ম্যাটস ও মেডিকেল শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরোধ কী নিয়ে?

নামের আগে 'ডাক্তার' পদবি ব্যবহার করা নিয়ে মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস)-এর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব চলছে এমবিবিএস ও বিডিএস শিক্ষার্থীদের। আর এ দ্বন্দ্বে দেশজুড়ে ব্যাহত হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা খাতের কার্যক্রম।
ম্যাটস শিক্ষার্থীদের দাবি, তারাও মেডিকেলের বেসিক বা মূল বইগুলো পড়ে ৪ বছরের ডিগ্রি নেন, তারাও যেহেতু বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) থেকে ডিগ্রি পান এবং ৭৩টির মতো ওটিসি ড্রাগস লিখতে পারেন—সুতরাং তারাও 'ডিপ্লোমা ডাক্তার' হিসেবে পরিচিতি পেতে পারেন।
অপরদিকে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের দাবি, দেশে যেখানে এমনিতেই কোয়াক বা হাতুড়ে চিকিৎসকদের কারণে ভুল ও অপচিকিৎসার স্বীকার হন রোগীরা—সেখানে ম্যাটসদের 'ডাক্তার' পদবি লেখার অনুমতি দিলে রোগীদের দুর্ভোগ আরও বাড়বে।
এই দ্বন্দ্বে বিভিন্ন সময় কর্মবিরতি, একাডেমিক শাটডাউন, সড়ক অবরোধসহ বিভিন্ন ধরণের কর্মসূচি পালন করে আসছেন ম্যাটস ও মেডিকেল শিক্ষার্থীরা। এতে স্বাস্থ্যখাতে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে, রোগী ও সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে।
এদিকে, আগামী ১২ মার্চ 'ন্যূনতম এমবিবিএস অথবা বিডিএস ডিগ্রিপ্রাপ্ত ছাড়া অন্য কেউ তাদের নামের আগে ডাক্তার পদবি ব্যবহার করতে পারবেন না' সংক্রান্ত রিটের রায় ঘোষণা হওয়ার কথা রয়েছে। এখন সেই রায়ের দিকেই তাকিয়ে আছে উভয়পক্ষ।
মেডিকেল শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
এমবিবিএস/বিডিএস ছাড়া কেউ 'ডাক্তার' লিখতে পারবে না, বিএমডিসির নিবন্ধন কেবল এমবিবিএস/বিডিএস উত্তীর্ণদের দেওয়া, ম্যাটসদের নিবন্ধন দেওয়া বন্ধ করাসহ ৫ দফা দাবিতে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে এক সপ্তাহ ধরে কর্মবিরতি ও একাডেমিক শাটডাউন পালন করেছেন দেশের ইন্টার্ন ডাক্তার ও মেডিকেল শিক্ষার্থীরা।
আগামী ১২ মার্চ পর্যন্ত তাদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার করা হয়েছে; কিন্তু গণসংযোগ, সচেতনতা তৈরিসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
ডক্টরস মুভমেন্ট ফর জাস্টিসের প্রচার সম্পাদক ডা: সৈয়দা নাজিয়া আলী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এসএসসি'তে ন্যূনতম জিপিএ ২.৫ পেয়েও ম্যাটসে ভর্তি হওয়া যায়। তারা চার বছরের কোর্স করে, মেডিকেলের বেসিক সাবজেক্টগুলো পড়লেও তাদের শিক্ষকরা তো আমাদের শিক্ষকদের মতো প্রফেসররা না বা তারা তো আমাদের মতো প্রাকটিক্যাল করেন না।"
"তারা ওটিসি ড্রাগস লিখতে পারেন, আমরা (ওভার দ্য কাউন্টার) তালিকা হালনাগাদ করার দাবি করছি। এমবিবিএস/বিডিএস ছাড়া আর কেউ ওটিসি তালিকার বাইরে ওষুধ লিখতে পারবেন না। সবাই অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার কারণে দেশে অ্যান্টিবায়োটিক রেসিজটেন্স বাড়ছে।"
