর্মঘটে নেমেছেন তারা। খবর বিবিসির।
অভিনেতা ও চিত্রনাট্যকাররা বলছেন, হলিউডের বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের ক্যারিয়ারের ভবিষ্যত হুমকির মুখে রয়েছে। কিন্তু স্টুডিওগুলোর নির্বাহী কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের দাবি যৌক্তিক নয়, ফলে সব মিলিয়ে টিনসেলটাউনে এক অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।
কিন্তু কেন হঠাৎ এত বড় ধর্মঘটের মুখে হলিউড?
কারা যুক্ত ছিলেন আলোচনায়?
মূলত তিনটি পক্ষ এ নেগোসিয়েশনে জড়িত ছিলেন। প্রথমত, স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড অ্যান্ড দ্য আমেরিকান ফেডারেশন অব টেলিভিশন অ্যান্ড রেডিও আর্টিস্ট (এসএজি-এএফটিআরএ); এ ইউনিয়নটির সদস্য সংখ্যা ১ লাখ ৬০ হাজার। এদের মধ্যে রয়েছেন অভিনেতা, স্টান্ট-কোঅর্ডিনেটর, ভয়েসওভার শিল্পী এবং ব্যাকগ্রাউন্ড অভিনেতারা।
দ্বিতীয়ত, চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, রেডিও এবং অনলাইনের লেখকদের প্রতিনিধিত্ব করে রাইটারস গিল্ড অব আমেরিকা (ডব্লিউজিএ)। তারাও যুক্ত ছিলেন এই আলোচনায়।
আর তৃতীয়ত, অ্যালায়েন্স অব মোশন পিকচার অ্যান্ড টেলিভিশন প্রোডিউসারস (এএমপিটিপি), যারা ডিজনি ও প্যারামাউন্টের মতো প্রধান ফিল্ম স্টুডিও, ফক্স ও এনবিসির মতো আমেরিকান টিভি নেটওয়ার্কগুলো এবং নেটফ্লিক্স ও আমাজনের মতো স্ট্রিমিং জায়ান্টদের প্রতিনিধিত্ব করে।
এই তিন পক্ষের মধ্যে আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ার কিছু কারণ রয়েছে। চলুন দেখে নেওয়া যাক কারণগুলো কি কি।
'শো মি দ্য মানি'
স্ট্রিমিং সার্ভিসের আবির্ভাব বিশ্ববাসীর টিভি ও সিনেমা দেখার ধরনকে যেমন পাল্টে দিয়েছে, তেমনই পরিবর্তন এসেছে অভিনেতাদের পারিশ্রমিক দেওয়ার ধরনেও।
সাধারণত অভিনেতা ও লেখকদের অগ্রিম টাকা দিয়ে দেওয়া হয়; কিন্তু তাদের আয়ের অনেকটাই আবার নির্ভর করে 'রেজিডুয়াল চেক' বা টিভি শো এবং সিনেমাগুলো রি-রান বা পুনরায় প্রদর্শনের ভিত্তিতে তাদেরকে দেওয়া রয়্যালটির উপরে।
বিজ্ঞাপন দেওয়া যায় এমন নেটওয়ার্কে যখন শো চালানো হয়, তখন রেজিডুয়াল চেকই প্রবীণ অভিনেতাদের টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে… এদের মধ্যে এসএজি'র প্রেসিডেন্ট ফ্র্যান ড্রেশারের মতো ব্যক্তিরাও আছেন।
কিন্তু স্ট্রিমিং পরিষেবা সেই ধরনটিকে পাল্টে দিয়েছে। অভিনেতা এবং লেখকরা বলছেন, স্ট্রিমিংয়ের যুগে তাদের রেজিডুয়াল কমে গিয়েছে এবং এটি তাদের জীবন-জীবিকাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
 
