অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে সচিবালয়ের কাঠামোতে বড় পরিবর্তন আনা হচ্ছে

গত বছরের বড় অগ্নিকাণ্ডের পর এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ের কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।
এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে শীঘ্রই সচিবালয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের গাড়ি প্রবেশের উপযুক্ত গেট তৈরি করা হবে। পাশাপাশি অগ্নিনির্বাপণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী বিভিন্ন ভবনকে সংযুক্তকারী কানেকটিং ব্রিজগুলো অপসারণ করা হবে। যেসব কক্ষে সাধারণ ইনটেরিয়র ডেকোরেশন রয়েছে, সেগুলো পরিবর্তন করে ক্লাস এ ফায়ার রেটেড ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে ইনটেয়ির করা হবে।
গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ওই ঘটনার পরপরই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ খালেদ রহীমকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। সংঘঠিত অগ্নিকাণ্ডের উৎস ও কারণ উদঘাটন, পেছনে কারো ব্যক্তিগত বা পেশাগত দায় আছে কি না তা উদঘাটন এবং এরকম দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সুপারিশ করার দায়িত্ব দেওয়া হয় তদন্ত কমিটিকে।
ওই কমিটি প্রাথমিকভাবে আগুন লাগার কারণ হিসেবে বৈদ্যুতিক 'লুজ কানেকশন'কে দায়ী করেছিলে। দীর্ঘ তদন্ত শেষে কী কারণে আগুন লেগেছে, তা জানিয়ে কমিটি সরকারকে প্রতিবেদন দিয়েছে।
কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে এখন সচিবালয়ের কাঠামো ও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সচিবালয়ের ভেতরে থাকা বিদ্যুতের সাবস্টেশনগুলো আধুনিক নয়। কিছুটা হলেও ত্রুটিপূর্ণ। আগুনে পুড়ে যাওয়া ৭ নম্বর ভবনের পাশে থাকা সাবস্টেশন সম্পর্কে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই সাবস্টেশনটির ডিজাইন মানসম্মত নয় এবং এর যন্ত্রপাতি পুরনো। এছাড়া সচিবালয়ের ভেতরে থাকা ১১টি সাবস্টেশনকেই আধুনিক ও নিরাপদ করা দরকার বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
ওই প্রতিবেদনে ভবিষ্যতে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে বাস্তবায়নের বেশ কিছু সুপারিশ করেছে কমিটি। অগ্নি নিরাপত্তার পাশাপাশি সচিবালয়ের সার্বিক নিরাপত্তার জন্যও কিছু সুপারিশ আছে প্রতিবেদনে।
তদন্ত কমিটির সুপারিশের আলোকে এখন সচিবালয়ের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হচ্ছে। এসব কার্যক্রম প্রধানত গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন গণপূর্ত অধিদপ্তর বাস্তবায়ন করবে। পাশাপাশি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরও কিছু কাজ করবে।
এ বিষয়ে গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুস সাত্তার বুধবার টিবিএসকে বলেন, ইতিমধ্যে ৫ নম্বর গেটের পাশে একটি গেট করা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য যেসব সুপারিশ করা হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ওই প্রকল্প প্রস্তাবে ৫ নম্বর ভবন থেকে ৬ নম্বর ভবন ও ৬ নম্বর ভবন থেকে ৭ নম্বর ভবনে যাওয়ার যে দুটো কানেক্টিং ব্রিজ রয়েছে, সেগুলো অপসারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনের পরিকল্পনা
কমিটির সুপারিশের আলোকে মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদেও সচিবালয়ের বেশ কিছু পরিবর্তন ও সংযোজনের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি বিল্ডিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু করা। এর মাধ্যমে বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, অগ্নি শনাক্তকরণ ব্যবস্থা এবং প্রতিরোধ ও প্রতিকার ব্যবস্থা একীভূত করা থাকবে।
সচিবালয় ও আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার (কেপিআই) জন্য একটি 'বিশেষ শ্রেণির' ফায়ার স্টেশন স্থাপন করা হবে, যেখানে আধুনিক গাড়ি ও সরঞ্জামাদি থাকবে। এছাড়া বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) প্রণীত হওয়ার আগে যেসব ভবন স্থাপন করা হয়েছে, সেগুলোর ভূমিকম্প সহনীয়তা মূল্যায়ন করা হবে। প্রয়োজনে ওইসব ভবনে রেট্রোফিটিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এছাড়া সহজে দৃশ্যমান অগ্নি নিরাপত্তামূলক প্রস্থান চিহ্ন, এমনকি বিদ্যুৎ না থাকলেও যাতে আলোকিত দেখায় এমন ব্যবস্থা স্থাপন করা হবে। সচিবালয়ের যেসব কক্ষে গুরুত্বপূর্ণ নথি সংরক্ষণ করা হয়, সেইসব কক্ষে ফায়ার রেটেড দরজা লাগানো হবে। সচিবালয়ের সব ভবনের অভ্যন্তরীণ করিডোর ও সিড়ি ধোঁয়া এবং তাপমুক্ত রাখার জন্য কলাপসিবল গেটের পরিবর্তে ফায়ার রেটেড ডোর স্থাপন করা হবে।