তিনি আরও বলেন, "পৃথিবীর কোথায় ম্যাটসরা ডাক্তার লিখতে পারেন না। সাধারণ মানুষ 'ডাক্তার' বলতে মূলত এমবিবিএস ডাক্তারদেরই বোঝে। ম্যাটসরা ডাক্তার লিখলে রোগীরা বিভ্রান্ত হবেন এবং ভুল চিকিৎসার স্বীকার হওয়ার ঝুঁকি আছে।"
এ সংক্রান্ত আইন
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল আইন–২০১০ অনুযায়ী, এমবিবিএস এবং বিডিএস পাশ করা চিকিৎসক ব্যতীত অন্য কেউ ডা. পদবি ব্যবহার করতে পারবেন না।
২০১০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন হয়। 'ডিএমএফ' ডিগ্রিধারীদের (ডিপ্লোমাধারী হিসেবে নিবন্ধিত) ক্ষেত্রে আইনটির বৈষম্যমূলক প্রয়োগের অভিযোগ নিয়ে বাংলাদেশ ডিপ্লোমা মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন আহ্বায়ক শামসুল হুদাসহ অন্যরা ২০১৩ সালে একটি রিট করেন।
ওই আইনের ২৯ ধারার বৈধতা নিয়ে বাংলাদেশ ডিপ্লোমা মেডিকেল অ্যাসোসিশনের সভাপতি ও সেক্রেটারি গত বছর অপর রিটটি করেন। দুটি রিটের ওপর একসঙ্গে চূড়ান্ত শুনানি শেষে হাইকোর্ট রায়ের জন্য আগামী ১২ মার্চ দিন ধার্য করেছেন।
বর্তমানে সারাদেশে ১৬টি সরকারি ম্যাটস ও প্রায় ২০০টি বেসরকারি ম্যাটস বিষয়ক প্রতিষ্ঠান এই কারিকুলাম পরিচালনা করে আসছে।
কর্মক্ষেত্রে ডিএমএফ ডিগ্রিধারীগণ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় 'উপ সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার' পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।
বাংলাদেশে বর্তমানে ডিপ্লোমা মেডিকেল শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার এবং বিএমডিসি নিবন্ধিত ডিএমএফ'র সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ৫ হাজার ৫০০ ডিপ্লোমা চিকিৎসক (ডিএমএফ) 'উপ সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার' পদে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রসহ জেলা সদর হাসপাতালে কর্মরত আছেন।
ম্যাটস শিক্ষার্থীদের আন্দোলন
এদিকে, অবিলম্বে দশম গ্রেডে শূন্য পদে নিয়োগসহ ৪ দফা দাবিতে সোমবার সকাল থেকে সারাদেশের সব ম্যাটস প্রতিষ্ঠানে 'একাডেমিক শাটডাউন' পালন করছেন ম্যাটস শিক্ষার্থীরা।
ডিএমএফ ডিগ্রিধারী ডিপ্লোমা চিকিৎসকের অধিকার আদায়ের উদ্দেশ্যে হাইকোর্টে চলমান মামলার রায়কে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের কর্মবিরতি, সভা-সমাবেশ একদিকে যেমন দেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিরোধী এবং আদালত অবমাননার সমান—অন্যদিকে দেশের সাধারণ মানুষের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে দাবি ম্যাটস শিক্ষার্থীদের।