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে হলিউডে অভিনয় করছেন মাইকেল প্যাট্রিক লেন। কিন্তু তিনি বিবিসি নিউজকে বলেন, টেলিভিশনে পাচটি এপিসোডের জন্য রেজিডুয়াল হিসেবে তিনি পান মাত্র ৩০০ ডলার (২২৯ পাউন্ড)। অ্যাক্টিং ক্লাস, এজেন্ট ও ম্যানেজারদের বেতন দেওয়ার পর বছরে তার আয় থাকে ২০,০০০ ডলার।
"যদিও আমি নিয়মিতই অভিনয় করি, কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে আমি ঠিকমতো সংসার চালাতে পারছি না", বলেন মাইকেল। এর ফলে তাদের সন্তান নিতেও দেরি হচ্ছে বলে জানান এই অভিনেতা।
অভিনেতাদের ইউনিয়ন এসএজি-এএফটিআরএ বলছে, তাদের সদস্যরা সিনেমা ও টেলিভিশন থেকে প্রাপ্ত লাভ ন্যয়সঙ্গতভাবে বণ্টনের জন্য আন্দোলন করছে। কিন্তু এএমপিটিপি'র ভাষ্যমতে, "তারা গত ৩৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হারে 'মিনিমাম পে লেভেল' বা সর্বনিম্ন পারিশ্রমিক হার বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছিলেন", কিন্তু এসএজি-এএফটিআরএ-এর পক্ষ থেকে যারা নেগোসিয়েশন করছেন তারা সেই প্রস্তাব এড়িয়ে ধর্মঘটে গিয়েছেন।
হলিউডের প্রধান প্রধান স্টুডিওগুলোর কর্তাব্যক্তিরা বলেন, "এএমপিটিপি পারিশ্রমিক এবং রেজিডুয়াল বাড়ানোর জন্য এমন এক প্রস্তাব দিয়েছিল যা আগে কখনো হয়নি। কিন্তু আফসোস এই যে, ইউনিয়ন সেটা বাদ দিয়ে এমন এক পথ বেছে নিয়েছে যা এই ইন্ডাস্ট্রির ওপর নির্ভরশীল হাজারো লোকের অর্থনৈতিক সংকটে পড়ার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।"
উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার দাবি
মায়া গিলবার্ট-ডানবার এসএসজি এবং রাইটারস গিল্ড, উভয়েরই সদস্য এবং বর্তমানে তিনি এসএজি'র সভাপতি হওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মায়া বলেন, এসএসজি'র খুব কম সদস্যই রয়েছেন যারা ন্যূনতম পারিশ্রমিকের বেশি আয় করতে পারেন।
"আমাদের সদস্যদের মধ্যে বেশিরভাগই হলেন ব্যাকগ্রাউন্ড অভিনেতা, যাদের দৈনিক আয় মাত্র ১৫০ ডলারের মতো।"
অনেক অভিনেতার কাছে এসএজি-এএফটিআরএ'তে যোগদান করাই হলো হেলথ ইনস্যুরেন্স পাবার একমাত্র উপায়। কিন্তু মায়া ডানবার বলেন, ইউনিয়নের ১ লাখ ৬০ হাজার সদস্যের মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ সদস্য বার্ষিক ২৬,০০০ ডলার আয় করেন- হেলথকেয়ার কাভারেজ পাওয়ার জন্য এই পরিমাণ আয় করা আবশ্যক। কিন্তু মায়া আরও জানান, প্রবীণ অভিনেতাদের বয়স ৬৫ বছর হলেই তাদেরকে ইনস্যুরেন্স পরিকল্পনার বাইরে ফেলে দেওয়া হয়।
এএমপিটিপি বলছে, তারা পেনশন, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি খাতে উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি
ইতোপূর্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহারের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করলেও, কেউই হয়তো ভাবতে পারেনি যে এর কারণে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় ধর্মঘটের মুখোমুখি হবে হলিউড।
এএমপিটিপি বলেছে, তারা 'এসএজি'কে এমন একটি প্রস্তাব দিয়েছিল যা পারফর্মারদের ডিজিটাল সাদৃশ্য থেকে বাচিয়ে রাখবে এবং সেইসঙ্গে যেকোনো ডিজিটাল রেপ্লিকা তৈরি ও ব্যবহার কিংবা কোনো পারফরম্যান্সকে ডিজিটালি ভিন্নভাবে উপস্থাপনের আগে পারফর্মারদের সম্মতি নেওয়া হবে।'
কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে ধর্মঘটে যাওয়ার কথা জানানোর সময় এসএজি'র চিফ নেগোশিয়েটর ডানকান ক্র্যাবট্রি-আয়ারল্যান্ড ব্যাখ্যা করেন যে কেন তারা এই আইডিয়াকে প্রত্যাখান করেছেন।
তিনি বলেন, "তারা প্রস্তাব দিয়েছিল যে আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ড পারফর্মারদের স্ক্যান করার সুযোগ থাকতে হবে, একদিনের মজুরি পাবে এবং সেই স্ক্যানের মালিক হবে কোম্পানি এবং তাদের সেই ইমেজ ও সাদৃশ্য বাকি জীবন যেকোনো প্রজেক্টে বিনামূল্যে ব্যবহার করবে কোম্পানি। তাই এটাকে যুগান্তকারী প্রস্তাব বলার আগে আপনার দ্বিতীয়বার ভাবা উচিত।"
কতদিন চলবে এ ধর্মঘট?
আপাতত অভিনেতা ও লেখকেরা, উভয়েই বেশ আটঘাঁট বেঁধে প্রতিবাদে নেমেছেন বলে মনে হচ্ছে। প্রায়ই ধর্মঘটের মানে এই দাঁড়ায় যে, কোনো পক্ষই আপস করতে রাজি নয়, তাই দুটি ইউনিয়নকে আবারও আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনতে অনেকটা সময়ই লেগে যাবে। শেষবার যখন লেখক-অভিনেতারা ধর্মঘটে গিয়েছিলেন তখন তা ১০ সপ্তাহ স্থায়ী হয়েছিল এবং সেসময় এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অভিনেতা রোনাল্ড রিগ্যান।
লেখকদের ধর্মঘট ইতোমধ্যেই তৃতীয় মাসে পা রেখেছে এবং অভিনেতারা এতে যোগ দিয়েছেন।
এদিকে ধর্মঘট যতদিন চলবে, ততদিন হলিউড তারকাদের বিভিন্ন সিনেমার প্রিমিয়ারে, উৎসবে বা রেড কার্পেটে দেখার আশা ছেড়ে দিতে হচ্ছে দর্শকদের। ইউনিয়নের নিয়মকানুনেই নিষেধ করা হয়েছে অভিনেতাদের নতুন কাজ নিতে বা কোনো প্রজেক্টের প্রচারণায় যেতে।
ডানবার বলেন, "দুর্ভাগ্যবশত, ধর্মঘট আসলে সবকিছু শেষ নয়, বরং এটাই শুরু।" তবে তার প্রত্যাশা, একপর্যায়ে উভয় পক্ষই একটা উপযুক্ত চুক্তিতে আসতে পারবে।
"আমরা ধর্মঘটে যাচ্ছি, লোকজন কাজ করতে পারবে না, কিন্তু আপনাকে এমন একটা চুক্তি করতে হবে যাতে এই ধর্মঘট করাটা যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। আর আমি আশা করছি যে এটাই হবে", বলেন ডানবার।

 
             
 
 
 
 