সচিবালয়ের সগুলো ভবনের প্রত্যেক তলায় অগ্নি শনাক্তকরণ যন্ত্র (ফায়ার ডিটেক্টর, স্মোক বা হিট ডিটেক্টর) ও ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম স্থাপন করা হবে। এসব সিস্টেম কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা থাকবে। সচিবালয়ের অভ্যন্তরীণ পানির রিজার্ভারে পানি ভর্তির জন্য ওয়াসার লাইনের পাশাপাশি নিজস্ব পানি রিফিলিংয়ের ব্যবস্থা করার সুপারিশও করেছে তদন্ত দল। তবে এ কাজটি দীর্ঘ মেয়াদে করলেও চলবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
কমিটির প্রতিবেদনে অগ্নি নিরাপত্তার পাশাপাশি সচিবালয়ের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য বেশকিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সচিবালয় এলাকার নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজনীয়সংখ্যক হাই রেজোল্যুশন ক্যামেরা, আধুনিক ফেস ডিটেকশন সিসি ক্যামেরা ও আধুনিক মডেলের নাইট ভিশন সিসি ক্যামেরা স্থাপন এবং রেকর্ড সংরক্ষণের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ সিসিটিভি কন্ট্রোল রুম স্থাপনের সুপারিশ।
জানা গেছে, গত বছর ৭ নম্বর ভবনে আগুন লাগার সময় সচিবালয়ে স্থাপন করা অধিকাংশ সিসিটিভি ক্যামেরা কার্যকর ছিল না। সে কারণে ওই অগ্নিকাণ্ডের পেছনে কোনো ব্যক্তির সম্পৃক্ততা ছিল কি না, তা নিশ্চিত হতে পারেনি তদন্ত দল।
সচিবালয়ের বিভিন্ন কক্ষের চাবি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অত্যাধুনিক করার মাধ্যমে চাবি কক্ষের রক্ষণাবেক্ষনের ব্যবস্থাপনা পুলিশ বা অন্য কোনো নিরাপত্তা বাহিনীর দায়িত্বে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমান কলাপসিবল গেট পরিবর্তন করে আধুনিক লক সিস্টেম গেট ব্যবহারের সুপারিশ করেছে কমিটি। সচিবালয়ের ভেতরে যাতে কোনো প্রকার অবৈধ মালামাল প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য ব্যাগেজ স্ক্যানিং মেশিন স্থাপনের সুপারিশও করা হয়েছে।
সচিবালয়ের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ সদস্যদের সুশৃঙ্খলভাবে দায়িত্বপালনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক পদ সৃষ্টি ও পদায়ন করার সুপারিশ এসেছে।
এছাড়া বিশেষ প্রয়োজনে ছুটির দিনে সচিবালয়ের ভেতরে কোনো কর্মকর্তাকে অফিস করতে হলে তাকে আগে থেকেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখাকে অবহিত করার নিয়ম চালু এবং নিরাপত্তা-সংক্রান্ত নীতিমালা হালনাগাদ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
অগ্নিকাণ্ডের ক্ষয়ক্ষতি
২৬ ডিসেম্বরের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৭ নম্বর ভবনের ৬, ৭, ৮ ও ৯ এই চারটি তলা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওইসব তলায় থাকা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমস্ত নথিপত্র পুড়ে যায়। ওই দিন সচিবালয়ের গেট দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের বড় গাড়ি ভেতরে প্রবেশ করাতে বেশ বেগ পেতে হয় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের।
অনেক কষ্টে ফায়ার সার্ভিসের মাত্র দুটি টার্নটেবল ল্যাডার (টিটিএল) গাড়ি ভেতরে ঢোকানো সম্ভব হয়। ওই সময় ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল সাংবাদিকেদের বলেছিলেন, যদি আরও বেশি টিটিএল ঢুকতে পারত, তাহলে আরও কম সময়ের মধ্যে আগুন নেভানো সম্ভব হতো। আবার বিভিন্ন ভবনকে সংযুক্তকারী কানেকটিং ব্রিজের জন্য ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঠিকমতো কাজ করতে পারেনি।
সচিবালয়ে ঢোকার মোট পাঁচটি গেট থাকলেও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকার গেট আছে মাত্র দুটি। এ দুই গেট দিয়েও ফায়ার সার্ভিসের বড় গাড়ি ঢুকতে সমস্যা হয়েছে। ওই দিন সচিবালয়ের ৪ নম্বর গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়ি ভেঙে যায়।