জেনারেল এবং ম্যাটস ছাত্র ঐক্য পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র সমন্বয়কারী আহসান হাবিব টিবিএসকে বলেন, "আমরা অন্যান্য ডিপ্লোমা যেমন— ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মতো ডিপ্লোমা ডাক্তার লিখতে চাই। আমরা ৪ বছর ৬ মাস পড়াশোনা করি এবং বিএমডিসি আমাদের ডিএমএফ ডিগ্রি দেয়। বিএমডিসির নির্দেশনামতো আমরা ৭৩টি ওষুধ লিখতে পারি, নর্মাল ডেলিভারি, টিউমারসহ ছোট ছোট সার্জারি করতে পারি। আমরা যেহেতু চিকিৎসা সেবা দেই, তাই আমরা ডাক্তার পদবি লিখতে চাই।"
তিনি আরও বলেন, "ডিপ্লোমা ডাক্তার লিখলেও তো আমাদের ডিএমএফ ডিগ্রি থাকবে নামের শেষে। তাহলে তো এমবিবিএস ডাক্তারদের সাথে আমাদের দ্বন্দ্ব হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমরা আশা করছি, সরকার ১২ তারিখ আমাদের উপযুক্ত ডিগ্রি লেখার সুযোগ দেবে।"
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
টিবিএস-এর সঙ্গে আলাপকালে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের চেয়ারম্যান ডা: রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, "মেডিকেল শিক্ষার্থী ও ম্যাটস শিক্ষার্থীদের এই সংকট সমাধানের একমাত্র উপায় হলো– 'রুল অব ল', যার যেটা প্রাপ্য তাকে সেটা দেওয়া। পৃথিবীর কোথাও ম্যাটসরা ডাক্তার লেখেনা; বাংলাদেশে সেটা কীভাবে লিখবে? মব জাস্টিস হলে ভিন্ন কথা। ১২ তারিখ রায় হলেই যে সব সমাধান হয়ে যাবে তা তো নয়, সরকারকে ঠিক করতে হবে তারা কী করবে।"
নামের আগে 'ডাক্তার' লেখা নিয়ে ম্যাটস ও মেডিকেল শিক্ষার্থীদের এই সংকটের সমাধানের জন্য হাইকোর্টের রায়ের অপেক্ষায় আছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেন, "ম্যাটসরা একটা লিমিডেট লিস্ট অব ওষুধ তাদের প্রেসক্রিপশনে লিখতে পারেন। তবে তারা এখন প্রেসক্রিপশন লেখার বাইরেও ছোট ছোট প্রসিডিউরও করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ অবস্থায় মেডিকেল শিক্ষার্থী ও ইন্টার্নদের মধ্যে একটা ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।"
"বিশেষত ঢাকার বাইরের দূরের জেলা-উপজেলাগুলোতে প্রাইভেট সেক্টরে ম্যাটসরা অনেক বেশি কাজ করেন ডাক্তারদের বদলে। অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেরাও কোনো প্রতিষ্ঠান দিয়েছেন। এ কারণে অনেক জায়গায় ডাক্তারদের সঙ্গে তাদের খারাপ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।"
"শুধুমাত্র নামের আগে ডাক্তার লেখা, না লেখা নয়—একটু গভীরে দেখলে তারা আসলে তাদের সীমা লঙ্ঘন করে প্রাকটিস করছেন, সার্জারি করছেন। তাই সীমানা বেঁধে দিতে হবে।"
তিনি আরও বলেন, "নামের আগে ডাক্তার লেখা নিয়ে যে রিট রয়েছে, তা এখন পর্যন্ত ৯২তম বারের মতো পেছানো হয়েছে। আগামী ১২ মার্চ রায় দেওয়া হবে। এখন আমরা হাইকোর্টের রায়ের জন্য অপেক্ষা করছি। হাইকোর্ট যদি ঠিক করে দেন, কে ডাক্তার লিখবে–কে লিখবেনা, তাহলে তো সমাধান হয়েই গেলো।"
"ডিপ্লোমা ডাক্তার লেখার কথা তারা বলা হচ্ছে, কিন্তু দুনিয়াতে কোথাও ডিপ্লোমা ডাক্তার নেই। ডাক্তারের সঙ্গে মানুষের জীবনের সম্পর্ক জড়িয়ে," যোগ করেন তিনি।