বিভীষিকার রাত

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারি এলাকার কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অন্তত ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতাল ও সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ২০০ জনেরও বেশি শ্রমিক।পোড়া মানুষের বোবা কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে হাসপাতালের পরিবেশ। স্বজনদের আহাজারিতে কাঁপছে চারপাশ।
দগ্ধ ও আহতদের মধ্যে ২ জন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন। আর ৪ জনকে হাসপাতালে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের সহকারী পরিচালক রাজীব পালিত। অন্যজন মারা গেছেন বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালে।
এদের মধ্যে একজনের পরিচয় জানা গেছে। মমিনুল হক (২২) নামের এই হতভাগ্য যুবক বিএম ডিপো নামের ওই কন্টেইনার ডিপোতে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে ওই ডিপোতে। সব মিলিয়ে প্রায় দুই শতাধিক ব্যক্তি দগ্ধ ও আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
ঘটনার পর থেকে একের পর এক আহতদের নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স আসছে চমেক হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে। এদের কারও মুখমন্ডল পুড়ে গেছে, আমার কারও পুরো শরীর। একেকটা অ্যাম্বুলেন্স আসার সঙ্গে সঙ্গেই স্বেচ্ছাসেবকরা দ্রুত আহতদের বার্ন ইউনিটে নিয়ে যাচ্ছেন। রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় রোগীদের লম্বা লাইনে রেখেই ড্রেসিং-ব্যান্ডেজ করছেন চিকিৎসকরা। দগ্ধদের চিকিৎসায় হাসপাতালের সব চিকিৎসককে জরুরীভাবে হাসপাতালে আসার নির্দেশ দিয়েছেন বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার।
ভোর সাড়ে পাঁচটায় চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "পাঁচজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হয়েছি। আরও দুটি লাশ ইমার্জেন্সিতে এসেছে বলে খবর পেয়েছি। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯০ জনের বেশি ভর্তি আছেন। গুরুতর দগ্ধ ৩ জনকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালে ৪০ জনকে ভর্তি করা হয়েছে।"
অধিকাংশ রোগী আশঙ্কাজনক
চমেক বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের প্রধান রফিক উদ্দিন আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "হাসপাতালের বার্ন ইউনিট ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি হওয়া ৫০ শতাংশ রোগীই আশঙ্কাজনক। স্থান সংকুলান না হওয়ায় বেশ কয়েকজন রোগীকে অন্যান্য ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে।"
বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের রেজিস্টার ডা. লিটন পালিত টিবিএসকে বলেন, "প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি হওয়া রোগীদের ১৭ জনের শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। এসব রোগীর যে কোনো সময় যে কোনো কিছু ঘটে যেতে পারে।"
সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, "যাদের শ্বাসনালী পুড়ে গেছে তাদের জন্য সামনে আইসিইউ প্রয়োজন হবে। কারণ সকাল হতেই পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। এজন্য বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালকে আইসিইউ রেডি রাখার জন্য বলা হয়েছে। অন্যদিকে, বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালে ১৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের কারও হাত নেই, আবার কারও পা নেই। একজনকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। অন্যদের অভিভাবকদের যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।"
রক্তের জন্য হাহাকার
বিস্ফোরণে আহত শ্রমিকদের জন্য জরুরীভাবে রক্তের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছে, পজিটিভ গ্রুপের রক্ত নিয়ে তেমন সংকট এখন পর্যন্ত হয়নি। অনেক রক্তদাতা পাওয়া গেছে যারা মেডিকেলে গিয়ে ও ব্লাড ব্যাংকে রক্ত দিয়েছেন। তবে নেগেটিভ গ্রুপের রক্তের সংকট রয়েছে।
এদিকে, এ সংকটে এগিয়ে এসেছেন স্থানীয় যুবক এবং বিভিন্ন রক্তদাতা সংগঠনের সদস্যরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও রক্তদানের আহ্বান জানাচ্ছেন অনেকে। হাসপাতালের সামনে ব্লাড ব্যাংক কাজ শুরু করলে সেখানে রক্ত দেওয়ার জন্য হুড়োহুড়িও দেখা যায়। তবে সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ রোগীদের রক্ত দিতে গিয়ে চিকিৎসা কাজে বাধা সৃষ্টি না করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
বিস্ফোরণে পুলিশ সদস্যের পা বিচ্ছিন্ন, আহত ৯ ফায়ার কর্মী
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে এক পুলিশ সদস্যের পায়ের গোড়ালি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এছাড়া ৯ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৭ জন শিল্প পুলিশ এবং ২ জন সীতাকুণ্ড থানার। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কুমিরা স্টেশনেরও ৯ কর্মী আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর।
ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক শাহজাহান শিকদার টিবিএসকে বলেন, "কন্টেইনার ডিপোতে রাসায়নিক পদার্থ থেকে আগুন লেগেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। আগুন নেভাতে গিয়ে আমাদের ৯ কর্মী আহত হয়েছেন। তাদের উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।"
চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার এস এম রাশিদুল হক বলেন, "বিস্ফোরণে সীতাকুণ্ড পুলিশের কনস্টেবল তুহিনের পায়ের গোড়ালি বিচ্ছিন হয়ে গেছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া আরও ৮ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।"
আগুন এখনও জ্বলছে
টানা ৮ ঘণ্টার ওপর জ্বলতে থাকা আগুন এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। মূলত পানি সংকটে সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারিতে কনটেইনার ডিপোর আগুন নেভাতে বেগ পেতে হচ্ছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের। এসময় ডিপোর ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটতে থাকায় একপর্যায়ে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা নিরাপদ জায়গায় সরে যেতে বাধ্য হন।
ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক আনিসুর রহমান বলেন, "আগুন নিয়ন্ত্রণে চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের বিভিন্ন স্টেশনের ২৪টি ইউনিট কাজ করছে। ভোর সোয়া ৪টার দিকে গাড়ির পানি শেষ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ আগে ফেনী ফায়ার সার্ভিসের ৩টি ইউনিট এসে কাজ শুরু করেছে।"